মহামারিকালেও বিশ্বময় চষে বেড়িয়েছেন যে পর্যটক
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েক বছর চাকরি করার পর উদীয়মান আলোকচিত্রী টমাস রোমজাক ভাবলেন, যথেষ্ট হয়েছে! আর নয় গৎবাঁধা চাকরি কিংবা ৯-৫ কাজের হ্যাপা। এবার সবকিছু ছেড়ে প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া যাক।
যেই ভাবা, সেই কাজ। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বহুদিনের পুষে রাখা স্বপ্ন পূরণে বেরিয়ে পড়লেন স্লোভাকিয়ার কোসিকের বাসিন্দা রোমজাক।
ঘর ছাড়ার সময় একটা রাউন্ড-ওয়ার্ল্ড টিকিট কিনেছিলেন রোমজাক। সেই টিকিটে নিউজিল্যান্ড, লস অ্যাঞ্জেলেস, কলম্বিয়া, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বলিভিয়া এবং জার্মানিসহ একাধিক দেশে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ ছিল তার। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নিজের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন এই আলোকচিত্রী।
কিন্তু বিধি বাম! ভ্রমণ শুরু করার মাত্র কয়েক মাস পরেই পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস; কড়া লকডাউন দেওয়া হয় এবং বন্ধ হয়ে যায় অনেক দেশের সীমান্ত। কোভিডের বেড়াজালে পড়ে যেখানে দুই সপ্তাহ কাটাবেন ভেবেছিলেন, সেখানে ছয় মাস কাটাতে হয়েছে রোমজাককে। শুধু তাই নয়, ভ্রমণের কিছু আলাদা আলাদা পরিকল্পনাও বাদ দিতে হয়েছে তাকে।
এ পরিস্থিতিতে অন্যান্য ভ্রমণপ্রেমী হলে হয়তো সবকিছু গুটিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ারই আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু রোমজাক তা করেননি। ধৈর্য ধরে ছিলেন তিনি। অবশেষে গত মাসে পথেঘাটে জীবন কাটানোর দুই বছর পূর্ণ করলেন রোমজাক!
কোভিড পরিস্থিতিতে আটকে থেকে হতাশার বদলে নিজেকে ভাগ্যবানই মনে করেন রোমজাক। কারণ এই দুই বছর তিনি পৃথিবীর এমন কিছু সুন্দর জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছেন, যা হয়তো অন্য কোনো ব্যাকপ্যাকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
"আমি পৃথিবীকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি। আমার কাছে, ভ্রমণ মানে অভিজ্ঞতা অর্জন ও নতুন কিছু শেখা", বলেন রোমজাক।
সুবর্ণ সুযোগ!
ভ্রমণের সুযোগ তো কমবেশি অনেকেরই হয়ে থাকে। কিন্তু রোমজাকের প্রশ্ন, সেই সুযোগ কি সবসময় সহজ ও সুবিধাজনকই হতে হবে?
রোমজাকের ভ্রমণকাব্যের শুরুটা বেশ সাদাসিধেভাবে হয়েছিল। এশিয়া মহাদেশ দিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি। 'চীনই কোভিড-১৯ এর উৎস', এমন জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়ার আগেই তিনি ঘুরে ফেলেন সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, লাওস ও মিয়ানমারের মতো দেশগুলো।
"যখন আমি প্রথম কোভিডের নাম শুনি, তখন সম্ভবত মিয়ানমারে ছিলাম। আমাকে স্বীকার করতেই হবে, তখন এটাকে তেমন গুরুত্ব দেইনি আমি", বললেন ইনস্টাগ্রামে নিজের ট্রাভেল ডকুমেন্টারি বানাতে থাকা রোমজাক।
আশেপাশের আরও কিছু ব্যাকপ্যাকার ঘোরাঘুরি থামিয়ে দিচ্ছেন দেখেও রোমজাক হাল ছাড়েননি। কারণ সারাজীবন তিনি এই সময়টার স্বপ্নই দেখে এসেছেন এবং ঐ সময় তার ভ্রমণের মাত্র তৃতীয় মাস চলছিল!
