যেভাবে এই উপমহাদেশে কনডেন্সড মিল্ক এলো
প্রতিদিন এক গ্লাস গরম দুধ পান করলে শরীর সুস্থ ও সবল থাকবে, এ কথা কোন বাঙালি ছেলেমেয়েটি জীবনে একবার হলেও শোনেনি! কিন্তু গরুর খাঁটি দুধের দেখা মেলা আজকের জমানায় যেমন ভার, তা আজ থেকে আরও কয়েক শতক আগেও ছিল।
ভারতবর্ষে দুধে ভেজাল মেশানোর 'প্রথা' অনেক পুরনো। দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণেও ত্রুটি ছিল, বিভিন্ন অঞ্চলে দুধের সরবরাহও সবসময় ভালো পাওয়া যেত না। বিশেষ করে উপমহাদেশের শহরগুলোতে খাঁটি, বিশুদ্ধ গোদুগ্ধ আস্বাদন করা অনেক মধ্যবিত্তের জন্য বিলাসিতা ছিল।
তার ওপর তাজা দুধের চেয়ে দুগ্ধজাত অন্যান্য খাবারের প্রাধান্যই বেশি ছিল এ অঞ্চলে। দুধের ব্যবসা মূলত বাড়িভিত্তিক ছিল। গোয়ালারা দুধ থেকে ঘি, পনির, দই ইত্যাদি তৈরি করতো। ভারতবর্ষীয়দের জীবনে টাটকা দুধের চেয়ে দুধের ভিন্ন ভিন্ন রূপই বেশি দেখা মিলত।
ইউরোপীয়দের কাছে উপমহাদেশ বসবাসের অযোগ্য হিসেবে যেসব কারণ ধরা দিয়েছিল, তরল দুধের অভাব তার মধ্যে অন্যতম ছিল। 'দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার রয়াল বুক' (১৯১২) অনুযায়ী, খাঁটি তরল দুধ সহজে না মেলার কারণে উপমহাদেশ ইউরোপীয় শিশুদের জন্য 'বাস্তবিকভাবেই বসবাস-অযোগ্য' ছিল।
ব্রিটিশরা এ সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯ শতকের শেষ দিকে তারা সামরিক ডেইরি ফার্ম স্থাপন করতে শুরু করে। এই খামারগুলোতে গরুর দুধ, ননী, মাখন ইত্যাদি তৈরি করা হতো। তবে সচরাচর এগুলোর ভোক্তা ছিল সৈন্য ও তাদের পরিবারেরা।
এতে অবশ্য উপমহাদেশের অন্য শহরে বাস করা ইউরোপীয়দের দুধের সমস্যার সমাধান হলো না। তাদের কাছে উপমহাদেশের তরল দুধ তখনো দামি বা ভেজাল বস্তু হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে শেষ পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধানেরও দেখা মিলল। আর সেটি হলো তরল, ঘন ও সুস্বাদু কনডেন্সড মিল্কের মাধ্যমে।
সামরিক রসদ
ধারণা করা হয়, ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন উদ্ভাবক গেইল বর্ডেন 'সৈনিক, আবিষ্কারক, ও বণিকদের' খাবারের কথা চিন্তা করে কনডেন্সড মিল্ক আবিষ্কার করেন।
মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় কন্টিনেন্টাল আর্মি ক্যালোরির সহজ উৎস হিসেবে কনডেন্সড মিল্ককে বেছে নিয়েছিল। তারপর অন্যান্য সেনাবাহিনীও কনডেন্সড মিল্ককে তাদের খাবারের তালিকায় যোগ করে। ক্রমে এটি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার শহুরে পরিবার ও এসব অঞ্চলের উপনিবেশগুলোতে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ভারতবর্ষেও ঔপনিবেশিক জাহাজে করে কনডেন্সড মিল্কের আগমন ঘটে। স্থানীয় ইউরোপীয় যারা এতদিন স্বদেশের গরুর দুধ পান করতে পারতেন না, তারাও কনডেন্সড মিল্কের সুবাদে সে আক্ষেপ ঘোচাতে পারলেন।
