ব্যক্তিউদ্যোগে বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র যশোরের ‘প্রাচ্যসংঘ’
বিশাল চত্বর জুড়ে প্রাসাদোপম 'প্রাচ্যসংঘ'। প্রথমেই বইহাট- ব্যতিক্রমী এই বইয়ের দোকান সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, লোকজীবন চর্চা, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, রবীন্দ্র ও নজরুল সংগ্রহে ঠাসা। শিশুকিশোর পাঠের আলাদা কর্ণার। মূল প্রবেশদ্বারের কাছেই বেদীর ওপরে শ্বেতশুভ্র খোলা বইয়ের মাঝে বিশ্বগোলক। নিচে লেখা, 'পড়-জগতকে জানো।'
গোলকটির ঠিক সামনের দোতলায় প্রাচ্যসংঘের নিজস্ব গ্রন্থাগার 'বুদ্ধালয়'। সুবিন্যস্ত এই সংগ্রহশালার বিশাল সংগ্রহের ধরনই বলে দেয় 'বুদ্ধালয়' সম্পৃক্তরা অধ্যয়নে-গবেষণায় কতটা প্রাণান্ত। সেখানে থাকা হাজার পাঁচেক বইয়ের বেশিরভাগই দুষ্প্রাপ্য। যে কোন গবেষকের জন্য গ্রন্থাগার উন্মুক্ত। পাঠাগারে প্রতিদিন জ্ঞান পিপাসুরা হাজির হন। শুধু গেল দু'বছরেই এমফিল কিংবা পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের জন্য গবেষণারত অন্তত ৫০ জন সহায়তা নিয়েছেন এ গ্রন্থাগারের।
গ্রন্থাগারটি ছাড়াও দোতলা জুড়ে সুসজ্জিত আধুনিক আর্ট গ্যালারী ও সেমিনার হল। নিচতলায় আলাদা আলাদা পাঁচটি প্রশিক্ষণ কক্ষে বসে পাঠচক্র, গান-কবিতা-নাট্য-আর্ট প্রশিক্ষণ কর্মশালা। আড্ডার জন্য রয়েছে পাঁচটি আশ্রয় কেন্দ্র : সুলতান আশ্রয়, লালন আশ্রয়, জসিম উদ্দিন আশ্রয়, বেগম রোকেয়া আশ্রয় ও আবুল হুসেন আশ্রয়। সবশেষে ভাসানী মঞ্চ । আলোচনা, কবিতা, গান, নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে উন্মুক্ত এ মঞ্চে । আড্ডায় আসা মানুষের গলা ভেজাবার সুযোগ দিতে আছে ছোট্ট ক্যাফেটারিয়াও। বিকেল হতেই আশ্রয়গুলোতে জড়ো হয় স্বাধীনচেতা স্বাপ্নিক মানুষের দল। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-যুবক, ধনী-গরিব সব শ্রেণি-পেশার মানুষের রয়েছে এ স্বপ্ন জাগানিয়ায় অবাধ যাতায়াত। এখানকার আড্ডা-আয়োজন চলে রাত অবধি। নিয়মিত আড্ডায় যোগ দেন লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, রাজনীতিক, গবেষকসহ বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অফিস টাইমের পর জ্ঞানপিপাসু সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেও আসেন নিজস্ব চিন্তা চেতনার খোলা জানালায় মুক্ত বাতাসের স্বাদ নিতে।
যশোর সার্কিট হাউজপাড়ায় নিজ বাসভবন ঘেঁষে প্রায় দু'বিঘা জমিতে ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্যক্তিউদ্যোগে বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চা প্রতিষ্ঠান 'প্রাচ্যসংঘ' প্রতিষ্ঠা করেন লেখক-গবেষক বেনজীন খান। তিনি ছাত্রজীবন থেকে সম্পৃক্ত ছিলেন শ্রেণী সংগ্রামের রাজনীতিতে। জানতেন, সমাজে একটাই দ্বন্দ্ব- শাষক আর শোষিত। কিন্তু সময়ের সাথে বদলেছে তার চিন্তা ও সমাজ বিশ্লেষণ। এখন বিশ্বাস করেন, বর্তমান বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত: প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য (ওয়েস্টার্ন)। সেই দ্বন্দ্বে প্রাচ্য সংস্কৃতিকে জয়ী করতেই গড়ে তোলেন এই সংঘ। প্রাচ্যের ইতিহাস, ঐতিহ্য, দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি তথা জীবনবোধ অনুসন্ধান ও তা মানব সমাজের সামনে উপস্থাপনই প্রাচ্যসংঘের উদ্দেশ্য।
প্রতিষ্ঠানটির গোড়াপত্তন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বেনজীন খান জানান, 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০০৬ সালে 'আবুল হুসেন রাষ্ট্রসভা' নামে একটি পাঠচক্র গঠন করে শুরু করেন জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র, শিল্পের নানামাত্রিক পাঠ ও চর্চা। শিল্পচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে স্বপ্ন আরও বড় করে কয়েক বছরের মাথায় প্রাচ্যসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এখন এই সংঘের অধীনে বিভিন্ন শাখায় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সুর সংঘ, নাট্য সংঘ, সাহিত্য সংঘ, চলচ্চিত্র সংঘ, চারুকলা সংঘ প্রভৃতি নামে শাখাগুলো পরিচিত। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মাত্র আটবছরে এই সংগঠনের কার্যক্রম শুধু যশোর নয়; ব্যাপ্তি ঘটিয়েছে দু'বাংলার শিল্পরসিকদের মাঝে।
