অলড্রিন হতে পারতেন চাঁদে প্রথম অবতরণকারী
ধুপ করে যেন এবড়োথেবড়ো ভূমিতে পড়লাম। জানালা দিয়ে একনজর বাইরে চোখ বুলিয়েই আবার বসে পড়লাম আসনে, পরের মুহূর্তগুলো চেয়ারের ওপর আমরা যেন খেলার পুতুলের মত ঝাঁকুনি খেতে থাকলাম অবিশ্বাস্যভাবে। মহাকাশের অনন্ত শূন্যতার মাঝে যেমন আলোর অভাব, এখানে তেমন না। ৭ মিনিট পরে মোটামুটি ধাতস্থ হয়ে দলনেতা নিল আর্মস্ট্রং রেডিওতে বলল- এয়ার বস, অ্যাপোলো ১১, সব ঠিক আছে, আমরা সাঁতারুদের অপেক্ষা করছি।
এবং এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে যেন সব শেষ হয়ে গেল, কোনো হাততালি নেই, পিঠ চাপড়া-চাপড়ি নেই, উষ্ণ আলিঙ্গন নেই, এমনকি করমর্দনও নেই! তিন জন মানুষ আপন জগতে ডুব দিল ভাসমান এক যানে। তবে আমি মূলত নিজেকে বুঝ দেবার চেষ্টা করছিলাম যাতে সী-সিক না হয়ে পড়ি, পরে শুনেছি অন্যরাও তা-ই করছিল।
খানিক পরেই উদ্ধারকর্মীরা চলে আসল, প্রথমজনকে ফ্রগম্যানের বেশভূষায় দেখে মনে হল জুল ভার্নের বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে।- এভাবেই শুরু হয়েছে চাঁদের বুকে মানুষের অবতরণের প্রথম দলের অন্যতম সদস্য কর্নেল এডউইন বাজ অলড্রিনের (জুনিয়র) আত্মজীবনী রিটার্ন টু আর্থ, সঙ্গে ছায়ালেখক হিসেবে ছিলেন ওয়েন ওয়ারগা, ১৯৭৩ সালে প্রথম ছাপা বইটিতে অ্যাপোলো-১১ মিশন বিশাল অংশজুড়ে থাকলেও আগুপিছুভাবে নানাবার এসেছে অলড্রিনের জীবন, বেড়ে ওঠা, পরিবার, বন্ধু, বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভের পর ব্যাপক ভ্রমণের অভিজ্ঞতাসহ মানসিক টানাপোড়েন, চাঁদ থেকে ফেরার ২ বছরের মধ্যে কেন তাকে মানসিক চিকিৎসা নিতে হয়েছিল- সবকিছুই।
বাজ অলড্রিন নিঃসন্দেহে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি নাম, যদিও সারা জীবন কয়েক কোটি বার কেন চাঁদে তিনি নিলের পর নামলেন এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন- যদি কয়েক মিনিটের ব্যবধানে চাঁদে নামার ব্যাপারটা আমার জন্য বিশাল অপমানজনক হয়, তাহলে সেই অপমান বয়েই বাকি জীবনটা আমার চলতে হবে।
উনার নাম কোনোভাবে শিশুকালে শুনে থাকলেও প্রথম তাদের ভ্রমণ বর্ণনা এবং ছবি দেখেছিলাম প্রাইমারি স্কুলের বইতে, সেখানে অবশ্য তার নামা ছাপা হয়েছিল এডউইন অলড্রিন, কিন্তু একাধিক জায়গায় দেখেছিলাম বাজ অলড্রিন, দেখেই খুব ভাল লেগেছিল, ভেবেছিলাম কুমেরু বিজয়ী অভিযাত্রী রবার্ট ফ্যালকন স্কটের মতো তার নামের মাঝের অংশটিও কোনো পাখির নাম থেকে নেওয়া হয়েছে- বাজ! কিন্তু বইখানা পরে দেখি তার বোন পিচ্চিকালে অলড্রিনকে ব্রাদার্স বলতে যেয়ে সবসময়ই বলত বাজার্স, সেখান থেকেই বাজ শব্দটি তার নামের সাথে লেপ্টে গেছে।