বিশ শতকের শুরুতে অনেকগুলো ব্র্যান্ডের মিষ্টি ও মিষ্টিহীন কনডেন্সড মিল্ক পাওয়া যেত ভারতবর্ষের বাজারে। কিন্তু এ অঞ্চলে একটি ব্র্যান্ড শেষ পর্যন্ত কনডেন্সড মিল্কের সমার্থক হয়ে যায়। মিল্কমেইড নামক এ ব্র্যান্ডটির কনডেন্সড মিল্ক উপমহাদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে।
মিল্কমেইড (বা যেকোনো ধরনের) কনডেন্সড মিল্ক মূলত খাওয়া হতো চায়ের সঙ্গে, বিকেলের পাউরুটি বা বিস্কুটের সঙ্গে জলখাবারে। কখনো কখনো ক্ষীরের পরিপূরক হিসেব দায়িত্ব পালন করত মিল্কমেইড।
১৯৯০-এর দশকে আমুল ব্র্যান্ড তাদের নিজস্ব কনডেন্সড মিল্ক 'মিঠাই' বাজারে আনে। কিন্তু ভারতে মিল্কমেইডের জনপ্রিয় এতই ছিল যে, আমুলের কনডেন্সড মিল্ক দেশটিতে 'আমুলের মিল্কমেইড' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ভারতবর্ষে মিল্কমেইডের জয়ের গল্প উপনিবেশবাদ, পুঁজিবাদ ও ভাগ্যের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। গেইল বর্ডেন কনডেন্সড মিল্ক তৈরি করার পর ব্রিটেন ও এর কলোনিগুলোতে এটি সবচেয়ে বেশি চলতে লাগল। চার্লস ও জর্জ পেজ নামক দুই ভাই ১৮৬৬ সালে সুইজারল্যান্ডে অ্যাংলো-সুইস কনডেন্সড মিল্ক কোম্পানি গঠন করেন।
এই পেজ ভ্রাতৃদ্বয়ই মিল্কমেইড ব্র্যান্ডটি প্রতিষ্ঠা করেন। একদম সূচনালগ্ন থেকেই সাফল্যের মুখ দেখতে থাকে ব্র্যান্ডটি। ১৮৬৮ সালেই প্রায় তিন লাখ ৭৪ হাজার কার্টন মিল্কমেইড বিক্রি হয় ব্রিটেন ও এর কলোনিগুলোতে।
এর কয়েকদশকের মধ্যেই ভারতীয় উপমহাদেশ ও এশিয়ার অন্যান্য স্থানে কনডেন্সড মিল্কের সমার্থক হয়ে ওঠে মিল্কমেইড। কলোনিয়াল বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বার্মায় (অধুনা মিয়ানমার) মিল্কমেইড এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, এর টিনের কোটাগুলো চাল মাপার আদর্শ উপকরণ হিসেবে দেশটিতে ব্যবহৃত হতে শুরু হয়। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলেও এখনো চাল মাপার পাত্র হিসেবে কনডেন্সড মিল্কের কৌটার ব্যবহার দেখা যায়।
অ্যাংলো-সুইসের মিল্কমেইডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার চেষ্টা করে আরেক সুইস ব্র্যান্ড নেসলে। যদিও কোম্পানিটি ১৮৭০-এর দশকে নিজেদের কনডেন্সড মিল্ক বাজারজাত করে, জনপ্রিয়তার দিক থেকে সেটি মিল্কমেইডের ধারেকাছেও ছিল না। কিন্তু ১৯০৫ সালে এ দুই সুইস কোম্পানি একত্রিত হয়ে যায়।
অ্যাংলো-সুইসের সঙ্গে একীভূতের পর নেসলে সারাবিশ্বে নিজস্ব অফিস খুলতে শুরু করে। তৎকালীন ভারতে ১৯১২ সালে নিজেদের দপ্তর চালু করে নেসলে।
