শিল্পকর্মে বৈরুত বিস্ফোরণ
৪ আগস্ট প্রলয়ঙ্করী এক বিস্ফোরণে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে লেবাননের রাজধানী বৈরুত। ঐতিহাসিক ওই শহরজুড়ে নানা জিনিসপত্রের পাশাপাশি খড়কুটোর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে মানুষের মৃত ও মারাত্মক আহত দেহও।
বিস্ফোরণের সেই মর্মান্তিক মুহূর্ত শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তুলেছেন কিছু শিল্পী। তেমনই পাঁচটি ছবি নিয়ে এ আয়োজন।
যে নারীর আশা উবে গেছে
২০ বছর বয়সী নূর হালাবি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। সপ্তদশ শতকের ফরাসি পেইন্টার লুই-জ্যঁ ফ্রাঁসোয়া লাগরেনির বিখ্যাত পেইন্টিং 'লা মেলানকোলি'র একটি কম্পোজিশন নতুন ও পুরাতনের সংমিশ্রণে তিনি তৈরি করেছেন। সেখানে বিস্ফোরণ থেকে ছড়িয়ে পড়া লাল অগ্নিশিখা জ্বলজ্বল করছে।
'লা মেলানকোলি বেছে নেওয়ার কারণ, (ছবির) মেয়েটির অভিব্যক্তি ও অঙ্গভঙ্গির মধ্যে ব্যাপক বেদনা ফুটে রয়েছে। তার শারীরিক ভাষায় ফুটে রয়েছে বিষাদগ্রস্ত এক নারী, যে নারীর সব আশা উবে গেছে,' বলেন নূর।
'এই যে আশার অভাব- এটাই এখন লেবাননের সার্বিক মেজাজ। ওই বিস্ফোরণ শুধু সব আশা নিংড়েই নেয়নি, বরং আমাদের একদম বিধ্বস্ত করে রেখে গেছে।'
ধ্বংসস্তূপ থেকে জাগরণ
সৌদি নাগরিক, ২৭ বছর বয়সী মুগারবেল পেশায় ডিজাইনার। তিনি তার আঁকা ছবিতে প্রখ্যাত সিরিয়ান কবি নিজার কাব্বানির কবিতার পঙক্তি- 'ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠো' ব্যবহার করেছেন। বলে রাখা ভালো, ওই কবিতা থেকে গান গেয়েছেন লেবানিজ গায়িকা মাজিদা আল রুমি। তাই এই পঙক্তি লেবাননের নাগরিকদের খুব চেনা।
মুগারবেল বলেন, এই পঙক্তিতে ছড়িয়ে রয়েছে লেবাননের নাগরিকদের জন্য এক সময়োপযোগী বার্তা।
'বৈরুত শহরেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা আমার। এর অলিগলিতে ছড়িয়ে রয়েছে যত স্মৃতি। বৈরুত থেকে, এ শহরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না,' বলেন মুগারবেল। 'বৈরুত সাতবার ধ্বংস হয়েছিল- এই গল্প শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। এবার এই অষ্টম ধ্বংসটিই বাস্তবিক ও আবেগিকভাবে সবচেয়ে বিধ্বংসী। তবু আমরা হাল ছাড়ব না। আমাদের বিপ্লবের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমাদের ভালোবাসার বৈরুতকে নিয়ে আশা করা কারও থামানো উচিত নয়।'
পাশে থাকা
২৯ বছর বয়সী নূরী ফ্লায়হান একজন ইলাস্ট্রেটর। তরুণীদের সাইকেডেলিক ইমেজ নিয়ে কাজ করার জন্য তিনি বেশ পরিচিত। এই শিল্পকর্মে এই আমেরিকান-লেবানিজ শিল্পী লেবাননে নিজের শৈশবের গ্রীষ্মকালীন দিনগুলো থেকে প্রেরণা নিয়েছেন। ছবিতে তিনি লিখে দিয়েছেন, 'আমি জানি তুমি ভালো নেই। কিন্তু চেয়ে দেখো, আমরা সবাই এখানে রয়েছি, তোমাকে সাহায্য করতে' এবং 'নিজেকে আবারও গড়ে তুলতে তোমার পাশে থাকব আমরা।'
ইতোমধ্যেই লেবাননের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিভিন্ন দাতব্য কর্মসূচিতে নিজের শিল্পকর্ম নিয়ে হাজির হচ্ছেন ফ্লায়হান।
এক সুতোয় বাস্তবতা
পেশায় ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট টনি মালুফের বয়স ৩৫। এই কার্টুন ও ফটো কোলাজে তিনি একটি আধুনিক ও অকৃত্রিম তরিকায় লেবাননের ঋদ্ধ সাংস্কৃতিক পটভূমি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
'আমি প্রাত্যহিক জীবনের স্কেচ এঁকেছি এবং তার সঙ্গে ফটোগ্রাফির মিশ্রণ করেছি বাস্তবতাকে এক সুতোয় বেঁধে নিতে', বলেন তিনি।
মালুফ বলেন, 'সব লেবানিজের মতো আমি এখনো ক্ষোভ, বেদনা ও অবিশ্বাস নিয়ে ৪ আগস্টের ওই ধাক্কা সামলে উঠতে পারিনি।'
সৌন্দর্যের শহরে
৪১ বছর বয়সী কার্টুনিস্ট ওমর আবদালাতের মতে, আরব সংগীত দুনিয়ায় ৮৪ বছর বয়সী লেবানিজ গায়িকা ফাইরুজের মেধার সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। তাই তার মুখ ব্যবহার করেই এই কার্টুন এঁকেছেন ওমর।
"যখনই 'লেবানন'-দুনিয়া শব্দগুচ্ছ শুনি, মুহূর্তেই ফাইরুজের মুখ মনে পড়ে যায় আমার। বৈরুত হলো সংস্কৃতির শহর; আর ফাইরুজ হলেন লেবাননের যেকোনো সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। এই দেশটির মতো তিনিও সুন্দর; আর তা যেকোনো পরিস্থিতিতেই। সৌন্দর্যের শহর বৈরুতের এই (বিস্ফোরণ বিধ্বস্ত) চেহারা আমার সহ্য হচ্ছে না," বলেন ওমর।
'যারা এই ঘটনার জন্য দায়ী, এই ট্রাজেডি যদি তাদের বোধশক্তি জাগিয়ে তুলত, খুব ভালো হতো। আমি জানি, শুধু বৈরুতের মানুষের পক্ষেই এই ক্ষত সারিয়ে তোলা সম্ভব।'
- সূত্র: দ্য ন্যাশনাল [সংযুক্ত আরব আমিরাত]