যাই হোক, আবার আমরা ফিরে যাচ্ছি উদ্ধারকারীদের কাছে, সাগরের অতল জলে- এর মাঝেই তলিয়ে গেছে নভোযান কলম্বিয়া, যার ওপর নির্ভর করছিল তিন নভোচারীর জীবন। সরাসরি কোয়ারান্টাইনে পাঠিয়ে দেওয়া হলো আমাদের, বলা তো যায় না যদি চাঁদ থেকে অজানা কোনো জীবাণু চলে আসে রকেটবাহিত হয়ে! সেখানেই চলতে থাকল নানা মেডিক্যাল চেক-আপ, এর মাঝে অর্ধপৃথিবী ঘুরে আমাদের সাথে দেখা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন।
সেই বাক্সের মতো ঘরের কাঁচের জানালা দিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যতখানি সম্ভব ইয়েস স্যার এবং থ্যাংক ইউ স্যার বলে কথা চালিয়ে গেলাম। প্রেসিডেন্ট পুরো ঘটনা নিয়ে ব্যাপক উৎসাহী ছিলেন এবং বলে বসলেন সৃষ্টির পর থেকে চাঁদ থেকে ফিরে আসার সপ্তাহটিই মহাবিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কলিন্সের গোঁফ নিয়েও বেশ রসিকতা করলেন যে মহাশূন্যে এই ঝক্কি ঝামেলার মাঝেও সেটি বেশ ভালোই বেড়েছে! প্রতি স্পেস ফ্লাইটের পরেই নভোচারীদের পদোন্নতি নিয়ে কথা হতো স্বাভাবিকভাবে, কিন্তু আমাদের মাঝে নিল ছিল সিভিলিয়ান, আমি কর্নেল, তাই এক মাইক-ই লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিল যে শীঘ্রই কর্নেলে পরিণত হয়। আমার কথা বলা সময়ে অ্যাপোলো-১ দুর্ঘটনায় নিহত তিন নভোচারী গাস গ্রিসসম, রজার চ্যাফে এবং এড হোয়াইটের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন করতে বলি সবাইকে, এরপর হোয়াইট হাউসে আবার দেখা হবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট চলে যান।
শুরু হল আমাদের বন্দী জীবন, খাওয়া- পান- ঘুম আর অন্যান্য রুটিন, তবে সত্য বলতে আমরা তিনজনেই চাচ্ছিলাম কিছুক্ষণের জন্য একেবারেই কোনো কিছু না করার জন্য। আবার সেই কিছু না করতে চাওয়ার তাড়নাই আসলে আমাদের ধাবিত করেছিল এক নতুন গন্তব্যের দিকে, চাঁদের পিঠে কী পেতে পারি সেই ধারণা আমাদের কিছুটা ছিলই, কিন্তু নিজ গ্রহে ফিরে আসার পরে কোনদিকে জীবন যাবে তেমন কোনো জ্ঞানই আমাদের ছিল না। সেখানে দুইদিন থাকার পর আমাদের পার্ল হারবারে নিয়ে যাওয়া হয়, প্রথমবারের মতো নীল গ্রহের কোনো ভূমি স্পর্শ করি সবাই। সেখানে উপস্থিত প্যাসিফিক ফোর্সের কমান্ডার অ্যাডমিরাল জন ম্যাককেইন এসেই বাজখাই গলায় বলে বসলেন- You lucky sons of bitches. I'd have given anything to go with you.