প্রাচ্যসংঘের প্রতিষ্ঠাতা বেনজীন খান নিজেসৃজনশীল গ্রন্থ প্রণেতাও। দু'বাংলা মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১২টি গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে তার। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছেন 'এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ : আবিশ্ব বিবেকের কণ্ঠস্বর' এবং 'বুদ্ধির মুক্তি শিখা ও আবুল হুসেন' গ্রন্থ দুটো।
রাজনীতি আর জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন সফল শিল্প উদ্যোক্তা। সবকিছু ছেড়ে আর্থিক অলাভজনক বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চার এই প্রতিষ্ঠানটি গড়তে গিয়ে তিনি নিজের ২৯ শতক জমি বিক্রি করা ছাড়াও জড়িয়েছেন ব্যাংক ঋণের জালে। বসতবাড়ি বন্ধক রেখে নিতে হয়েছে ঋণ। এমনকি সরকারি চাকুরে স্ত্রী'র অবসরকালীন পাওয়া এককালীন টাকার পুরোটা খরচ করেছেন এর পেছনে। সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রাচ্যসংঘের প্রতিষ্ঠা ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় কোটি টাকা।
কিন্তু এ নিয়ে মোটেও দুশ্চিন্তা নেই বেনজীনের। প্রাচ্যসংঘকে ঘিরে সংস্কৃতি চর্চায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। এতেই খুশি তিনি। পাশ্চাত্য সারা পৃথিবীতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের মতো করে ইতিহাস লিখিয়েছে। অথচ তাদের চেয়ে প্রাচ্য সংস্কৃতির ইতিহাস অনেক পুরনো এবং সমৃদ্ধ। সেই ইতিহাস পাঠ না করে আমরা অজ্ঞতার মধ্যে রয়েছি। আর সমাজ থেকে এই অজ্ঞতা দূর করতে পারলেই মিলবে খুশির পূর্ণতা।
বেনজীন খানের সংস্কৃতিমনা সহধর্মিনী শিশু অ্যাকাডেমির সাবেক কর্মকর্তা সুলতানা ফরিদা বারী বলেন, 'নিজে শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করার কাজ করেছি। বেনজীনেরও সবসময়ের চেষ্টা মানুষকে জ্ঞাননির্ভর করে গড়ে তোলা। দু'জনের চিন্তার এই মিলের কারণেই প্রথম থেকে ওর পাশে থেকেছি। জীবনের সর্বশেষ উপার্জনটাও এমন মহৎকাজে ব্যয় করতে পেরে আমি তৃপ্ত।'
প্রাচ্যসংঘের আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর বিভিন্ন সময় এখানে ঘুরে গেছেন দুই বাংলার খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা। সবচেয়ে বেশি এসেছেন সব্যসাচী লেখক-কবি সৈয়দ শামসুল হক ও আনোয়ারা সৈয়দ হক। প্রথমবার এসে বিস্মিত হন সৈয়দ শামসুল হক। বলেছিলেন, 'ঢাকার বাইরে বইয়ের দু'একটা বড় লাইব্রেরি থাকতে পারে। কিন্তু জ্ঞানচর্চার এমন পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস বিরল, যেখানে শিল্পকলার সব শাখার কার্যক্রম আধুনিকতার ছোঁয়ায় চলমান।'
এছাড়া বিভিন্ন সময় এসেছেন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, অধ্যাপক ড. আনু মুহম্মদ, নৃবিজ্ঞানী-লেখক রেহনুমা আহমেদ, লেখক ডা. পিনাকী ভট্টাচার্য, ভারতের কবি অমল বসু, ভাস্কর্যশিল্পী মৃণাল চক্রবর্তী প্রমুখ গুণীজনেরা।
দুই বাংলার ছোটদের ম্যাগাজিন নিয়ে নবীন এই প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় ২০১৭ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় লিটল ম্যাগাজিন মেলা। আর্ট গ্যালারিতে হয়েছে দু'দেশের শিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে যৌথ প্রদর্শনী। বইমেলাও হয় নিয়মিত।
এককথায় যশোরের শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে প্রাচ্যসংঘ- স্থানীয়দের মন্তব্য এ রকমই।
কবি-গবেষক মহিউদ্দিন মোহাম্মদ বলেন, প্রতিষ্ঠানটি যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বন্ধ্যাত্ব ঘোচানোর পাশাপাশি প্রাচ্য সংস্কৃতি যে সমৃদ্ধ সেটা তুলে ধরছে। তাদের এ উদ্যোগ জ্ঞানপিপাসু-উৎসাহী মানুষদেরকে জ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
প্রাচ্য সংঘের সাধারণ সম্পাদক মাসউদ জামান বলেন, 'শিল্পকে জীবনঘনিষ্ঠ করতে চাই। বেনজীন খানের প্রাচ্যসংঘ আমাকে সেই সুযোগ নিশ্চিত করেছে। সে কারণেই নিজ তাগিদে আমার মত অনেকেই যুক্ত হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে।'