দেখাই যাক পরিস্থিতি কতদূর এগোয়- এমন মনোভাব নিয়েই ২০২০ সালের মার্চে পলিনেশিয়ার দেশ, টোঙ্গাতে উড়ে যান রোমজাক। উদ্দেশ্য ছিল, ১৫ দিন সময় কাটাবেন সেখানে। কিন্তু তিনি পৌঁছানোর পরপরই দ্বীপরাষ্ট্রটির সীমান্ত বন্ধ হয়ে যায় এবং ২২২ দিনের জন্য সেখানে আটকা পড়েন তিনি!
তবে নিজ দেশ স্লোভাকিয়াতে কোভিড-বিধিনিষেধ যে আরও তিনগুণ কঠোর, তা জানতে পেরে টোঙ্গাতেই খুশিমনে দিন কাটিয়েছেন রোমজাক। কারণ একই মাসে স্লোভাকিয়ায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। অন্যদিকে মহামারিকালে পৃথিবীর হাতেগোনা যে কয়টি অঞ্চল কোভিডমুক্ত ছিল, তারই একটি হলো টোঙ্গা। তাই কোভিড আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও ছিলনা তার।
রোমজাকের ভাষ্যে, "অনেকেই বলে, টোঙ্গাতে দু-চারদিন কাটানোই যথেষ্ট। কিন্তু আমার মনে হয়, এখানে এমন অনেক কিছু আবিষ্কার ও অভিজ্ঞতা নেওয়ার আছে যা দেখতে গেলে কয়েক মাস লেগে যাবে।"
তাছাড়া, ৩৪ বছর বয়সী রোমজাককে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার আগের বুক করে রাখা সকল ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে।
চ্যালেঞ্জিং সময়
২০২০ সালের অক্টোবরে মেক্সিকোতে কোভিড-বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা হয়। তাই বেশ কয়েক মাস টোঙ্গাতে কাটানোর পর মেক্সিকোর দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন রোমজাক।
ভ্রমণের প্রতি যদি নেশা থাকে তাহলে রোমজাকের মতোই হওয়া উচিত! কারণ এরপর নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন ইকুয়েডর, চিলি, পেরু ও পানামাতে। রোমজাক বলেন, "সবকিছু মোটামুটি ভালোই চলছিল। তখন আসলে আমি কোথায় যেতে চাই, তা মুখ্য ছিলনা। কোথায় যেতে পারবো, তাই ছিল মুখ্য।"
অবশ্য মহামারিকালে ভ্রমণ করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি লকডাউন ও কোয়ারেন্টিন পার করতে হয়েছে রোমজাককে। বিশেষত, চিলিতে প্রবেশের পর ১০ দিনের কোয়ারেন্টিন পালন করাটাই সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে তার কাছে!
