মেহেদির তত্ত্বতালাশ: কোন মেহেদি? সাধারণ না অর্গানিক? মেহেদি আর্টিস্ট কারা?
আমরা যারা 'নাইন্টিজ কিড' বলে নিজেদের দাবি করি তাদের ছোটবেলার অবিচ্ছেদ্য ঈদ অনুষঙ্গ শাহাজাদী মেহেদির টিউব। চাঁদরাতে বড়দের পেছনে ঘুরঘুর করে হাতে মেহেদি দেওয়া ছিল তখন আবশ্যক কাজ। রাতভর সাবধানে শুয়ে সকালে হাতের রঙ দেখার অধীর অপেক্ষায় দুচোখে যেন ঘুমই আসতো না! কমপক্ষে চার-পাঁচ ঘণ্টা হাতে রাখতে হতো সেই মেহেদি।
এর কয়েক বছর পরই ধীরে ধীরে বাজার দখল করতে থাকে পাঁচ মিনিটে রঙ হওয়া ইন্সট্যান্ট মেহেদি। এত ধৈর্য পরীক্ষার বদলে সহজ সমাধানের দিকেই ঝুঁকতে পছন্দ করলাম আমরা। সেসবে আবার রঙ-বেরঙের ভিন্নতাও ছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই অতিরিক্ত কেমিক্যাল সমৃদ্ধ সেই মেহেদির ভয়ংকর কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করে ত্বকে। অ্যালার্জি, চামড়া ওঠার মতো সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে তখন অনেকেই মরিয়া হলেন অর্গানিক বা প্রাকৃতিক মেহেদির খোঁজে। মেহেদিপ্রেমীদের কাছে দিনদিন জনপ্রিয়তা বাড়ছে এ ধরনের মেহেদির।
অর্গানিক মেহেদির বিশেষত্ব হলো এতে কোনো প্রিজারভেটিভ থাকে না। রাসায়নিক সার ছাড়া উৎপাদিত মেহেদি পাতার গুঁড়া ব্যবহৃত হয় এটি তৈরিতে। এছাড়া এসেনশিয়াল অয়েল, ব্রাউন সুগার আর লেবুর রস মিশিয়ে বানানো হয় এই প্রাকৃতিক মেহেদি। পুরোপুরি রঙ আসার জন্য ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা হাতে রাখতে হয় এটি। সংরক্ষণ করা কিছুটা ঝামেলার বলে সাধারণত বাজারে এসব মেহেদি সরাসরি পাওয়া যায় না। ফেসবুক ভিত্তিক বেশ কিছু অনলাইন পেইজই কয়েকবছর ধরে অর্গানিক মেহেদির এক নির্ভরযোগ্য উৎস।
'Mehedi_Art by Oishi'-র স্বত্বাধিকারী সৈয়দা আফসারা তাসনিম ঐশি আড়াই বছর ধরে অর্গানিক মেহেদি তৈরি করছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি মেহেদি আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেন তিনি। সেখান থেকেই মেহেদি বানানোর প্রতি আগ্রহ। অনলাইন ঘেঁটে আর নিজে নিজে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেই আয়ত্ত করেছেন এই বিদ্যা। হাতে তৈরি আর খাঁটি বলেই গ্রাহকদের চাহিদা বাড়ছে অর্গানিক মেহেদির প্রতি।
"অর্গানিক মেহেদি বানাতে ব্যবহার করা বেশিরভাগ উপকরণ দেশের বাইরে থেকে ইমপোর্ট করতে হয়। হেনা পাউডার (মেহেদি গুঁড়া) আসে মূলত রাজস্থান থেকে। ওখানকার তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, মাটির বৈশিষ্ট্যে সবচেয়ে ভালো পাতা পাওয়া যায়। আর এসেনশিয়াল অয়েল আনাই অস্ট্রেলিয়া থেকে। শুধু লেবুর রস আর ব্রাউন সুগার বাংলাদেশে পাওয়া যায়। তাই এই মেহেদির দামটাও বেশি হয়," বলেন ঐশি।
সাধারণত ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে অর্গানিক মেহেদি প্রতিটি কোণের মূল্য। অনেকে আবার মেহেদি গুঁড়া, এসেনশিয়াল অয়েল ইত্যাদি উপকরণ আলাদা করেও বিক্রি করেন।
