বাবু খানের জীবনে সবচেয়ে কঠিন যাত্রা
পিতার কাঁধে সবচেয়ে ভারী বোঝা- পুত্রের লাশ। সেটা বাবু খানের চাইতে ভালো আর কে বলতে পারবেন!
ভারতের উত্তরপূর্ব দিল্লির মুস্তফাবাদ এলাকার বাসিন্দা বাবু খান নিজ জীবনের সবচাইতে দীর্ঘ আর কষ্টকর যাত্রা শেষ করেছেন। একটি নয়, দুই পুত্রের লাশের ভার বহনের পিতৃদায়িত্ব পালন করেন এ হতভাগ্য পিতা।
বাবু খান পুত্রহারা হয়েছেন বিজেপি ও অন্য উগ্রপন্থী দাঙ্গাবাজদের শুরু করা চারদিন ব্যাপী দিল্লির সহিংসতা চলার সময়েই। কিন্তু ওই পরিস্থিতির মাঝে তার পুত্র হারানোর কথা জানার উপায় ছিল না।
জানতে পারেন কয়েকদিন পর। নগ্ন করে পিটিয়ে হত্যা করা দুই পুত্রের ক্ষতবিক্ষত লাশ গুরু তেগ বাহাদুর হাসপাতালের মর্গ থেকে সংগ্রহ করেন বাবু খান। এসময় চিকিৎসক তার হাতে ধরিয়ে দেন ময়নাতদন্ত রিপোর্ট।
রিপোর্টে লেখা ছিল মৃত্যুর বীভৎস বিবরণ। সবাই ভেবেছিলেন বাবু খান কান্নায় ভেঙ্গে পড়বেন, না তিনি কাঁদেননি। শুধু চিকিৎসকের দিকে শূন্য বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন।
গাড়িতে আগেও অনেকবার চড়েছেন তিনি। কিন্তু এবার অ্যাম্বুলেন্সে করে দুই পুত্রের লাশ নিয়ে ঘরে ফিরে আসলেন। পুরোটা পথ বাবু খান মাথা নিচু করে রেখেছিলেন। তবু চোখের জল পড়েনি। খবর দ্য ওয়্যার ও দ্য প্রিন্টের।
অনন্তকালের ৫ মিনিট যাত্রা
বড় পুত্র আমির খান (৩০) ও ছোট হাশিম আলী (১৯) গত ২৬ জানুয়ারি মোটরসাইকেলে করে গাজিয়াবাদ এলাকায় অসুস্থ নানীকে দেখতে গিয়েছিলেন।
মুঠোফোন কলে এই বিপদজনক পরিস্থিতিতে তাদের ঘরে ফিরে আসতে বলেছিলেন মা আসগরি বেগম। উত্তরে তারা আশ্বস্ত করে বলেছিল, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসবেন। সেই পাঁচ মিনিট এখন অনন্তকাল পুরো পরিবারের জন্য।
আমির ও হাশিমের ছোট বোন দু'জন। একজনের বয়স সাড়ে পাঁচ আরেকজনের মাত্র দুই বছর। লাশ নিয়ে ফিরে আসার পর তাদের কান্না দেখে প্রতিবেশীদের কেউ চোখের পানি চেপে রাখতে পারেননি।
নিহতদের চাচা মোহাম্মদ আজিজ বলেন, নানীর বাড়ি এলাকায় পরিস্থিতি বিপদজনক দেখে তারা সেখানেই অপেক্ষা করছিল, কিন্তু বাড়িতে সবাই দুশ্চিন্তা করছে দেখে তারা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেটাই কাল হলো তাদের জীবনে। ফিরে আসার পথে দাঙ্গাবাজদের কবলে পড়ে ওরা।
পরবর্তী সময়ে আমির আর হাশিমের নগ্ন ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া গেছে ভজনপুরার এক পয়নিস্কাশনের নালা থেকে। ওই একই ড্রেন থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১১টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
চাচা আজিজ আরও জানান, দুই সহোদরের শরীর জুড়ে ছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর নিশান। মুখ, ঘাড়, পিঠ, বুক কোনো জায়গা বাদ পড়েনি। এমনকি তাদের হাত দেখে বোঝা যায় সেগুলো পায়ের নিচে ফেলে পিষে ফেলা হচ্ছিল।
গত রোববার অনুষ্ঠিত হয় আমির ও হাশিমের জানাজা। হাজার হাজার মানুষ এই জানাজায় অংশ নেন। গোরস্থানের পথে এক এক করে দুই পুত্রের খাটিয়ায় কাঁধ লাগিয়েছিলেন বাবু খান। আর দাফনের পর কবরের দিকে নয়, তার দৃষ্টি ছিল শূন্য আকাশের দিকে।