শুধু তাই নয়, চিলিতে দুই মাস কাটানোর সময় অন্য কোন বিদেশি ভ্রমণকারীর সাথে সাক্ষাৎ হয়নি রোমজাকের! "কেউ কেউ বিশ্বাসই করতে পারতো না যে আমি একজন পর্যটক এবং এই পরিস্থিতিতেও ঘুরতে এসেছি। চিলিতে নানা বিধিনিষেধের কারণে এটাই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং জায়গা ছিল ভ্রমণের", বলেন এই স্লোভাকিয়ান নাগরিক।
মহামারির আগের এবং মহামারিকালে ভ্রমণের মধ্যে নাটকীয় পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন রোমজাক। এর একটি কারণ হলো, মহামারির আগে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্রচুর ভিড় থাকতো। কিন্তু মহামারিকালে এক প্রকার নির্জনতা খুঁজে পেয়েছেন তিনি। তাছাড়া, কোনো কোনো ব্যাকপ্যাকারের কাছে নতুন জায়গায় ভ্রমণ, মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া তাদের অ্যাডভেঞ্চারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য পর্যটকদের সাথে দেখা হয়েছে রোমজাকের। কিন্তু তিনি এমন কাউকে পাননি, যিনি মহামারির আগে থেকেই ঘুরতে এসেছিলেন।
সাদর অভ্যর্থনা
মহামারিকালে পর্যটকের অভাবে পর্যটন কেন্দ্র এবং এই খাতের সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলো কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে তা লক্ষ্য করা সত্ত্বেও, ভ্রমণ করতে গিয়ে বেশ সমাদর ও উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন রোমজাক।
তার ভাষ্যে, "অনেক জায়গায়ই স্থানীয়রা বিদেশি পর্যটকদের পেলে খুশি হয়। তারা সত্যিই আমাদের সাথে কথা বলতে ভালোবাসে এবং মন থেকে প্রশ্ন করে।"
কিন্তু রোমজাক মহামারির আগের সময়ের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করিয়ে দিলেন, "অনেক জায়গায়ই চিত্রটা ভিন্ন। বিশেষত, এশিয়ায় সাধারণ মানুষ পর্যটকদের উপর বিরক্ত। এর কারণটাও আমি জানি।
ভিয়েতনামে আমি দেখেছি পর্যটকরা ভাবে, তারা যা খুশি করতে পারে। তারা স্থানীয়দের বা তাদের সংস্কৃতিকে সম্মান করে না। আমি এমন কিছু স্থানে গিয়েছি যেখানে মাত্রাতিরিক্ত পর্যটকের ভিড় এবং তাদের আচরণের কারণে আমি ওই সময়টা উপভোগ করতে পারিনি।"
পর্যটকদের এহেন আচরণে বেশ বিরক্ত রোমজাক। তিনি আরও বলেন, "মানুষ আমার এই কথাগুলো পছন্দ করবে না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, অনেকেরই একমাত্র কাজ শুধু স্পটে গিয়ে সেলফি নেয়া, আর কিছুই নয়। আশেপাশের মানুষ বা অন্যকিছুকে তারা পাত্তাই দেয় না।"
কিন্তু রোমজাক মোটেও সেই দলের নন। তার কাছে একটি স্থানে গিয়ে সে সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা অর্জন জরুরি। তাই মহামারিকালে পেরু ও কম্বোডিয়ায় জনকোলাহল ছাড়াই তিনি ঘুরে বেড়াতে পেরেছেন।
রোমজাক মনে করেন, মহামারিকালে ভ্রমণ করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু পর্যটন সম্পর্কিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পেরে তিনি খুশি।
নতুন পরিবেশ
করোনাভাইরাসের প্রকোপ কিছুটা কমতে থাকায় এবং টিকাদান কর্মসূচীর ফলে বিশ্বের অনেক দেশই এখন কোভিড-বিধিনিষেধ শিথিল করেছে। কিন্তু দুই বছর যাবত পথেঘাটেই দিন কাটানোয়, এখনও ভ্যাকসিন নিতে পারেননি রোমজাক। ফলে, নতুন করে অনেক জায়গায় ভ্রমণ করতে পারছেন না তিনি।
তাই আসছে ক্রিসমাসেই পরিবারের কাছে ফিরে আসতে এবং ভ্যাকসিন নিতে ইচ্ছুক রোমজাক। তবে আপনজনের সান্নিধ্যে আসার কথা জানালেও, স্লোভাকিয়ায় বেশিদিন থাকার কোনো ইচ্ছাই নেই এই আলোকচিত্রীর।
কারণ ভ্রমণ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এরই মধ্যে ভিন্ন এক জীবনের স্বাদ পেয়ে গেছেন রোমজাক। এই ফড়িংয়ের, দোয়েলের জীবন থেকে তিনি ফিরতে নারাজ! তিনি চান সমস্ত পৃথিবী ঘুরে দেখতে, সব অঞ্চলের মানুষ, সংস্কৃতি ও আদিবাসীদের সাথে কথা বলতে; স্মৃতির ভান্ডারে অসংখ্য মুহূর্ত জমা করতে।
- সূত্র: সিএনএন