বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন ভারতের যে ‘শাসক’
রাজা মানেই সে সম্পদশালী হবে এযেন এক চিরন্তন ধারণা, আর ইতিহাসে কিছু ব্যক্তি যেন এই ধারণাকে আরো তীব্রভাবে পরিপক্ত করে গেছেন।
ইতিহাসে কিছু ব্যক্তি ধনী ছিলেন তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের কারণে। অন্যদিকে কিছু মানুষের বিত্ত বিবেচিত হতো তাদের রাজকীয় সম্পত্তি এবং নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের উপর ভিত্তি করে- হায়দেরাবাদের শেষ নিজাম, মীর ওসমান আলী খান বাহাদুর, সপ্তম আসাফ জাহ ছিলেন দুটোই।
মীর ওসমান আলী খান, সপ্তম আসাফ জাহ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৬ সালের ৬ এপ্রিল।
ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম রাজ্য হায়দেরাবাদের সর্বশেষ নিজাম (শাসক) ছিলেন তিনি।
১৯১১ সালের ২৯ অগাস্ট মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ভারত হায়দেরাবাদ দখলের আগপর্যন্ত ১৯১১ থেকে ১৯৪৮ নাগাদ তিনিই শাসন করেছেন সমৃদ্ধ রাজ্যটিকে।
নিজেকে তিনি উপাধি নেন হায়দেরাবাদের নিজাম মহামান্য অধিপতি (হিজ এক্সলটেড হাইনেস) হিসাবে, যিনি ছিলেন সর্বকালের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। ১৯৩৭ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে টাইম ম্যাগাজিন তাকে প্রচ্ছদে তুলে ধরে।
গোলকোন্ডার প্রখ্যাত খনি ছিল নিজামদের সম্পদের প্রধান উৎস, আর হায়দেরাবাদ রাজ্য ছিল ১৮শতকে বিশ্ব বাজারে একমাত্র হীরা সরবরাহকারী।
মীর ওসমান আলী খান বাহাদুর ১৯১১ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর হায়দেরাবাদের নিজাম হিসেবে স্বীকৃতি পান। রাজ্যটি ভারতের স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসিত রাজ্যগুলির ভেতর ছিল বৃহত্তম।
এর আয়তন ছিল ৮৬,০০০ বর্গ মাইল (২২৩,০০০ কি.মি.) এলাকা জুড়ে, এর মানে মোটামুটি বর্তমান যুক্তরাজ্যের সমান আয়তন ছিল এই রাজ্যের।
নিজাম ভারতের সর্বোচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন রাজন্য ছিলেন। তার সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনির রেওয়াজ ছিল ব্রিটিশ সরকারের। মাত্র পাঁচজন যুবরাজ এই সম্মান পেতেন। তাদের মধ্যেই অন্যতম ছিলেন নিজাম। ব্রিটিশ শাসকেরা তাকে "নিজাম", "মহামান্য অধিপতি" এবং "ব্রিটিশ রাজের বিশ্বস্ত মিত্র" ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করে।
সম্পদের ঐশ্বর্যের কারণেই, ১৯৩৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওসমান আলী খান, আসাফ জাহ সপ্তমের সম্পদের পরিমাণ তৎকালে ছিল - ৬৬০ কোটি রুপি সমমূল্যের (৯৩ মিলিয়ন ডলার)।
৫৪.৯ মিলিয়ন পাউন্ডের সোনাদানা-সহ নিজামের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ১৫০.৪ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালে ২৩৬ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। ভারত সরকার এখনও প্রদর্শন করে হায়দেরাবাদের নিজামদের অলংকার সমূহ, যার ভেতর ১৭৩টি রত্ন, প্রায় ২,০০০ ক্যারেট (০.৪০ কেজি) ওজনের পান্না, এবং ৪০ হাজার চো ওজনের মুক্তা।
তার ব্যক্তিগত সংগ্রহের মধ্যে বিখ্যাত ছিল জ্যাকব ডায়মন্ড নামের একটি অন্যতম বড় হিরা।
১৯৪৭ সালে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বিয়ে উপলক্ষে নিজাম একটি টিয়ারা এবং হারসহ হীরা উপহার দেন। এসব উপহারের একটি ব্রোচ এবং নেকলেস রাণী এলিজাবেথ এখন পর্যন্ত পরিধান করেন, সেটি এখনো হায়দেরাবাদের নিজামের নেকলেস নামে পরিচিত।
তিনি সন্দেহাতীতভাবে একজন দয়ালু শাসক ছিলেন। পৃষ্ঠপোষকতা করতেন শিক্ষা ও বিজ্ঞানের উন্নয়নে।
তার ৩৭ বছরের শাসনকালে হায়দেরাবাদে চালু হয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, রেলওয়ে, আধুনিক সড়ক এবং উন্নীত করা হয় বিমানবন্দরকে।
তিনি "আধুনিক হায়দেরাবাদের স্থপতি" হিসেবে খ্যাত ছিলেন এবং রাজধানী হায়দেরাবাদ শহরের অনেক সরকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও তাকে দেওয়া হয়। এসব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে: ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওসমানিয়া জেনারেল হাসপাতাল, স্টেট ব্যাংক অফ হায়দেরাবাদ, বেগমপেট বিমানবন্দর এবং হায়দেরাবাদ হাইকোর্ট।
শহরে বন্যা প্রতিরোধের জন্য ওসমান সাগর ও হিমায়েত সাগর নামে দুটি জলাধার নির্মাণ করা হয় তার শাসনামলে ।
এমনকি সিংহাসন হারানোর পরেও তিনি জনগণকে সেবা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
১৯৫১ সালে তিনি নিজাম অর্থোপেডিক হাসপাতাল নির্মাণ শুরু করেন, যা বর্তমানে নিজাম'স ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এনআইএম) নামে পরিচিত এবং মাত্র ১ রুপি মাসিক ভাড়ার বদলে সরকারকে ৯৯ বছরের জন্য তিনি ইজারা দিয়ে দেন তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে ১৪,০০০ একর জমি।
তবে নিজের কিছু কৃপণতার জন্যেও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। বিশেষ করে, অতিথিদের কাছ থেকে ধার করে সিগারেট খাওয়া বা নিজের মোজা নিজেই সেলাই করে পড়ার গল্পগুলো লোকেমুখে ফিরত।
নিজাম মূলত ভারতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর তিনি নবগঠিত রাষ্ট্রের কাছে তার রাজ্য শাসনের ভার ছাড়তে চাননি। ততদিনে, তেলেঙ্গানা আন্দোলন এবং রাজাকার নামে পরিচিত একটি চরমপন্থী সামরিক শক্তির উত্থানের কারণে তার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, যাদেরকে তিনি দমন করতে পারেননি।
১৯৪৮ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দেরাবাদ রাজ্য আক্রমণ এবং দখল করলে নিজামকে আত্মসমর্পণ করতে হয়।
অবশ্য ১৯৫০ ও ১৯৫৬ সালে তিনি হায়দেরাবাদ রাজ্যের রাজপ্রমুখ হিসেবে নিযুক্ত হন, পরে রাজ্য-বিভক্ত হলে হায়দেরাবাদকে ভেঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং মহারাষ্ট্রের অংশ করা হয়।
নিজামের সন্তানের সংখ্যা ছিল ১৪৯ জন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজাকোঠি প্রাসাদে বসবাস করেছেন।
সেখানে তিনি তার সংবাদপত্র নিজাম গেজেটে অযৌক্তিক বিষয়ের উপর ফার্মান পেশ করতেন।
মীর ওসমান আলী খান ১৯৬৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার মৃত্যুবরণ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে মসজিদ-ই-জুডিতে সমাহিত করা হয়, এটি ছিল সেই মসজিদ যেখানে তার মাকেও সমাহিত করা হয়ছিল, যা ছিল রাজাকোঠি প্রাসাদের ঠিক মুখোমুখি।
ভারত সরকার ১৯৬৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মীর ওসমান আলী খানের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে।
সেদিন রাজ্য সরকারের দপ্তরগুলো তার সম্মানে বন্ধ ছিল এবং সকল সরকারি ভবনে ভারতের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।