বগুড়ায় পাকিস্তানি বধে গোর্খা বাহিনীর অবদান
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতির বীর সন্তানদের অবদানকে চিরস্মরণীয় করতে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অবদানও মনে রাখার মতো। বিশেষ করে সাত নম্বর সেক্টরে বগুড়া, নওগাঁ ও জয়পুরহাটের বিজয় সুনিশ্চিত হয় ভারতীয় গোর্খা বাহিনীর সদস্যদের প্রকাশ্য ভূমিকার কারণে। মুক্তির সংগ্রামের দিনের ঘটনাপঞ্জির আলোচনায় জাতির দুই বীর সন্তানের মুখে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আফসার আফসার আলী
জয়পুরহাট সদর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার
যুদ্ধাহত বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আফসার আফসার আলী গোর্খা রেজিমেন্টর কাছে ভারতের শিলিগুড়ি পানিঘাটা এলাকায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। এই প্রশিক্ষণে অধিকাংশ প্রশিক্ষক ছিলেন ভারতের গোর্খা রেজিমেন্টের কর্মকর্তারা।
আফসার আলী বলেন, 'সাত নম্বর সেক্টরের অধীনের বগুড়ার সান্তাহারের হলহলিয়া ব্রিজ থেকে জয়পুরহাট পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধের অপারেশন এলাকা। বদলগাছী, নওগাঁ, ধামুইরহাট এই এলাকায় ছয়টি গ্রুপ মিলে যুদ্ধ করা। আমাদের কমান্ডার ছিলেন ড. কাজী ফরমজুল হক পান্না। উনি এখন ঢাকার ধানমন্ডিতে থাকেন। ফরমজুল হক পান্না নিয়ন্ত্রণে ছয়টা গ্রুপে মোট ৫৫ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই গ্রুপের আওতায় বগুড়া, নওগাঁ ও জয়পুহাটের বিভিন্ন অঞ্চলে অপারেশন পরিচালিত হয়।'
বীরমুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী বলেন, স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারছিলেন বিজয় সন্নিকটে। পাকিস্তানি হায়েনাদের মনোবল এ সময়ে তলানিতে ঠেকে গিয়েছিল। ঠিক এই দিনেই বাংলাদেশকে দুই বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত ও ভুটান স্বীকৃতি দেয়। এটা পাকিস্তানিদের জন্য অনেকটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁ হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানিদের পরাজয় সুনিশ্চিত করতে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাঙালি। এই শক্তিকে আরও শক্তিশালী করেত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সরাসরি অংশ নেন গোর্খা রিজেমিন্টের সদস্যরা।
তিনি বলেন, 'নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে ব্যাপক ক্যাম্প গড়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই ক্যাম্পে অপারেশনের পরিকল্পনা হলো। ৭ অক্টোবর ১৯৭১ সাল। গুরুত্বপূর্ণ এই অপারেশনেও গেরিলা বাহিনীকে পরোক্ষভাবে ব্যাপক সহায়তা করেন গোর্খা রেজিমেন্টের সদস্যরা।'
আফসার আলী বলেন, এই যুদ্ধের সংবাদ সেই সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার করা হয়। অপারেশনে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আর আক্কেলপুরের ফজলুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর বদলগাছী থানায় অপারশেন করা হয়। গেরিলা বাহিনী ওই সময় উড়িয়ে দেয় বদলগাছী থানা। সমসাময়িক সময়ে ধামইরহাট, জামালগঞ্জ, আক্কেলপুর এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করেন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় ভারত। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতির দেওয়ার পরেই ভারতের গোর্খা রেজিমেন্টের বিশাল বাহিনী অস্ত্র, কামানসহ সুসজ্জিত হয়ে জয়পুরহাটের হিলি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এরপর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। সাত নম্বর সেক্টরের বগুড়ার সান্তাহারের হলহলিয়া ব্রিজ থেকে জয়পুরহাটের অপারেশনে গোর্খা রেজিমেন্টের সদস্যরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন।
গৌর গোপাল গোস্বামী
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার
মহান মুক্তিযুদ্ধের সাত নম্বর সেক্টরে সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে অংশ নেন গৌর গোপাল গোস্বামী। তিনি মূলত বগুড়ার পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ করেন। তার মধ্যে অন্যতম এলাকা হলো, সারিয়াকান্দি, গাবতলীসহ বগুড়ার পূর্বাঞ্চল।
বীরমুক্তিযোদ্ধা গৌর গোপাল গোস্বামী জানান, আমরা অনেক আগে থেকেই যুদ্ধের মাঠে ছিলাম। কিন্তু গোর্খা বাহিনীর লোকজন এসেছেন ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরে। এরপর ভারতীয় গোর্খা বাহিনীর সদস্যরা ট্যাংকসহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। আমাদের এই এলাকায় গোর্খা রেজিমেন্টের সদস্যরা জয়পুরহাটের হিলি সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেন। কিন্তু ওই সময় বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েন তারা। হিলি সীমান্তের পাকিস্তানি বাহিনী বিশাল বাঙ্কার গড়ে তুলেছিল। সেখানে আমাদের মা-বোনদের নিয়েও তারা নির্যাতন চালাতো। হিলি সীমান্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশে ঢোকার সময় বাধার মুখে পড়েন ভারতীয় তথা গোর্খা বাহিনীর সদস্যরা। তখন সেখানে পাকিস্তানীদের হাতে অসংখ্য ভারতীয় সৈন্য শহীন হন। তবে এই বিশাল বাহিনীকে আটকাতে পারেনি। তাদের একটা অংশ বগুড়ায়ও এসেছিলেন।
জাতির বীর সন্তান গৌর গোপাল গোস্বামী বলেন, মুক্তির সংগ্রামে একটা সময় আমরা বুঝতে পারছিলাম বিজয় আসন্ন। তবে তখনও আমরা বগুড়ার পূর্বাঞ্চলে প্রকাশ্যে যুদ্ধ করতে পারছিলাম না। কিন্তু গোর্খা বাহিনীর সদস্যরা বগুড়ায় আসার পরে আমরা প্রকাশ্যে আসলাম পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ভারতীয় বাহিনীর আকাশপথের বিচরণ আমাদের ব্যাপক সাহস যোগায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌর গোপাল গোস্বামী জানান, আমরা ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে ছিলাম না। জয়পুরহাট হয়ে ভারতীয় বাহিনী এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মহড়া দেওয়া শুরু করেন। এ সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ঢাকামুখী হতে থাকেন। ঠিক এ সময় শাজাহানপুর উপজেলার দুবলাগাড়ী হাটে এলাকায় শেরপুর সড়কে মুক্তিবাহিনীর হাতে আক্রমণের শিকার হন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। এই অপারেশনে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তবে সেখানে পাকিস্তানী বাহিনীর ৮ থেকে ১০ জন মারা যান। পরে পাকিস্তানীদের লাশগুলো শেরপুর সড়কে পড়ে ছিল। মূলত গোর্খা বাহিনীর সদস্যরা বগুড়া শহরে মহড়া দেওয়ার পরেই বিজয়ের সূর্য বিকশিত হয়। বগুড়া হানাদার মুক্ত হয় ১৩ ডিসেম্বর। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালের এই দিনে শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় পাক হায়েনাদের পরাস্থ করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৬৪ মাউন্টেন্ট রেজিমেন্টের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংহ এই এলাকায় নেতৃত্ব দেন।