হাশিস বা গাঁজা চাষই যে গ্রামের একমাত্র জীবিকা
খরাপ্রবণ আবহাওয়া, সামান্য পানির ব্যবহার এবং কীটনাশক ও অন্যান্য খরচের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে লেবাননে বেকা উপত্যকার কোল জুড়ে অবৈধভাবে গাঁজার চাষ হয়ে আসছে বছরের পর বছর। পাথুরে মাটি সম্পন্ন এ অঞ্চলের গ্রামগুলোর সর্বত্রই গাঁজা জন্মে।
বিস্তৃত মাঠ কিংবা সেনাবাহিনীর চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে যাওয়া রাস্তার দু'ধার- সবখানে দেখা মেলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এ উদ্ভিদের। কখনো উঠানের আগাছায় জড়িয়ে থাকে আবার কখনো রঙবেরঙা ফুলের কলির ভেতর এমনভাবে মিশে থাকে যে আলাদাভাবে চেনাই কঠিন! মাদক চাষ, দারিদ্রতা, ধর্মীয় বিধিনিষেধ এবং অত্যাশ্চার্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবকিছুর সংমিশ্রণ যেন বেকা উপত্যকার ইয়ামানেহকে চিত্রোপম গ্রামে রূপ দিয়েছে।
জাতিসংঘের মতে, মরক্কো এবং আফগানিস্তানের পরে লেবানন বিশ্বের তৃতীয় গাঁজা সরবরাহকারী দেশ। তবে লেবাননের আর্থিক সংকট এবার থাবা বসিয়েছে গাঁজা বা হাশিসের উৎপাদনের ওপরে।
গতবছর রাজধানী বৈরুতের এক মসজিদের আঙিনায় গাঁজা চাষ নিয়ে কী কম হইচই হলো! তাছাড়া লেবাননের রাজনৈতিক দলগুলো এবং প্রভাবশালী জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সদস্যরা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ধর্মীয় কারণে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ করতে চেয়েছেন অনেক আগে থেকেই।
ইয়ামানেহের মোক্তার বা গ্রামপ্রধান জামাল ক্রাইফের কাছে এই গাঁজা হলো 'আশীর্বাদী গুল্ম'।
"এর মধ্যে নির্ঘাত কোন পবিত্রতা আছে। স্রষ্টা তাই নিজ থেকে একে আমাদের অঞ্চলে ফলান।"
দুই দশক ধরে হাশিসের চাষ করে আসা জামাল এবারই প্রথম এর পরিবর্তে আপেল চাষ করবেন বলে জানিয়েছেন। একের পর এক ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা এবং দেশের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় হাশিসের মুনাফায় ধসের কথা ভেবেই তাঁর এমন সিদ্ধান্ত।
লেবানিজ পাউন্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে তার মানের ৮০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আর এর সবচাইতে বড় প্রভাবটি কৃষির ওপরেই ঘনিয়েছে। একদিকে আমদানিকৃত জ্বালানী এবং সারের দাম বাড়তি আবার স্থানীয় বাজারে কৃষকেরা বিক্রির লভ্যাংশ তুলতে পারছেন না। মাদকের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রান্তিক কৃষকদের ক্ষতির পাশাপাশি সিরিয়ার যুদ্ধ চোরাকারবারি পথের সীমারেখা বদলে মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্যও বিদেশের বাজারে পৌছানো শক্ত করে তুলেছে। যার সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিকভাবে হাশিসের চালানের ওপর।
ইয়ামানেহে গ্রামের বাসিন্দারা তাদের জীবদ্দশায় যতখানি পেছনে ফিরে তাকাতে পারেন , তাদের কাছে গাঁজা রোপণ, আগাছা কাটা ও ফসল সংগ্রহের বার্ষিক চক্রটিই চোখে ভেসে ওঠে। এই গাঁজা চাষই গ্রামের মানুষকে বছরের পর বছর চরম দারিদ্রতার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে । আপেল, আলুর মত বৈধ উপায়ে অর্জিত ফসল পারেনি তাদের স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে। ঘরবাড়ি নির্মাণ, যাতায়াতের জন্য মালগাড়ি বা ট্রাক ক্রয় , ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ সব কিছুর উৎস হয়ে থেকেছে এই গাঁজা চাষ।
কিন্তু সমস্যাসংকুল লেবাননে বর্তমানে হাশিসের চালান থেকে আয় এতটাই কমে এসেছে যে, খোদ কৃষকেরা এর উৎপাদনে অনিচ্ছা পোষণ করছে।
"সবটাই শেষ", এখন হাশিস চাষ নিছক শখে দাঁড়িয়েছে", আফসোস ঝরে পড়ে মি. ক্রাইফের মুখে।
উচ্চমাত্রার টিএইচসি (টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল-যা উত্তেজনা সৃষ্টির অন্যতম মূল উপাদান হিসেবে পরীক্ষিত) সম্পন্ন হওয়ায় হাশিস উৎপাদন, সংগ্রহ করে রাখা এবং বিক্রয় লেবাননে সব সময় অবৈধ। কিছুদিন আগে লেবানিজ সরকার স্বাস্থ্যগত উদ্দেশ্যে এবং চিকিৎসার কাজে গাঁজা চাষের বৈধকরণে আইন পাস করে। তবে আইনটি কার্যকর করে তুলতে এখনো কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।
অবৈধ গাঁজা চাষে কৃষকদের ঝুঁকি সবসময়ই ছিল বেকায়। তবু তাঁরা গাঁজার চাষ করে গেছেন, সময়ে ফসল ঘরে তুলেছেন, বিক্রি করে লাভও তুলেছেন। বিভিন্ন সময় সেনা অভিযান এবং মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের প্রচেষ্টাও যা করতে পারেনি এখন বেকা উপত্যকায় সেটিই হতে চলেছে- কৃষক সম্প্রদায় নিজ থেকেই গাঁজার উৎপাদন কমানোর দিকে ঝুঁকছে!