আমাদের অজ্ঞাত জীবাণুর বিরুদ্ধে এই সতর্কতার অবস্থান ছিল টানা তিন সপ্তাহ, এর মাঝে আমাদের সাথে দুজন পাচক, এক আলোকচিত্রগ্রাহক, একজন চিকিৎসক, দুজন নাসার কর্মকর্তা যোগ দিয়েছিলেন ল্যাবরেটরিতে থাকার জন্য, তবে নিলের জন্মদিন উপলক্ষে ৫ আগস্ট এক তরুণী সহকর্মীও যোগ দিয়েছিলেন দলের সাথে।
এর মাঝে এক অদ্ভুত সমস্যার কথা আমি অন্যদের বলি, মহাশুন্যে যাত্রার সময় চাঁদের দিকে যেতে আমাদের যে দুই রাত লেগেছিল সেই সময়ে চোখের কোণে অদ্ভুত কিছু আলোর ঝলকানি নজরে পড়েছিল, যদিও রকেট ছিল আঁধারে ঘেরা, জানালাও ছিল বন্ধ, কিন্তু থেকে থেকেই সেই ঝলকানি আমাকে যথেষ্ট বিব্রত করেছিল।
এবং পৃথিবীর দিকে ফেরার পথেও একই ঘটনা ঘটল। অবশেষে অন্য দুইজনকে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম যে তাদের ক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটেছে নাকি, মাইক না দেখলেও নিল জানাল সে এমন কিছু অনুভব করেছে। পৃথিবীতে ফিরে এই নিয়ে অনেক কথা চলল, অ্যাপোলো-৮ এর নভোচারীদেরও এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যদিও তারা কিছুই দেখেনি। এখন আমরা জানি এই বিষয়টিকে বলা হয় ফ্লিকার-ফ্ল্যাশ, কিছু মানুষ সেই ঝলকানি দেখতে পারি এবং বাকীরা পারে না। নানা মৌলের আয়োনাইজেশনের কারণে এমনটা ঘটে থাকে এবং এই কণাগুলো শুধু রকেট না, আমাদের হেলমেট এমনকি মস্তিষ্ক ভেদ করেও যেতে পারে।
অবশেষে আমাদের নিকট ভবিষ্যতের পরিকল্পনা জানানো হল, আমাদের আগামী এক বছর বিশ্বের নানা স্থানে যাওয়ার পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই করা হয়ে গেছে। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ১০ আগস্ট, রবিবার আমাদের কোয়ারেন্টাইন শেষ হলো। মনে হলো অনন্তকালের পরে আমি, নিল আর মাইক আলাদা হতে যাচ্ছি। নাসা আমাদের প্রত্যেককেই বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। সেখানে স্ত্রী আর তিন সন্তানের সাথে দেখা হবার পরে মনে হলো– ফিরে এসেছি!
পরের সোমবারেই প্রথম কাজ ছিল একটা স্যুট কেনা, যেহেতু বুধবারেই আমাদের দেশব্যাপী ভ্রমণ শুরু হবে, তাই সময় ছিল নিতান্তই কম। প্রথম গন্তব্য ছিল নিউইয়র্ক, সেখানে মানুষের ভিড় বিশেষ করে পতাকাবাহী স্কাউটদের বিউগলের আওয়াজে আপ্লুত হয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল- আমাকে ধন্যবাদ দিও না, বরং তোমাদের ধন্যবাদ দিতে দাও। যুক্তরাষ্ট্রের নানা স্থান ঘুরে যাত্রা অব্যাহত থাকল মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, নরওয়ে, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ইতালি, ভ্যাটিকান, যুগোস্লাভিয়া, তুরস্ক, কঙ্গো, ইরান, ভারত, পূর্ব পাকিস্তান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ), থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া, জাপান, কানাডা। এর মাঝে কোনো কোনো দেশে আমাদের একাধিক শহরে থামতে হয়েছিল।
কঙ্গোতে রাষ্ট্রপতি জোসেফ মবুতুর পোষা দুই সিংহের কথা মনে পড়ে, তার দরজায় শুয়ে শুয়ে রোদ পোহাত ওরা।
ঢাকাতে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা, আমাকে মৌলবাদীরা হুমকি দিয়েছিল আজব কারণে—
October 27, 1969, Dacca, East Pakistan, We were advised to avoid eating any food and i very nearly didn't get off the plane. En route, we received a cable saying that a group of dissidents were threatening to cause trouble because one of the American Astronauts, a Colonel Aldrin, had Zionist leanings. They would not be responsible for my fate if i dared step off the plane.
I racked my brain trying to figure out what was going on. The best i could do was to recall that a Masonic Lodge in Tel Aviv had sent me a very elaborate plaque and i had responded to them.
The country is now known as Bangladesh and i can see why a revolution was inevitable. The poverty was extreme and thousands of people were starving and homeless.
