পানির নিচে রত্নভাণ্ডার: ইন্দোনেশিয়ার হারানো ‘স্বর্ণদ্বীপ’ শ্রীবিজয়া
রাতের বেলা ইন্দোনেশিয়ার মুসি নদীতে ডুব দিয়ে কিছু একটা উদ্ধার করেছিলেন জেলেরা, কিন্তু অন্ধকার থাকায় বুঝতে পারেননি ঠিক কিসের সন্ধান পেয়েছেন। সকালে সূর্যের আলো ফুটতেই বোঝা গেল, তাদের হাতে উঠে এসেছে অত্যন্ত মূল্যবান সব রত্নপাথর ও স্বর্ণ-রৌপ্য!
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পানির নিচে লুকানো এসব ধন-সম্পদ এলো কোথা থেকে? এ নিয়ে একটি বিস্তারিত গবেষণা চালিয়েছে অনলাইন ম্যাগাজিন 'রেকওয়াচ'। ম্যাগাজিনটির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্রিটিশ মেরিন প্রত্নতত্ত্ববিদ, ডা. শন কিংসলে বলেন, "আপনার মনে হতেই পারে, এ যেন সিন্দাবাদের গল্পের নাবিকের মতো! কিন্তু না, আসলেই এর অস্তিত্ব আছে।"
বলা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার হারিয়ে যাওয়া রাজ্য 'শ্রীবিজয়া'র কথা। শ্রীবিজয়াকে একসময় 'স্বর্ণের দ্বীপ'ও বলা হতো। আজ থেকে ৬০০ বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ এক রাজ্য ছিল শ্রীবিজয়া। কিন্তু দ্বাদশ শতকে এসে যেন ভোজবাজির মতোই হাওয়া হয়ে যায় রাজ্যটি!
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো যেমন আটলান্টিক মহাসাগরের অতল গহ্বরে কল্পিত আটলান্টিস দ্বীপের হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন, শ্রীবিজয়াও ঠিক তেমনিভাবেই হারিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক এই রহস্যময় রাজ্যের সঠিক অবস্থান বা সম্পদের উৎস খুঁজে বের করতে পারেননি।
বছর পাঁচেক আগে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের পালেমবাং শহরের জেলেরা মুসি নদীর গভীরে প্রথম এই ধনসম্পদের সন্ধান পায়। তখন থেকেই জনসাধারণের মনে অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে এই আবিষ্কার।
বর্তমানে প্রায়ই দেখা যায়, বিপজ্জনক ডাইভিং গিয়ার ব্যবহার করে এবং মুসি নদীতে থাকা কুমিরগুলোর চোখ ফাঁকি দিয়ে বালতি বালতি কাদা তুলে আনছেন ডুবুরিরা। আর সেই কাদার ভেতরেই পাওয়া যাচ্ছে স্বর্ণদ্বীপের অমূল্য সম্পদ।
পানির নিচ থেকে উদ্ধারকৃত সম্পদের মধ্যে রয়েছে রত্নপাথর, বড় আকৃতির একটি রত্নখচিত বুদ্ধ মূর্তি, কানের দুল এবং গলার হার থেকে খুলে পড়া স্বর্ণের পুঁতি। এছাড়া, স্বর্ণের তৈরি একটি পাখির নখরও রয়েছে যা প্রাচীনকালে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে গণ্য হতো। পবিত্র বজ্রপাতের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত, রত্নখচিত তলোয়ারের বাঁটও পাওয়া গেছে নদীর তলদেশ থেকে।
ধারণা করা হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে দূষিত একটি নদী থেকে পাওয়া এসব ধনসম্পদ আসলে অষ্টম শতকের।
ডা. কিংসলে জানালেন, বড় বড় অনুসন্ধানকারীরা শ্রীবিজয়া রাজ্যের খোঁজ করতে থাইল্যান্ড এবং ভারত পর্যন্তও গিয়েছেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। শ্রীবিজয়া সর্বদাই নিজেকে সঙ্গোপনে রেখেছে।
রহস্যময় শ্রীবিজয়া রাজ্যের সন্ধান না পাওয়ার একটি বড় কারণ, এটি ছিল একটি ভাসমান রাজ্য। এখানে শুধুমাত্র মন্দির এবং রাজার বাসভবনই শুকনো জমির উপর নির্মাণ করা হয়েছিল। বাকি সাধারণ প্রজারা বাঁশ-কাঠ ও খড়ের ছাউনি দিয়ে বানানো ভাসমান বাড়িতে বাস করতো। তারা শালতি বা ডোঙ্গায় করে চলাফেরা করতো। আর যদি স্থানান্তর করতে চাইতো, তাহলে পুরো বাড়িসুদ্ধই সরিয়ে নিয়ে যেতো।
