প্রতিটি স্থাপনার আছে নিজস্ব সত্তা: মেরিনা তাবাসসুম
ঢাকার দক্ষিণখানে অবস্থিত বায়তুর রউফ মসজিদটি দেখতে আর দশটি মসজিদের চেয়ে ভিন্ন। মসজিদটিতে নেই কোনো গম্বুজ কিংবা মিনার। ভিত্তিপ্রস্তরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে চতুষ্কুণ লাল ইটের স্থাপনা। প্রাকৃতিকভাবে আলোবাতাস প্রবেশের জন্য ইটের দেয়াল ও ছাদে আছে অসংখ্য ছিদ্র। চার দেয়ালের হলের বাইরে রয়েছে ১৩ ডিগ্রি কোণে ঘুরানো আঙিনা। মসজিদের অসাধারণ স্থাপত্য কৌশল ও নকশার জন্য ২০১৬ সালে আগা খান স্থাপত্য পুরষ্কার পান বাংলাদেশি স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম।
সম্প্রতি জলবায়ু ও শরণার্থীদের জন্য স্বল্প খরচে অস্থায়ী বাড়ির নকশা নির্মাণের জন্য আন্তর্জাতিক সন পদক পেয়েছেন মেরিনা।গত বছর মুম্বাইয়ে স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড আর্কিটেকচার আয়োজিত এক সম্মেলনে অংশ নেন মেরিনা। সেসময় দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে আলাপকালে স্থপতি হিসেবে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন তিনি।
নিজের নকশাকৃত স্থাপনায় আলোর ব্যবহার প্রসঙ্গে মেরিনা বলেন, "আলোর প্রতি আমার এই আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল ঢাকায় লুই কানের নকশায় নির্মিত জাতীয় সংসদ ভবন দেখার পর। আলো নিয়ে তার কাজ একইসঙ্গে আধ্যাত্মিক ও সংবেদনশীল এক অনুভূতির সৃষ্টি করে। ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় আমি প্রথম সংসদ ভবন দেখি। স্থাপনার চারপাশে হাঁটার সময় এক পরাবাস্তব অনুভূতি পেয়েছিলাম, যা আগে কখনো হয়নি।"
"অপর যে স্থাপনাটি আমাকে মোহাবিষ্ট করেছিল তা হলো ইস্তামবুলের হায়া সোফিয়া। আলোছায়ার খেলায় মুগ্ধ হয়ে আমি ভাবছিলাম কীভাবে এত নীরব থেকেও স্থাপনাটি নিজের শক্তিশালী উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। তখন থেকে আমার স্থাপনাগুলোতে আমি সাধ্যমতো আলো ব্যবহারের চেষ্টা করি।"
মেরিনা তাবাসসুমের দাদী বায়তুর রউফ মসজিদের জন্য জমি দান করেছিলেন। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সীমিত অর্থায়নের মসজিদটি শেষ করার মতো অর্থ মেরিনার কাছে ছিল না। পুরো প্রকল্পটির ব্যবস্থাপক, অর্থ সংগ্রহকারী, নকশাকার এবং নির্মাতা ছিলেন মেরিনা নিজেই। আলো ছিল এই পুরো স্থাপত্যের অলঙ্কার। বছরের বিভিন্ন সময় মসজিদটিতে ভিন্নসব আলোছায়ার খেলা সৃষ্টি হয়।
৮০'র দশকের শেষে বাংলাদেশের প্রথিতযশা স্থপতি মাজহারুল ইসলামের "স্থানিক-প্রতিক্রিয়াশীল স্থাপত্য" দ্বারা প্রভাবিত স্থপতিদের একজন মেরিনা তাবাসসুম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী মেরিনা স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে সমসাময়িক হয়ে উঠার পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতিকেও খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
১৯৯৫ সালে স্নাতক পাশের পর মেরিনা তাবাসুসুম স্থপতি কাশেফ চৌধুরীর সঙ্গে আরবানা নামের একটি আর্কিটেক্ট ফার্ম গড়ে তুলেন। কাশেফ চৌধুরীর সঙ্গে যৌথভাবে মেরিনা দেশে বিদেশে অসংখ্য স্থাপত্য নকশা নির্মাণ করেন। এর অনেকগুলোই তাদের এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার ও খ্যাতি।
এর মধ্যে অন্যতম হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘর। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পর 'মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস' নামে মেরিনা এককভাবে স্থাপত্য নকশার চর্চা শুরু করেন।
ইউরোপ ও আমেরিকান স্থাপত্য নির্মাণ কৌশলের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন মেরিনা তাবাসসুমের প্রজন্মের বাংলাদেশি স্থপতিরা। আর তাই কোন জিনিস ধরে রাখা উচিত হবে, কোনটা বাতিল করা যাবে অথবা নতুন কী সংযোজন করা উচিত বারবার এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হন তারা। মেরিনাও ব্যতিক্রম ছিলেন না। নিজের নকশার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তাকেও দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