এক যুগ ধরে অর্গানিক মেহেদি তৈরির অভিজ্ঞতা 'Mehezabin Mehendi House'-এর স্বত্বাধিকারী মেহজাবিন আলম খানের। মেহেদি আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করার শুরুতে শুধু নিজের গ্রাহকদের জন্য তিনি মেহেদি বানাতেন। চার বছর যাবত আলাদা বিক্রির জন্যও তৈরি করছেন অর্গানিক মেহেদি। প্রতি বছর দুই ঈদের সময় আর শীতকালীন বিয়ের সিজনে মেহেদি বানানোর প্রচুর চাপ থাকে তার হাউজে।
মেহজাবিন বলেন, "অর্গানিক মেহেদিতে স্কিন পিল অফ হয় না (চামড়া ওঠে না), অ্যালার্জি বা চুলকানোর সমস্যাও হয় না। যারা একবার এই মেহেদি ব্যবহার করেছেন তারা পরবর্তীতে আর অন্য কোনো মেহেদি ব্যবহার করতে চান না। ডিপফ্রিজে ঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে এটা কমপক্ষে ১০ মাস সংরক্ষণ করা যায়।"
মানুষ অর্গানিক মেহেদি সম্পর্কে যত জানছে, এই জিনিসটার প্রতি তত বেশি আগ্রহ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এ বছর রমজানে মেহজাবিন'স মেহেদি হাউজে প্রায় ৫ লাখ টাকার অর্গানিক মেহেদি বিক্রি হয়েছে। অর্গানিক মেহেদি তৈরির উদ্যোক্তাও দিনদিন বাড়ছে।
সাধারণত, অর্ডার আসার পর এই মেহেদি বানিয়ে পাঠানো হয় বলে জানান মেহজাবিন। মেহেদি কোণ ডিপ ফ্রিজে বায়ুরোধী জায়গায় সংরক্ষণ করতে হয়। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বা নরমাল ফ্রিজে অর্গানিক মেহেদি সংরক্ষণ করা যায় না। তাই ডেলিভারির ক্ষেত্রেও সময়ের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। সংরক্ষণের অসতর্কতায় সহজেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে এই মেহেদি।
সবার হাতে অবশ্য সমান রঙ হয় না এই মেহেদির। ত্বকের ধরনের ওপর নির্ভর করে কেমন রঙ হবে। ত্বকের কেমিস্ট্রি, তাপমাত্রা, হরমোন এদিক সেদিক হলে রঙ হালকা বা গাঢ় হতে পারে।
অর্গানিক মেহেদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশকিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। শুরুতেই ফ্রিজ থেকে কোণ বের করে আধাঘণ্টা সাধারণ তাপমাত্রায় রেখে বরফ ছাড়িয়ে নিতে হবে। এরপর পরিষ্কার হাতের উপর মেহেদির নকশা আঁকতে হবে। বেশিক্ষণ রাখার সুবিধার জন্য রাতে ঘুমানোর আগে মেহেদি লাগানোই ভালো। মেহেদি শুকাতে শুরু করলে লেবু-চিনির মিশ্রণ ব্রাশ করে এর ওপর দেওয়া যায়। এতে বেশিক্ষণ হাতে লেগে থাকে মেহেদি। সরিষার তেল দিয়ে এ মেহেদি উঠাতে হবে। ভালো রঙের জন্য মেহেদি উঠানোর পর কমপক্ষে ৫-৬ ঘণ্টা পানি থেকে দূরে রাখতে হবে হাত। সাধারণত ৮-১০ দিন বেশ ভালোভাবেই হাতে থাকে অর্গানিক মেহেদির রঙ।
পুরোপুরি প্রাকৃতিক বা অর্গানিক মেহেদির বাইরে নাইন্টিজ কিডদের সেই শাহাজাদীর মতো আজকাল ইন্ডিয়ান কাভেরি ও প্রেম দুলহান নামের মেহেদিও ক্রেতাদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় বলে জানান ঐশি। এই মেহেদিগুলোতে কেমিক্যালের পরিমাণ খুব বেশি থাকে না। দামও অর্গানিক মেহেদির চেয়ে অনেক কম। তাই অনেকেই এগুলো পছন্দ করেন।
তবে মেহেদি আর্টিস্ট আরউইন আহমেদ বলেন, "যাদের স্কিন প্রবলেম বা অ্যালার্জি জাতীয় কোনো সমস্যা আছে তারা ঝুঁকি এড়াতে এখন অর্গানিক মেহেদিই বেছে নেন। বাজারের প্রিজারভেটিভযুক্ত মেহেদি অনেকের ত্বকেই মারাত্মক প্রভাব ফেলে।"