আগে যেখানে বিশ্ববাজারে রফতানিতে কেজিপ্রতি হাশিসের চালানের দাম ৫০০ হতে ৮০০ ডলারে ওঠানামা করত, এ বছর সেটির দর কেজিতে ১০০ ডলার করে কমে গেছে।
"পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে সামনে থেকে আমরা রোপণই করবো না", নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষক এভাবেই গাঁজা চাষে নিজের অনাগ্রহের কথা বলেন।
আবার মুদ্রার বিপরীত চিত্রও আছে। অনেকেই ঐতিহ্য রক্ষার্থে এ চাষ ত্যাগ করতে পারবেন না কখনো।
"এর ভিতরেই আমাদের জন্ম; যদি এখানে কোনও হাশিস না থাকত তবে আপনি এ গ্রামে একটি বাড়িও দেখতে পেতেন না," শটগান তাক করে মাথার ওপরের পাখির ঝাঁককে তাড়িয়ে দিতে দিতে বলে ওঠেন এক জমির মালিক।
পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই বেকা উপত্যকায় ৫০০০ হাজারের অধিক নাগরিক শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের। প্রায় প্রত্যেকের পদবী এক, ক্রাইফ (Chraif)। পাশাপাশি জীবিকার সন্ধানে এবং যুদ্ধের হঠকারিতা থেকে বাঁচতে প্রায় ১২০০ এর অধিক সিরিয় নাগরিক আশ্রিত আছে এ অঞ্চলে। এসব সিরিয়ান উদ্বাস্তুর অনেকেও নেমে গেছে গাঁজার চাষে। বেশির ভাগই শিশু, করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিদ্যালয়ে ছুটি থাকায় তাদের সময় কেটে যাচ্ছে মাঠে।
"এ উদ্ভিদ সহজে রোগাক্রান্ত হয় না। পোকায় কাটেনা। জলের অভাব একে প্রভাবিত করেনা। চারা রোপণ করলে ফসল উৎপাদন নিশ্চিত বিধায় কৃষকেরা গাঁজা চাষে এত উৎসাহী," বলেন গ্রাম পরিষদের নির্বাচিত প্রধান মেয়র তালাল ক্রাইফ।
বিদেশী অর্থায়নে সরকার কর্তৃক গাঁজার ক্ষেত বিনষ্টের পুরনো দিনগুলোর কথা টেনে তিনি জানান, চরম দারিদ্র ও প্রতিকূল আবহাওয়া সম্পন্ন এ এলাকায় মানুষ নিষিদ্ধ চাষের মধ্য দিয়েই খেয়ে পরে বেঁচে আছে। একটা সময় সে অনুধাবন থেকে সরকারী বাহিনী সব দেখেও তাই কখনো বিরূপ ব্যবস্থা নেয়নি। গাঁজার পরিবর্তে সূর্যমুখী ও জাফরান চাষের প্রয়াস নেয়া হয়েছিল, কিন্তু এ পাথুরে জমিতে সেটিতে সাফল্য আসেনি।
দুই বছর আগে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনজে পরামর্শ দেয় গাঁজা চাষ বৈধ করে দেয়ার।
"আমাদের উৎপাদিত হাশিস বিশ্বে সেরা", লেবাননের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী রাঈদ খাউরিও ধারণা করেন, গাঁজা চাষ বৈধতা পেয়ে গেলে লেবাননের জন্য বিলিয়ন ডলারের শিল্পের সম্ভাবনা তৈরী হবে।
- সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস