মৃত পশুপাখির স্মরণে যে জাদুঘর
মানুষ বা জীবজন্তু মারা গেলে কী হয় বা কোথায় যায়? আমরা সবাই মোটামুটি জানি, মারা যাওয়ার পর মানুষ থেকে পশু, পাখি সব কিছুকেই মাটিচাপা দেওয়া হয়। তারপর ধীরে ধীরে একসময় তা পচে মাটির সাথে মিশে যায়। আগেকার দিনে মিশরের ফারাও রাজা ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের নানারকম ঔষধের প্রয়োগ করে মমি বানিয়ে মৃতদেহকে সংরক্ষণ করে রাখা হতো। বাংলাদেশেও রয়েছে মৃতদের জন্য এমন এক জাদুঘর। মারা যাওয়ার পর যেখানে মৃতদের নানা প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তবে মানুষ নয়, সেখানে রাখা হয় শুধু মৃত পশু-পাখি।
শিশুসহ উৎসুক জনতার ভিড় সবসময়ই লেগে থাকে জাতীয় চিড়িয়াখানায়। বিশেষ বিশেষ দিন ও সরকারি ছুটির দিনগুলোতে সে ভিড় যেন কয়েকগুণ হয়ে দেখা দেয়। এখানে আসা লোকদের বেশিরভাগই শখ করে বাচ্চাদের নিয়ে আসেন সামনে থেকে জীবন্ত প্রাণী তথা বাঘ, কুমির দেখাবেন বলে। কিন্তু একসময় এই প্রাণীরাই মারা গেলে তাদের ঠাঁই হয় চিড়িয়াখানার প্রাণী জাদুঘরে। কিছু প্রাণী জন্ম নেওয়ার পূর্বেই মারা যায়; সেগুলোকেও বোতলে ভরে দর্শনার্থীদের জন্য সাজিয়ে রাখা হয় জাদুঘরটিতে।
মৃত দেহে নেই প্রাণ, আছে কেবল চামড়া ও হাড়
চিড়িয়াখানার মূল ফটক থেকে হেঁটে খানিকটা ভেতরে এককোণে প্রাণী জাদুঘরটি অবস্থিত। চিড়িয়াখানায় ঢুকতে একবার টিকেট করতে হলেও জাদুঘরের জন্য রয়েছে আলাদা টিকেট ব্যবস্থা। জনপ্রতি মাত্র ১০ টাকার টিকেট মূল্য নিয়ে দেখা যাবে কালক্রমে হারিয়ে যাওয়া সেসব মৃত প্রাণীদের। এই প্রাণীরা একসময় চিড়িয়াখানার মূল আকর্ষণ ছিল। এখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু না হলেও একেবারে হারিয়ে যায়নি তাদের অস্তিত্ব। তাইতো মারা যাওয়ার পরেও নানা ঔষধ প্রয়োগে জ্যান্ত প্রাণীর ন্যায় রূপ ধরে রাখার জন্যে চলে নানা প্রচেষ্টা। কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রাণীগুলোর অবশিষ্ট দেহাবশেষের অবস্থাও বেশ নাজুক।
টিকেট নিয়ে জাদুঘরের গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়লো বিশাল আকারের এক তিমির কঙ্কাল। কাচের ভেতর বাদামি রঙে বার্নিশ করে রাখা কঙ্কালটির বিশালতা যে কাউকে মুগ্ধ করবে বলেই এটিকে গেটের মুখেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
জাদুঘরের ভেতরে ঢুকে যে কারও হঠাৎ মনে হতে পারে কোন গবেষণাগারে চলে এসেছেন। শখানেক প্লাস্টিকের জারে পানির মতো তরল একজাতীয় পদার্থের ভেতর সাজিয়ে রাখা হয়েছে পশুপাখিদের ডিম ও ভ্রুণ। এমনকি কিছু প্রাণীর চামড়াও একইভাবে বোতলে ভাঁজ করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। তিন ধাপে কাঠের টেবিলে সাজিয়ে রাখা বোতলগুলোর ওপরের সারিতে ছিলো বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে রাখা হয়েছে বিভিন্ন পাখি ও সরীসৃপের ডিম, বাচ্চা।
পরপর সাজিয়ে রাখা বোতলগুলোর একেকটিতে ছিল- অজগর সাপের বিশাল আকারের কয়েকটি ডিম, উটপাখির দুইটা ডিম (ডিমগুলো আকারে বড় হওয়ায় জারে মাত্র দুটি ডিম রাখা সম্ভব হয়েছে); পাশের বোতলগুলোতে সংরক্ষিত ছিল বিভিন্ন জাতের সাপ। সাপগুলোকে দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো যে মৃত। প্রতিটি বোতলের গায়ে সাপগুলোর কোনটি কোন জাতের তা লিখে রাখা হয়েছে- মণিরাজ, বংকরাজ, পংখীরাজ, শঙ্খিনি সাপ, বাঁশনল সাপ, সোনালি সাপ ও কাল সাপসহ কুমিরের সদ্যজাত বাচ্চা।
ঠাট্টার আসরে ও কাউকে অপদস্থ করতে প্রায়ই প্রচলিত একটি প্রবাদ শোনা যায়, "গন্ডারের চামড়া তাই গায়ে লাগে না"। গন্ডারের দেখা চিড়িয়াখানায় পাওয়া গেলেও, এটির চামড়ার কতখানি পুরু তা জানা ও দেখতে পাওয়া যাবে চিড়িয়াখানার এই জাদুঘরে।
টেবিলের এক কোণ থেকে অন্যকোণে যেতেই আরও চোখে পড়ে শিম্পাঞ্জির বাচ্চা (ভ্রুণ), উল্লুকের বাচ্চা, শুকরের বাচ্চা, হায়নার বাচ্চা ও বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী। বড় কাঁচ ঢাকা এক বাক্সে সবুজ সামুদ্রিক কচ্ছপকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। আকারে বড় বলে এর জায়গা হয়নি ছোট কোন বোতলে, তাইতো আলাদা করে বড় বাক্স বানিয়ে একে সাজিয়ে রাখা হয়েছে দর্শণার্থীদের জন্যে। পাশের আরেকটি কাঁচবন্দী বাক্সে ছিল মাঝারি আকারের দুটো শুশুক।
এছাড়াও বাঘ, চিতা বাঘ, কালো বাঘ, সাইবেরিয়ান টাইগার, জেব্রা, জিরাফ, কালো বানর, সাদা হনুমান, লাল পান্ডা ও ময়ুর থেকে শুরু করে নানান বড় পাখির সংরক্ষিত দেহ তো ছিলই।
বাবা-মায়ের সাথে চিড়িয়াখানা ও জাদুঘরে ঘুরতে আসা খুদে দর্শনার্থীদের কেউ কেউ বেশ আগ্রহভরে কাছ থেকে প্রাণীগুলোকে একমনে অবাক হয়ে দেখছিল। কেউ কেউ আবার আগ্রহ থেকে নানান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিলো।
৭ বছরের ছোট সামিয়া এসেছিল বাবা হাবিবুলের সাথে। তার খুব শখ ছিলো কাছ থেকে বাঘ, সিংহ দেখবে। তাই ছুটির দিনে বাবা তাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় চলে এসেছেন। জাদুঘরে মৃত সব প্রাণীদের একজায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মনে প্রশ্ন জাগলো, "বাবা বাঘ কেন নড়ছে না"? ঘুরতে ঘুরতে আরও কিছু প্রশ্ন শিশুটি তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলে, সেগুলো তিনি তার ছোট্ট মেয়েকে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলতে লাগলেন।
বছরের পর বছর প্রাণীগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখার ফলে বেশিরভাগের চামড়া বিবর্ণ ও ফ্যাকাসে হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে, এবং লোমও ঝড়ে পড়েছে। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পাখিগুলোর দেহ থেকেও পাখাগুলো নষ্ট হয়ে খসে পড়েছে। মৃত প্রাণীগুলোর নিথর দেহের যেটুকু অবশিষ্ট ছিলো নানা ঔষধ ও ক্যামিকেল প্রয়োগে, তাও যেন এখন জীর্ণ হয়ে কোনরকমে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
জাতীয় চিড়িয়াখানার জাদুঘর, যেখানে প্রতিদিন শতলোকের ভিড় জমে তার রক্ষণাবেক্ষণে কেন এ হাল তা জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যাচ্ছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত মিউজিয়াম অফিসার শাখাওয়াত হোসেন তেমন কোন তথ্য জানাতে পারেননি।
এমনকি প্রাণীরা মারা গেলে সেগুলোকে সংরক্ষণের জন্যে জাতীয় পর্যায়ের চিড়িয়াখানায় নেই কোন ট্যাক্সিডার্মিস্ট। পাঁচ বছর আগে দুজন ট্যাক্সিডার্মিস্ট ছিলেন, যাদের অবসরের পর এতো বছরেও নতুন করে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তাই জাদুঘরে সংরক্ষিত মৃত প্রাণীদের দেহ পোকামাকড় ও ঘুণে ধরে নষ্ট হয়ে গেলেও, হচ্ছে না সেগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা।
মৃতদের জাদুঘরে জীবিত প্রাণী!
চিড়িয়াখানার এই জাদুঘরে মৃত প্রাণীদের পাশের আরেকটি ঘরেই রাখা আছে বড় বড় কয়েকটি অ্যাকুরিয়াম। অ্যাকুরিয়ামগুলোতে মৃত নয়, রাখা হয়েছে নানা প্রজাতির জ্যান্ত সামুদ্রিক মাছ। কোনটিতে রাখা হয়েছে কমেট মাছ, কোনটিতে আছে গোল্ডফিশ, সিলভার ডলার, টাইগার শার্ক আবার ডোরাকাটা টাইগার বার্ব মাছ।
মিউজিয়াম অফিসার শাখাওয়াত হোসেন জানান, "বর্তমানে ৭৬ প্রজাতির প্রাণী সংরক্ষণ করে রাখা আছে এই জাদুঘরটিতে। কোন কোন প্রাণীকে কয়েক দশকের বেশি সময় ধরে ফরমালিন ও নানা কেমিক্যাল দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। প্রাণীগুলোর ওপরের চামড়া ও হাড় বার্নিশ করে রাখা হয় জীবিত প্রাণীর মতো রূপ দিতে। প্রাণীগুলোর দেহের ভেতরের সব ফেলে দিয়ে সেটিকে আকৃতি দিতে ভেতরে পুরে দেওয়া হয়েছে খড়ের নালা ও তুলা জাতীয় পদার্থ। কোন প্রাণী মারা গেলে সেটি জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য রাখা হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নিতে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে প্রাণীটিকে যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন বর্তমানে চিড়িয়াখানায় ক্যাঙ্গারু না থাকলেও জাদুঘরটিতে দেখা মিলবে কালক্রমে হারিয়ে যাওয়া এই প্রাণীর। এছাড়াও বিলুপ্ত প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে লাদাখ ছাগল, পাহাড়ি সিংহ ও বড় তিমি।"
চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরপরই বাংলাদেশ-জাপান দূতাবাসের অনুদানে জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়। পূর্বে প্রশাসনিক ভবনে এর অবস্থান হলেও পরবর্তীতে স্থানান্তরিত করে আলাদা ভবনে স্থাপন করা হয়। বর্তমানে জাদুঘর পরিষ্কার ও দেখাশোনার জন্য ৪ জন কর্মী ও ১ জন কর্মকর্তা থাকলেও নেই কোন ট্যাক্সিডার্মিস্ট। তাই গত কয়েকবছর ধরে নতুন কোন প্রাণীর স্থান হয়নি জাদুঘরটিতে। এমনকি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে পূর্বে সংরক্ষিত প্রাণীদের দেহাবশেষেরও বেহাল অবস্থা।