১৩ মিনিটেই ১৩ কিলোমিটার!
সকাল ঠিক সাড়ে ৯টা। রেডি হয়ে অফিসের গাড়িতে পা দিলাম। গন্তব্য অফিস, ইস্কাটন গার্ডেনের সুইড ভবন, 'দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'-এর কার্যালয়। গাড়ি চলা শুরু করলো...
বুড়িগঙ্গা পাড়ের কেরাণীগঞ্জের চরওয়াশপুর থেকে চোখের পলকেই উঠে গেলাম বুদ্ধিজীবী সেতুতে (বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর)। সেতুতে উঠার মুখে সড়কের দু'পাশে সারি সারি দোকান- মুদি, চা-বিস্কিটের। আছে একটা রেস্টুরেন্টও। অন্যদিন এসব দোকানে, রেস্টুরেন্টে সকাল থেকেই ক্রেতা- ভোক্তাদের ভিড় লেগে যায়। আজ সবই তালা ঝুলানো..
কেবল একটা ছোট ফার্মেসির মালিক মাস্ক, গ্লাভস পরে দোকানের শাটার খুলছেন। সবই দেখা গাড়ি থেকেই, চোখের পলকে।
সেতুতে উঠে কেমন যেন গা ছমছম করে উঠলো, 'কোথাও কেউ নেই'... কেবল আমরাই ছুটে চলেছি। সামনে সাবধানী চোখ রেখে ড্রাইভার মিরাজ বলে ওঠে,"স্যার, এমন ঢাকা আগে কখনও দেখিনি। আপনি তো মধ্যবয়সী, আপনি দেখেছেন?"
মুখ গম্ভীর করে বলে উঠি, ৩৪ বছরের ঢাকার জীবনে কারফিউ ছাড়া এমন নগর আমারও দেখা হয়নি।
সেতু পার হয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রবেশদ্বার বসিলায় ঢুকেই চোখে পড়লো আরও নীরবতা। অন্যদিনগুলোতে এই সড়কের বাঁ পাশে স্টিলের দোকানের সামনে কয়েকটি যাত্রীবাহী বাস দাঁড়িয়ে থাকতো, অন্য যানবাহনের পথ রুদ্ধ করে। তার একটু সামনে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতো ১০-১৫টা সিএনজি চালিত অটোরিক্সা। তার সামনে ২০-২৫ টা মোটর সাইকেল।
সেই বসিলা আজ যেন একেবারেই অচেনা, ভিন্ন এক রূপে।
গাড়ীর ভেতর থেকে দূরে চোখ রেখে দেখি, দু'পাশের সব দোকানপাটই বন্ধ। চায়ের দোকান, পুরনো লোহালক্কড়, নতুন মোটর সাইকেলের শোরুম, টাইলস, মোটরের যন্ত্রাংশ, রেস্টুরেন্ট সবই শাটার নামানো। তবে ডান পাশে র্যাব-২ এর প্রধান ফটক দিয়ে বাই-সাইকেলে চেপে ধীর লয়ে একজনকে ঢুকতে দেখা গেল।
এভাবে পথের দু'দিকের অচেনা রূপ দেখতে দেখতেই এসে পড়ি অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের চার রাস্তার মোড়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৯ টা বেজে ৩৩ মিনিট। বিশ্বাস করতে মন চায় না- তার মানে বাসা থেকে বের হওয়ার পর মাত্র তিন মিনিটেই কয়েক কিলোমিটার?
এই মোড়ের চারপাশও সুনশান, চিরচেনা যানজট নেই- গণপরিবহন নেই, সিএনজি নেই, উবার,পাঠাও, ওভাই, ওবোন সবই যেন কোথাও উধাও হয়ে গেছে। কেবল কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি রিকশা আর পুলিশের একটি পেট্রোল ভ্যান।
তারপর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে তো আরও অবাক হবার পালা। ফুটপাতে অভিভাবকদের জটলা নেই, মোহাম্মদপুর টু ফার্মগেইটের লেগুনায় জায়গা দখলের শক্তি প্রদর্শন করা নেই, নেই বিআরটিসি,পরিস্থানসহ কয়েকটি সিটি সার্ভিসের বাসও। যাদের প্রধান কাজই ছিলো সড়ক আটকে রেখে যানজট তৈরী করে নগরজীবন বিষিয়ে তোলা।
সেখানেও দেখা হলো দু-চারজন পথচারী আর দু-চারটি রিকশার সঙ্গে। আরেকটু এগিয়ে মোহাম্মদপুর থানার সামনে আরেকটি পুলিশ ভ্যান চোখে পড়লো। যেখানে পোশাকধারী এক পুলিশ সদস্য স্মার্ট ফোনে গভীর মনোযোগে কি যেন করছেন।
আমরা সোজা এগুতে থাকি, একাডেমিয়া স্কুল, ইউনিমেড, ইউনিহেলথের নতুন কর্পোরেট অফিস, আল-নূর চক্ষু হাসপাতালের সামনে দিয়ে আমরা চলতে থাকি ২৭ নম্বরের দিকে। পথে কোন প্রাইভেট কারও দেখা মিললো না। সব দোকানেরই শার্টার বন্ধ।
আমরা বামে মোড় নিয়ে প্রবেশ করি ২৭ নম্বরে। বাঁদিকের প্রিমিয়াম সুইটস, বার বি কিউ রেস্টুরেন্ট, আর্টিযান সবই বন্ধ। আরেকটু এগিয়ে দেখি মিনাবাজার খোলা। কয়েকজন ক্রেতাকে ভেতরে ঢুকতে দেখা গেল।
এভাবে ২৭ নম্বরের মোড়ে মাইডাসের সামনে এসে দেখি ঘড়ির কাটা ৯টা ৩৭ ছুঁইছুঁই। এখানেও এদিক ওদিক তাকিয়ে মনে হয়, সবাই হোম কোয়ারেন্টিনে, আমরাই কেবল পথে নেমেছি। হঠাৎ ধানমন্ডি রয়েজ স্কুলের সামনে দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে চোখের পলকে ছুটে গেল একটি এ্যাম্বুলেন্স। সেখানে যাত্রী হিসেবে কোন মুমূর্ষু রোগী না অন্য কেউ তা অবশ্য জানার, বোঝার সুযোগ হয়নি।
হঠাৎ ফিরে যাই অতীতে। মনে পড়ে, এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কথা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন অবৈধ অস্ত্র আনা নেয়া করতো এ্যাম্বুলেন্সে করে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে।
যাই হোক, ২৭ নম্বরের মোড় থেকে আমরা সোবহানবাগের দিকে চলতে থাকি। এখানে একটু বলে রাখি, ২৭ নম্বরের সিগনালে গাড়ীর দুপাশে দু'জন নখ দিয়ে গ্লাসে ঠকঠক আওয়াজ করতেন, অধীর হয়ে তারা ভিক্ষে চাইতেন। আজ অবশ্য তাদের কাউকেই চোখে পড়লো না, দেখা হলো না মুখচেনা কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গেও।
সোবহানবাগের মোহাম্মদিয়া মার্কেটের সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখি দুটো ফার্মেসি খোলা। খানিকটা এগিয়ে শুক্রাবাদের এরাম হোটেলের বন্ধ ফটক পেরিয়ে চোখে পড়ে আহম্মদিয়া ফার্মেসীতে কয়েকজন ক্রেতা।
বাম দিকে মোড় নিয়ে রাসেল স্কয়ার পেরুতেই আরেকটি পুলিশ ভ্যানের সঙ্গে দেখা। আরেকটু এগুলে বাঁ দিকে 'মাদল' রেস্টুরেন্ট, মনে হলো আজও খোলা। এভাবে দু'পাশে নজর বুলাতে বুলাতে বসুন্ধরা শপিং মলের সামনে পৌঁছে দেখি সকাল ৯টা ৪০। স্বপ্ন দেখছি না তো? বুড়িগঙ্গার ও পার থেকে সার্ক-ফোয়ারা পর্যন্ত মাত্র ১০ মিনিটেই!!!
আগে এই মোড়ের যানজট পেরিয়ে হোটেল সোনারগাঁও-এর সামনে দিয়ে বাংলামোটর সিগনালে আসতেই কেটে যেত কমপক্ষে ৪০ মিনিট।
তবে আজ কোন সিগনালেই দাঁড়াতে হয়নি, সাবধানী চোখে নিমিষেই চালক পেরিয়ে গেলেন বাংলামোটর সিগনাল। তারপর রূপায়ন ট্রেড সেন্টারের সামনে দিয়ে আমরা বামে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়ি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের রাস্তায়। একটু এগিয়ে দেখি বামদিকে একটি ভ্যানে সব্জি বিক্রেতা, তার একটু দূরে দুটি মুদির দোকান খোলা। আর সবই শুনসান..
এভাবেই যানজট,শব্দদূষণ, ভিক্ষুকদের আকুতি ছাড়াই আমরা পৌঁছে যাই ইস্কাটন গার্ডেনের সুইড ভবনে। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৯ টা বেজে ৪৩ মিনিট। তার মানে মাত্র ১৩ মিনিটেই আমরা পাড়ি দিলাম ১৩ কিলোমিটার পথ। অথচ, রাজধানীতে দিনের বেলায় চলাচলের গড় গতি না কি ঘন্টায় ৪ কিলোমিটার!!!
অন্যদিনগুলোতে এটুকু পথ পেরুতেই লেগে যেত কখনও ১ ঘন্টা, কখনও বা দেড় ঘন্টা!!!