কিন্তু শ্রীবিজয়া রাজ্য এতখানি ঐশ্বর্যের অধিকারী হলো কী করে? তার অন্যতম কারণ, গ্রেট সিল্ক রোডের সবগুলো বাণিজ্যিক রুট ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে।
মশলা থেকে শুরু করে ক্রীতদাস, সবই আনা-নেওয়া করা হতো এই সামুদ্রিক পথে। সমুদ্রপথে বাণিজ্য থেকে মুনাফা লাভ করা ছাড়াও, শ্রীবিজয়া রাজ্যের ছিল স্বর্ণভান্ডার। রাজ্যের স্বর্ণ ও রূপার মুদ্রাগুলোতে চন্দনের ফুলের ছাপ দেওয়া হতো এবং সংস্কৃত ভাষায় 'গৌরব' কথাটি লেখা থাকতো।
চীন ও পারস্যের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল শ্রীবিজয়ার। কয়েক শতক পর সম্পদ ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে বোর্নিও, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, বঙ্গোপসাগর অঞ্চল এবং মাদাগাস্কারের সাথেও যোগাযোগ বিস্তৃত করে শ্রীবিজয়ার নাবিক-বণিকেরা।
শুধুমাত্র রাজ্যের রাজধানী্তেই ছিল ২০,০০০ সৈন্য, ১০০০ সন্ন্যাসী ও ৮০০ মহাজনের অবস্থান। রাজ্যের ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে আড়ম্বরপূর্ণ, বিলাসী জীবনযাপনেও কোনো কমতি রাখেনি শ্রীবিজয়ার বাসিন্দারা।
জানা যায়, রাজ্যের বৌদ্ধ শাসকেরা রত্নখচিত টুপি পরতেন। ফুল, নারকেল ও মধু দিয়ে তৈরি পানীয় পানের রেওয়াজ ছিল তাদের মধ্যে।
সম্পদের প্রাচুর্যের পাশাপাশি কিছু অদ্ভুত রীতিনীতিও ছিল রাজ্যের মধ্যে। কোনো রাজা মারা গেলে তার ভৃত্যকেও জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে হতো, যেন মৃত্যুর পরেও সে রাজাকে সঙ্গ দিতে পারে!
কিন্তু শ্রীবিজয়া রাজ্যের সুদিন আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকে। জলদস্যু ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যগুলোর আক্রমণে তাদের সমুদ্রপথের বাণিজ্য বিঘ্নিত হয়। ১০২৫ সালের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দোনেশীয় রাজ্যগুলো শ্রীবিজয়াকে অধিকার করে নেয় এবং ১৩ শতকের মধ্যে এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় বলে লিখেছেন জনৈক ঐতিহাসিক।
খোদ ইন্দোনেশিয়ার ভেতরেই বিস্মৃত এক রাজ্য হয়ে ছিল শ্রীবিজয়া। শুধুমাত্র বিংশ শতাব্দীতে এসে বিদেশি ঐতিহাসিকরা এই রাজ্যের ইতিহাস বের করতে উঠেপড়ে লাগেন। ১৯২০ সালে ফরাসি ঐতিহাসিক জর্জ সেডেস একটি প্রাচীন চীনা পাণ্ডুলিপির ভেতরে এই রাজ্যের নাম খুঁজে পান।
শ্রীবিজয়া রাজ্যের হারিয়ে যাওয়া ও পালেমবাংয়ে এত স্বর্ণ থাকার পেছনেও নানা তত্ত্ব হাজির হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, পানির সাথে গভীর বন্ধন থাকায় শ্রীবিজয়ার বাসিন্দারা নৈবেদ্য হিসেবে পানিতে স্বর্ণগয়না ফেলতেন। আবার কারো কারো ধারণা, যুদ্ধে নয় বরং নদীগর্ভেই বিলীন হয়েছিল শ্রীবিজয়া।
কিন্তু ঐতিহাসিক বা প্রত্নতত্ত্ববিদদের হাতে যাওয়ার বদলে জেলেদের হাতে শ্রীবিজয়া রাজ্যের নিদর্শন উঠে আসা এবং সেগুলো বিক্রি হওয়া যে রাজ্যের ইতিহাসকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে, সে কথা স্পষ্ট।
- সূত্র: ডেইলি মেইল