ভারতবর্ষে কনডেন্সড মিল্ক ইউরোপীয়দের জন্য আমদানি করা হলেও খুব দ্রুতই নেটিভরা এ খাবারের স্বাদের ফাঁদে পড়ে। যদিও প্রথমদিকে দাম, ধর্মীয় বিশ্বাস ও কারখানায় বানানো খাবারের প্রতি সাধারণ অবিশ্বাসের কারণে গোঁড়া হিন্দুরা কনডেন্সড মিল্ক গ্রহণে আপত্তি করেছিল, কিন্তু অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্ম যেকোনো ধরনের বিদেশি খাবারের ব্যাপারে উৎসুক ছিল।
নেসলে'র মিল্কমেইডের প্রথমদিকের বিজ্ঞাপনগুলোতে গরুর দুধ পানের পুষ্টিগুণ বিষয়ে আলোকপাত করা হতো। তাদের বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য ছিল নারী ও শিশু। কনডেন্সড মিল্ক শিশু ও কিশোরদের জন্য অতি উত্তম খাবার- এমন বার্তাই থাকত ওই বিজ্ঞাপনগুলোতে। এ কৌশল কার্যকরী হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন কনসেন্ট্রেটেড মিল্ক ১৯২৮-এ লেখা হয়: 'অনেক হিন্দুই তাদের সন্তানদের কনডেন্সড মিল্ক খাওয়ানো বাড়িয়ে দিয়েছেন।'
দেশভাগের আগে উপমহাদেশে আরও অনেক ব্র্যান্ডের কনডেন্সড মিল্ক পাওয়া যেত। কিন্তু জনপ্রিয়তায় মিল্কমেইডই শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছিল সবসময়। ১৯২৬ সালে মহাত্মা গান্ধী তার এক কাছের বন্ধুকে এক চিঠিতে নেসলের কনডেন্সড মিল্ককে সমুদ্রযাত্রায় টাটকা দুধের বিকল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। স্রেফ মিল্কমেইড খেয়েই দিব্যি বেঁচে থাকা যায় বলেও অভিমত প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
দেশভাগের পরবর্তী দশকগুলোতে ভারত ও বাংলাদেশে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেয় নেসলের মিল্কমেইড। দুধের মতো এটিকে রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করার হ্যাপা ছিল না। কক্ষ তাপমাত্রায় দীর্ঘদিন ধরে ভালো থাকত মিল্কমেইড।
এরপর ভারত সরকার দুধের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য 'অপারেশন ফ্লাড' পরিচালনা করে। এর মাধ্যমে ভারতে খাঁটি তরল দুধ সরবরাহের হার বেড়ে যায়। ফলে টিকে থাকার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হয় মিল্কমেইডকে।
১৯৮০'র দশকে নতুনভাবে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় মিল্কমেইড। এবার মানুষ মিল্কমেইডকে বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাবার যেমন লাড্ডু, হালুয়া, পায়েস, কুলফি, আইসক্রিম ইত্যাদি তৈরির অন্যতম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু করে। এমনকি মিল্কমেইড দিয়ে তৈরি করা যায় এমন সব খাবারের একটি রেসিপি বইও প্রকাশ করে নেসলে।
এদিকে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কনডেন্সড মিল্ক ছিল ব্লু ক্রস, পরে আসে স্টারশিপ, ডেনিশ। একসময় গোয়ালিনী নামেও এখানে একটি কনডেন্সড মিল্ক বাজারে পাওয়া যেত, তবে এটা আদি মিল্কমেইডের বাংলা নাম কিনা কে জানে!
- সূত্র: স্ক্রল ডট ইন
- মূল লেখা: প্রিয়দর্শিনী চ্যাটার্জি