পরে নিলের পরামর্শে কিছুই ঘটেনি এমন ভান করে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লাম একসাথে।
অবশেষে নভেম্বরের ৪ তারিখে জাপানের টোকিওতে আমাদের বিশ্ব-সফর শেষ হলো, জাপানের প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতো প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশিদের জাপানিজ অর্ডার অব কালচার নামের পদক রিবন দিয়ে পরিয়ে দিলেন, অবশ্য তার জন্য আমাদের মাথার উপর দিয়ে সেটি গলিয়ে গলায় দেওয়া সম্ভবপর ছিল না বিধায় মাথা নিচু করে সহযোগিতা করেছিলাম সবাই।
ফিরে আসি আমার জীবনে, ১৯৩০ সালের জানুয়ারির ২০ তারিখ আমার জন্ম, নিউ জার্সিতে। পুরো নাম রাখা হয়েছিল এডউইন ইউজেন অলড্রিন জুনিয়র, যদিও দেড় বছরের বড় বোন ফে অ্যানের কল্যাণে আদরের ব্রাদার থেকে বাজার হয়ে বাজ হয়ে গেল আমার নাম। বয়সের তুলনায় দৈহিক বৃদ্ধিতে বেশ কমতি ছিল, যদিও বড় ছেলেদের সাথে সেই ঘাটতি পূরণের জন্য সুযোগ পেলেই মারামারিতে জড়িয়ে পড়তাম, মুখ ভর্তি ছিল নানা মারামারির আঘাতে, কিন্তু চোখ ফুলিয়ে কালো করে বাড়িতে ফিরিনি কখনও।
২১ বছরে গ্রাজুয়েশন শেষ হবার পরপরই বিশ্ব দেখার নেশাতে ইউরোপ চলে যাই, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি, সুইজারল্যান্ড ঘোরার ফাঁকে ফাঁকে নানা জাদুঘর, ভবন, চত্বর দেখি উন্মাতাল কৌতূহলে, আসলে সারা জীবনে আর কোনো সময়ই এমন একা একা কাটানো হয়নি, সময়টা আসলে উপভোগ করেছিলাম। এর পরপরই বিমান বাহিনীতে যোগ দিই, বিমান চালনার প্রশিক্ষণের জন্য নানা ঘাঁটিতে অবস্থান করতে হয়েছিল, পরে F-86 চালানো ৫১তম ফাইটার উইং-এর সদস্য হিসেবে যোগদান করি।
এদিকে জোয়ান তখন অন্তঃসত্ত্বা, অ্যান্ডি তার গর্ভে, আমরা একসঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণে ছিলাম। নেপলসে কয়েকদিন থাকার পরে একদিন ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি আরোহণের চেষ্টা চালালাম, এক জায়গায় ধোঁয়া উড়তে দেখে তা আগ্নেয়গিরির ধোঁয়া কি না, দেখার জন্য থামার পর দেখি কোন চাল্লু লোক কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সটকে পড়েছে, সেদিন আর শিখরে যাওয়া সম্ভব হল না, বরং তার পরিবর্তে আমাদের গাইডের সঙ্গে তার পারিবারিক ওয়াইন সেলারে যাওয়া হলো বাকি সময়ের জন্য!
বাবা এমআইটি থেকে ডক্টরেট করেছিলেন, আমারও সেখানে ভর্তির আবেদন গৃহীত হয়। সেখানে থাকার সময়ই শুরু হয় নাসার নভোচারী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া। মোটমাট ৩৪ জন ছিলাম নাসার লম্বা ইন্টারভিউতে। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৩ সালের ১৭ অক্টোবর আমরা ১৪ জন অফিসিয়াল ঘোষণা দেবার জন্য প্রথমবারের মত প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত হই।
জেমিনি ছিল আমাদের প্রথম ধাপ, আমি জেমিনি-১০ এর ব্যাকআপ দলে ছিলাম, মূল দল কোনো সমস্যায় না পড়ায় আর যেতে হয়নি, কিন্তু নিয়ম অনুসারে জেমিনি-১৩-তে আমার মহাকাশযাত্রার কথা ছিল, যদিও দুঃখজনকভাবে জেমিনি-১২ এর পরেই এর কার্যক্রম থামিয়ে দেওয়া হয়। এর মাঝে ১৯৬৬র ২৮ ফেব্রুয়ারি জেমিনি-৯ দলের দুজন সদস্য চার্লি এবং ইলিয়ট বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। খুবই মর্মান্তিক একটা দুর্ঘটনা এবং এর ফলেই আমাকে জেমিনি-১২ দলে যোগদান করতে হয়, মহাকাশে রওনা দিই প্রথমবারের মত। সেখানে অবস্থানের ৩য় দিনে রকেটের হ্যাচ খুলে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়ায় ৫১ মিনিট বাইরে অবস্থান করি, সেই সময় মোট ৫ ঘণ্টা ২৬ মিনিট শুন্যে অবস্থানের রেকর্ড গড়েছিলাম নিজের অজান্তেই। ৪ দিনের মাথায় আমরা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসি, আটলান্টিকে আছড়ে পড়ে আমাদের নভোযান।
