গোল গম্বুজ: আরেক তাজমহল!
তাজমহল তো সবাই চিনেন কিন্তু দক্ষিণ ভারতে নির্মিত মোহাম্মদ আদিল শাহের এই রাজকীয় সমাধির কথা কি জানেন? ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বিজাপুর শহরে অবস্থিত এই সমাধিটি ভারতের বৃহত্তম রাজসমাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
দক্ষিণ ভারতের তাজমহল নামে পরিচিত এই রাজকীয় স্থাপনায় সুলতান মোহাম্মদ আদিল শাহের সমাধি রয়েছে। ১৬২৭ থেকে ১৬৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি বিজাপুরের সুলতানের দায়িত্ব পালন করেন।
আক্ষরিকভাবেই গোলাকার গম্বুজ বিশিষ্ট স্থাপনাটির নাম গোল গম্বুজ। নির্ভরতা ছাড়াই স্বাধীনভাবে মাথাউঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বের বৃহত্তম গম্বুজগুলোর মধ্যে সমাধির এই বিশাল গম্বুজটি অন্যতম।
মোহাম্মদ আদিল শাহ ছিলেন বিজাপুরের আদিল শাহী বংশের সপ্তম শাসক। পিতার মৃত্যুর পর ১৬২৭ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। যে বয়সে সুলতানরা বিভিন্ন খেলা আর নারীসঙ্গে মত্ত থাকেন, সেই বয়সে মোহাম্মদ আদিল শাহ মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।
মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ কোনো তুচ্ছ সমাধিতে সমাহিত করা হবে, এই ভয়ে তিনি তখনই নিজের জন্য এক দুর্দান্ত সমাধি নির্মাণ শুরু করেন।
মোহাম্মদ আদিল শাহ তাঁর পিতা দ্বিতীয় ইব্রাহিম আদিল শাহ-এর সমাধি ইব্রাহিম রৌজা থেকেও বড় একটি সমাধি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।
একক ঘরবিশিষ্ট সবচেয়ে বৃহৎ গম্বুজধারী স্থাপনা হিসেবে গোল গম্বুজ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন আদিল শাহ। এমনকি এখন পর্যন্ত তা বিশ্বের বৃহত্তম একক গম্বুজ স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
মোহাম্মদ আদিল শাহের পুরো শাসনামলজুড়েই সমাধি নির্মাণ কাজ অব্যাহত ছিল। কিন্তু ১৯৫৬ সালে সুলতানের আকস্মিক মৃত্যুর পর তা সম্পূর্ণ করা হয়নি। তা সত্ত্বেও সুলতানের ইচ্ছানুসারে তাকে গোল গম্বুজে সমাহিত করা হয়।
পরবর্তীতে তাঁর দুই স্ত্রী তাজজাহান বেগম ও আরুস বিবি, উপপত্নী রম্ভা, সুলতানের মেয়ে ও নাতিকেও তাঁর সঙ্গে সমাহিত করা হয়।
সমাধিটি একটি অর্ধগোলাকার গম্বুজসহ একটি বিশাল ঘনক আকৃতির কাঠামো নিয়ে গঠিত। ঘনক্ষেত্রটির প্রতিটি দিক ৪৭ মিটার বিশিষ্ট। অন্যদিকে গম্বুজটির বাইরের দিকের ব্যাস ৪৪ মিটার। ঘনক্ষেত্রের চার কোণে চারটি অষ্টভুজাকার মিনারের মতো টাওয়ার রয়েছে।
প্রতিটি টাওয়ার সাতটি তলায় বিভক্ত এবং সেগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাল্ব আকৃতির গম্বুজ। টাওয়ারের প্রতি তলায় তোরণাকৃতি নকশা ও সিঁড়ি রয়েছে।
ভেতরে প্রায় ৪১ মিটার জায়গাজুড়ে রয়েছে বিশাল একক কক্ষ, যা প্রায় ৬০ মিটার উঁচু। কক্ষের মাঝখানে রয়েছে আদিল শাহ এবং তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কবর। কবরের জায়গাটির একটি উঁচু মঞ্চের মতো।
তবে উঁচু এই সমাধিসৌধের নিচতলায় আছে প্রকৃত কবর। সমাধির পশ্চিমদিকের প্রবেশদ্বারের নিচের এক সিঁড়ি দিয়ে নিচে যাওয়া যায়। একটি কাঠের ছাউনি নিয়ে আদিল শাহের সমাধিসৌধ মোড়ানো রয়েছে। ধারণা করা হয় এটি পরবর্তী কোনো এক সময়ে নির্মিত।
মূল সমাধিটি গাঢ় ধূসর বেসাল্ট পাথরে নির্মিত এবং এর সম্মুখভাগ প্লাস্টার দিয়ে সজ্জিত। গম্বুজটি অবশ্য ইটের নির্মিত। এর ওপর হয়েছে চুনকাম।
নির্মাণের সময় মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম গম্বুজ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল গোল গম্বুজ।
সমাধিসৌধের আরেকটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো গম্বুজের চারপাশে অবস্থিত গ্যালারি। চারটি টাওয়ারে ঘুরতে থাকা সিঁড়ি দিয়ে এখানে প্রবেশ করা যায়। গম্বুজ থেকে প্রতিফলিত শব্দ শোনা যায় বলে এটি 'হুইসপারিং' গ্যালারি নামে পরিচিত।
গোল গম্বুজ ছাড়াও, বিজাপুর শহরে (আক্ষরিক অর্থ 'বিজয়ের শহর') যেসব ঐতিহাসিক স্থাপত্য রয়েছে, তার বেশিরভাগই আদিল শাহী রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত। এর মধ্যে রয়েছে বিজাপুর দুর্গ, বড় কামান, জামে মসজিদ। এর বাইরেও রয়েছে অসংখ্য সমাধি ও মসজিদ, সময়কে হারিয়ে এখনও যারা বিজাপুরের প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর চিহ্ন বহন করে চলেছে।
সূত্র: অ্যামিউজিং প্ল্যানেট