"আমি প্রতিটি স্থাপনাকেই একটি সত্তা হিসেবে দেখি, যাদের মাঝে প্রাণ থাকে। এটা এমন কিছু যা মানুষ সহজে দেখে না। আমার নকশাকৃত ভবনগুলোর প্রাণকেন্দ্রে আমি একটি শূন্যস্থান রাখি। এই শূন্যতাই ভবনগুলোকে জীবন দেয়," বলেন তিনি।
২০১৮ সালে ভেনিস বাইনালে তিনি এই ধারণাটি ব্যবহার করেন। সেখানে তার স্থাপনার কেন্দ্রই ছিল আঙিনা।
দ্য উইজডম অব দ্য ল্যান্ড নামের প্রকল্পটি ঢাকায় তাদের শৈশবের বাড়ির প্রতিচ্ছবি ছিল। সেই আঙিনা ছিল প্রাণোচ্ছলতায় মুখর।
সুন্দরবন থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত যশোর জেলার পানিগ্রাম রিসোর্টেও একই বিষয় উঠে এসেছে। স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণে নির্মিত হয় এই রিসোর্ট।
পানিগ্রাম রিসোর্ট সম্পর্কে মেরিনা বলেন, "পাঁচ বছর আগে আমি যখন পানিগ্রামের কাজ শুরু করি তখন প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমার মনে হয়েছিল যে, আমি প্রস্তাবিত প্রকল্পের কিছুই জানি না। ক্লায়েন্ট আমাদের কাছে সামাজিক পরিবেশে প্রাকৃতিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ প্রকল্পের প্রস্তাব রেখেছিল। আমরা তখন স্থানীয় ভিটেবাড়িগুলো পর্যালোচনা শুরু করি। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করি। সেখানকার ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া হয়। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মেলবন্ধনই হয়ে উঠে আমাদের প্রকল্পের অনুপ্রেরণা।"
পুরো গ্রামটিই অসংখ্য আঙিনার সমন্বয়ে যুক্ত ছিল। বাড়ির আঙিনাগুলো একইসঙ্গে সামাজিক ও ব্যক্তিগত পরিসরের সৃষ্টি করেছে।
মেরিনা জানান, স্থানীয়দের থেকে মাটির বাড়িঘর নির্মাণ কৌশল জানতে চাওয়া হয়। মাটির বাড়ি নিয়ে তাদের মধ্যে যে হীনম্মন্যতা ছিল সেটিও প্রকাশ পায়। তারা যখন জানে এখানকার রিসোর্টে মাটির বাড়ি নির্মিত হবে, তখন তারা অবাক হয়ে যায়।
"তাদের কাছে মাটির ঘর হলো গরীবের ভিটেবাড়ি। রিসোর্ট নির্মাণে তাদের যুক্ত করতে এই হীনম্মন্যতা দূর করে কীভাবে তাদের আত্মবিশ্বাসী করের তোলা সম্ভব, আমাদের তা নিয়ে ভাবতে হয়েছে। এভাবেই গ্রামবাসীর সঙ্গে আমাদের পারস্পারিক যোগাযোগ শুরু হয়। তারা যেমন স্থানীয় সরঞ্জামাদি, নির্মাণ কৌশল দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছে, তেমনি আমরাও পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর রান্নাঘর ও শৌচাগার নির্মাণ কৌশল দিয়ে তাদের সহায়তা করি," বলেন মেরিনা।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের আশা-আকাঙ্খারও পরিবর্তন ঘটে। রিসোর্টের আশেপাশের মানুষজন মাটির ঘরের পরিবর্তে ইটের বাড়িতে থাকতে চাইতেন। কিন্তু, তাবাসসুম ও তার দল যখন সেখানে পৌঁছে, তখন তাদের পাকাবাড়ি নির্মাণে তেমন দক্ষতা ছিল না।
মেরিনা জানান, সেখানে স্থপতির কাজ ছাড়াও তিনি প্ল্যাটফর্ম ফর কমিউনিটি অ্যাকশন অ্যান্ড আর্কিটেকচারের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যস্থতাকারীর কাজ করেন। স্থানীয় নারীদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের জন্য একটি দল গঠন করা হয়। প্রতি সপ্তাহে এক ডলার সঞ্চয়ের মাধ্যমে তারা একটি তহবিল গঠন করে। নিজেদের চাহিদামাফিক বাড়ি গড়ে তুলতে এই অর্থ কাজে লাগানোই ছিল উদ্দেশ্য।
মেরিনা বলেন, "স্থপতিদের উচিত তাদের কাজের পরিধি অবকাঠামো নির্মাণের বাইরে সম্প্রসারিত করা। আমি এই বিষয়টি মাথায় রেখেই কাজ করার চেষ্টা করি। এই প্রকল্পে সম্মিলিতভাবে কাজ করে স্থপতিরাও যে আশার আলো হয়ে উঠতে পারে সেই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম।"
"ভবিষ্যৎ স্থপতিদের এই পেশাকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে। বাসযোগ্য পরিবেশের জন্য ভারসাম্য খুঁজে নিতে নতুন সব স্থাপত্য কৌশলের সন্ধান করতে হবে," বলেন বেঙ্গল ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেকচারের সাবেক পরিচালক মেরিনা।