শুরু হল অ্যাপোলোর পথ চলা, কিন্তু অ্যাপোলো- ১ এর মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নভোচারী গাস গ্রিসসম, রজার চ্যাফে এবং এড হোয়াইটের নিহত হবার ফলে বেশ কিছু পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়। ধারণা করা হয়েছিল অ্যাপোলো- ১২ চাঁদের বুকে নামবে কিন্তু পরে মনে হলো অ্যাপোলো- ১১ সেই অবিস্মরণীয় সন্মান পেতে যাচ্ছে। অ্যাপোলো- ৯ এর ব্যাকআপ টিমে নিল আর্মস্ট্রং এবং জিম লোভেলের সঙ্গে আমার নাম ঘোষণা করা হল। নানা ধরনের পরিকল্পনা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঠিক করা হল ফ্র্যাঙ্ক বোরম্যানের কমান্ডে অ্যাপোলো– ৮ প্রথম নভোযান হিসেবে চাঁদের চারপাশে প্রদক্ষিণ করবে। আমি সেই মিশনের ব্যাকআপ ক্রু।
এখনও মনে পড়ে সেই সোমবারটা, জানুয়ারির ৬ তারিখ, আর অন্য দশটা দিনের মতই, সেদিনই আমার কাছে সুখবর আসল, এবং স্ত্রীকে জানালাম- আমি চাঁদে নামতে যাচ্ছি!
মহাকাশযাত্রার সমগ্র ইতিহাসে দলনেতা সবসময়ই মহাকাশযানে থাকে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে এবং সহকর্মীরা বাইরে বেরিয়ে অন্যান্য কাজ করে, তাই আমিও ভেবেছিলাম চন্দ্রপৃষ্ঠে প্রথম পা আমারই পড়বে, যেহেতু নিল ছিল দলনেতা। কিন্তু যখন জানলাম নিল-ই হতে যাচ্ছে চন্দ্রপৃষ্ঠে পা দেওয়া প্রথম মানুষ যার অন্যতম কারণ সে একজন সিভিলিয়ান তখন এক হতাশাবোধ আমাকে গ্রাস করেছিল, আসলে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলাম, তাছাড়া মনে হয়েছিল সামরিক বাহিনীর প্রতি এটা এক ধরনের অপমানও। আর নিল নিজেও তো সমস্ত প্রশিক্ষণ সামরিক বাহিনী থেকেই পেয়েছে, আমার মতোই, কেবল সে পদত্যাগ করে সিভিলিয়ান হয়ে যাওয়ায় এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তা মানতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। অবশেষে সরাসরি নিলের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিই।
নিল খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমাকে বুঝিয়ে দেয় আমাদের মধ্যকার উষ্ণ বন্ধুত্বের কথা এবং জানিয়ে দেয় এই সিদ্ধান্ত তার না, অনেকে মিলে নেওয়া হয়েছে। তবে যেহেতু এটি বিশাল তাৎপর্যপূর্ণ তাই সে নিজেও চন্দ্রপৃষ্ঠে প্রথম মানুষ হওয়া থেকে বিরত থাকতে চায়নি। ভেবে দেখলাম, নিলই ঠিক বলেছে, তার উপরে সে ছিল মিশন কমান্ডার। কলম্বাস বা অন্যান্য অভিযাত্রীরাও কমান্ডার হিসেবে অজানা ভূমিতে প্রথম পা রেখেছিলেন।
যদিও বাবাকে ফোনে এই কথা জানানোর পড়ে তিনি খুবই ক্ষেপে গেলেন, তিনি বললেন সাধ্যমত চেষ্টা চালাবেন নাসার এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য, যদিও আমার যুক্তি এবং অনুরোধের মুখে তিনি নিমরাজি হয়েছিলেন ব্যাপারটি থেকে দূরে থাকতে।
আরেকটি ব্যাপার, আমরা নিজেদের মাঝে চিন্তা করে দেখলাম চন্দ্রপৃষ্ঠে আমাদের কাজের উপর নির্ভর করবে কে কখন কীভাবে বের হবে, সেই হিসেবে লুনার মডিউল পাইলট হিসেবে আমি ডান দিকে থাকব, আর নিল থাকবে বাম দিকে, যা কিনা বাইরে যাবার হ্যাচের কাছে। কাজেই আমি যদি প্রথম মানুষ হিসেবে চন্দ্রপৃষ্ঠে পা দিতে চাই সেক্ষেত্রে চাঁদে লুনার মডিউল নামার পরে আমাদের মাঝে আবার অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে, যা কোনো সুস্থবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। এই ভেবেই সান্ত্বনা পেলাম যে পাইলট হিসেবে ডান দিকে থাকার জন্যই নাহয় চাঁদে একটু পরে নামলাম! এই সিদ্ধান্ত আমার কাঁধের উপর থেকে বিশাল সব চিন্তা নামিয়ে দিল, আবার কেবল মিশন নিয়েই মনোনিবেশ করলাম। সবকিছুর পরও নভোচারীরা তো মানুষই, তাই না?
আমাদের তিনজনকে চন্দ্রযান এবং মূল মহাকাশযানের নামকরণ করতে বলা হয়েছিল, মাইক কমান্ডশিপের নাম দিয়েছিল কলাম্বিয়া, আমি আর নিল অনেক চিন্তা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতীক ঈগল থেকে চন্দ্রযানের নাম ঠিক করি, যদিও ঈগলের ছবিতে একটি জলপাই ডাল বহনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পরে। চন্দ্রপৃষ্ঠে যে স্মারক রেখে আসার কথা ছিল তাতে লেখা ছিল– We come in peace for all mankind, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট নিক্সন এটার একটা ভুল সংশোধন করে দিয়েছিলেন, ফলে শেষ কথা হয়েছিল We came in peace for all mankind। চাঁদের যেখানে আমাদের অবতরণের কথা সে স্থান শান্তি সাগর বা Sea of Tranquality নামে পরিচিত, তাই আমাদের অবস্থানের নাম ঠিক করা হল ট্রানকুয়ালিটি বেসক্যাম্প। অবশেষে ১৯৬৯-এর ১৬ জুলাই চন্দ্রপানে আমাদের যাত্রা শুরু হল (১৯৪৫-এর ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর এক গোপন জায়গায় বিশ্বের প্রথম আণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল) ।
স্পেসে ঠিক করা হয়েছিল আমাদের মুত্র বিশেষ প্রক্রিয়ায় মহাকাশযান দিয়ে বাইরে ফেলা হবে, সেই তরল সাধারণত চকচকে স্ফটিকে পরিণত হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, বাকি বর্জ্য বিশেষ প্রক্রিয়ায় কন্টেনারে রাখার ব্যবস্থা ছিল।
সমস্ত যাত্রাপথে আমাদের তিনজনেরও কেউই কোনোরকম অসুস্থ হয়ে পড়েনি, পরে দেখা গিয়েছিল সমস্ত অ্যাপোলো মিশনে আমাদের অ্যাপোলো- ১১ ছিল একমাত্র মিশন যেখানে একবারের জন্যও মেডিক্যালবক্স খোলার দরকার হয়নি।
চাঁদের পিঠ থেকে দূরত্ব ৬০ মাইল থাকতেই অবতরণ পক্রিয়া শুরু হলো, প্রায় ২৫ মিনিট জ্বালানি পুড়িয়ে অবতরণ চলতে থাকল, এর মাঝে আমি আর নিল করণীয় কাজগুলো সম্পর্কে আরেকবার আলোচনা ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম। অবতরণের পরে নিলের গলার ঘোষণা শোনা গেল– Houston, Tranquality base here. The Eagle has landed.
পৃথিবী থেকে রওনা দেবার পর আমি আর মাইক অনেকবার নিলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম চাঁদে পা দিয়ে প্রথম কথাটা কী বলবে সে, উত্তর ছিল- এখনও ভাবছি। অবশেষে নিলের অবতরণের সময় রাত ১০: ৫৬-তে শোনা গেল তার সেই বিখ্যাত অমর কথা– That's one small step for man, one giant leap for mankind.
এর ঠিক মিনিট পনের পরেই আমিও নামলাম চাঁদের ধুলো মাখা পিঠে, পর্যটকদের সমস্ত রীতি মেনে নিল আমার আগমনের ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এর পরপরই চাঁদের বুকে প্রথম মানুষ হিসেবে আমি একটি রেকর্ড করে ফেললাম সবার অজান্তে, মুত্রবিসর্জন করে ফেললাম (পোশাকের মাঝেই বিশেষ ব্যবস্থা ছিল), আফসোস, কেউ সেটা বুঝল না! সেই জবরজঙ পোশাকসহ আমার ওজন পৃথিবীতে ৩৬০ পাউন্ড হলেও চাঁদের দুর্বল মাধ্যাকর্ষণের জন্য সেখানে ছিল মাত্র ৬০ পাউন্ড। আমাদের বিশেষ স্মারকটা চন্দ্রযানের সামনেই রাখা হল, সেখানে লেখা ছিল– Here men from planet earth first set foot on the Moon. We came in peace for all mankind. July 1969, A.D, সেই সাথে ছিল প্রেসিডেন্ট এবং আমাদের ৩ জনের স্বাক্ষর (এই একটি জায়গা যেখানে বাজ নামে স্বাক্ষর করতে বেশি ইনফরমাল মনে হচ্ছিল), ভেবে অবাক হচ্ছিলাম কবে আবার মানুষ এই লেখা পড়বে!
চন্দ্রযানে ফেরত যাবার আগে একটা প্যাকেট চাঁদের ধুলোয় রেখে আসি, তাতে দুটো মেডেল ছিল নিহত দুই রাশান কসমোন্যাণ্টের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এবং অ্যাপোলো- ১ এর একজনের patch, আর ছিল আমার নিজের হাতে সোনা দিয়ে তৈরি চার জলপাই ডালের একটি, বাকি তিনটি অবশ্য আমাদের সাথেই রকেটে ভ্রমণ করছিল এবং সেগুলো ছিল আমাদের তিনজনের স্ত্রীর জন্য। আমাদের এত শত কাজের মাঝে আসলে দার্শনিক বা রোমান্টিক চিন্তা করতে একান্তভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। তাই চাঁদে অবস্থানের ২১ ঘণ্টা পুরোটাই ছিল পরিকল্পনা মোতাবেক, চারপাশে ঘুরঘুর করার কোনো সময় ছিল না। অবশেষে ফেরার সময় চলে আসল।
মহাকাশে এসে আবার কলম্বিয়া আর মাইকের সাথে দেখা হল, আর নীল গ্রহ ছেড়ে আসার ৯ দিন পরে আমরা আবার এর আবহাওয়া মণ্ডলে প্রবেশ করলাম। এই বই লেখা পর্যন্ত ১২ জন মানুষ চাঁদে গেছেন, চাঁদের পিঠ থেকে আমাদের অসম্ভব সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখেছেন। আমাদের সেই মিশন ছিল মানুষের কল্পনা এবং উদ্ভাবনীশক্তির এক অসাধারণ উদাহরণ।
বইয়ের বাকি অংশে অলড্রিন বলেছেন তার নানা পুরস্কার এবং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে পূর্বপুরুষের দেশ সুইডেনের কথা এবং বিশেষভাবে এসেছে কীভাবে ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে চাঁদ থেকে ফেরার মাত্র ২ বছরের মধ্যে তাকে মানসিক রোগের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল, কীভাবে নানা পরিস্থিতির চাপে তার পরিবার ভেঙ্গে গেল এই সব নিয়ে। বইয়ের শেষ প্যারা খুবই চিত্তাকর্ষক-
'আমি চাঁদে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ শুরু হয়েছিল যেখানে আগে কোনো মানুষের পা পড়েনি সেখান থেকে ফেরার পর। যখন এই বইটা লিখতে শুরু করি আমার মাথায় দুটো চিন্তা ছিল, আমি সৎ থাকার চেষ্টা করেছি যথাসম্ভব এবং জীবন ও ক্যারিয়ার নিয়ে যা সত্য মনে করেছি তাই বলেছি। The second and more important was that I wanted to stand up and be counted.'