মনের মতো জীবন কাটাতে কত টাকা প্রয়োজন!
আপনার স্বপ্নের জীবন কেমন হবে একবার ভাবুন তো? আপনি কেমন জায়গায় থাকতে চান, কিভাবে অবকাশযাপন করতে চান, নিজের কোন কোন শখ পূরণ করতে চান, কী কী খাবার খেতে চান, কোন ধরনের পোশাক পরতে চান- আচ্ছা, আপনারও কি রয়েছে হাজারো অপূর্ণ শখ?
সত্যিটা হলো, পৃথিবীর খুব অল্পসংখ্যক মানুষই নিজের সব শখ পূরণ করতে পারে, বাকিরা পারে না। কিন্তু কেন? এর একটি প্রধান কারণ, টাকা! মানুষের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা নেই।
তাহলে একজন মানুষের জীবনের সব শখ পূরণ করতে ঠিক কত টাকার প্রয়োজন? হঠাৎ কেউ আপনাকে এই প্রশ্ন করলে চট করে জবাব দেওয়া মুশকিল। আমরা সবাই জানি, আমাদের অনেক টাকার প্রয়োজন, কিন্তু টাকার অংকটা ঠিক কত, তা ভাবনার বিষয় বটে!
সম্প্রতি 'ন্যাচার সাসটেইনেবিলিটি' জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন গবেষকরা। বিশ্বের ৩৩টি দেশের ২২০ জন মানুষের উপর জরিপ চালিয়েছেন তারা। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কাছে প্রশ্ন ছিল, নিজের স্বপ্নের-আদর্শ জীবনযাপন করতে তাদের কী পরিমাণ সম্পদ বা টাকা প্রয়োজন? তাদেরকে আরও জিজ্ঞেস করা হয়, যদি কখনো লটারি জিতেন, তাহলে কী পরিমাণ টাকা তারা পুরস্কার হিসেবে পাওয়ার আশা করেন? তাদের সামনে বিকল্পগুলোর মধ্যে ছিল সর্বনিম্ন ১০,০০০ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ১০০ বিলিয়ন ডলার। শেষোক্ত টাকার অংকটি আসলে সীমাহীন সম্পদের সমান বলেই মনে করছেন গবেষকরা।
পাঠকদের অনেকেই হয়তো মনে করছেন, বেশিরভাগ মানুষ ১০০ বিলিয়ন ডলার পুরস্কারকেই বেছে নিবেন। কারণ অর্থনীতি বলে, মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই, নিজের প্রিয় জিনিস চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা কখনোই তৃপ্ত হয় না। আর সে কারণেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। আর সেই একই কারণে ইলন মাস্ক ও জেফ বেজোসের মতো ধনকুবেরদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার থাকার পরেও তাদের টাকা উপার্জনের নেশা কমে না। শুধু তাই নয়, আপনার হাতে যত বেশি টাকা থাকবে, তত বেশি বিকল্প সামনে আসবে... কারণ সম্পদ যখন অফুরন্ত, তখন সম্ভাবনাও অফুরন্ত!
কিন্তু 'ন্যাচার সাসটেইনেবিলিটি' জার্নালের এই গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষ ভাবে না যে তাদের স্বপ্নের জীবনযাপনের জন্য সীমাহীন সম্পদ প্রয়োজন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই লটারি জেতার পুরস্কার হিসেবে পরিমিত পরিমাণ (এবং আনুমানিক) সম্পদ চেয়েছেন, যা ছিল ১ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে ৩৮ বছর বয়সী একজন মানুষের আয়ুষ্কাল যদি ধরা হয় ৭৮ বছর, তাহলে দেখা যায় ১ মিলিয়ন ডলার পেলে তার বার্ষিক খরচ মাত্র ২৫,০০০ ডলার।
গবেষণার লেখকদ্বয়- মনস্তাত্ত্বিক গবেষক পল বেইন এবং রেনাটা বোনিওর্নো বলেন, এই গবেষণা থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় উঠে এসেছে। আর তা হলো- কিভাবে আমাদের পারিপার্শ্বিক সংস্কৃতি অতিরিক্ত ভোগবাদকে স্বাভাবিকীকরণ করে।
পল বেইন বলেন, "মানুষের চাহিদা সীমাহীন- এই মতাদর্শটিকে যখন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়, তখন সমাজে যাদের প্রচুর অর্থবিত্ত নেই তাদের উপর এটি এক ধরনের সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে এবং তারা সত্যিকারের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কেনাকাটা করে।"
তিনি আরো যোগ করেন, "আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষের কাছেই স্বপ্নের জীবন বলতে আহামরি কিছু নয়। বরং তাদের এই সহনীয় পর্যায়ের চাহিদা বুঝিয়ে দেয় যে, কেউ যদি এভাবে জীবনযাপন করে সত্যিই সুখী থাকে তাহলে তা সামাজিকভাবে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত।
টাকা দিয়ে কী সুখ কেনা যায়?
অবশ্যই সব দেশেই কিছু না কিছু মানুষ থাকে যাদের চাহিদার কোনো শেষ নেই, যারা নিজেদের তৃপ্ত করতে যতটা সম্ভব সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায়। গবেষণায় পরিচালিত দুটি জরিপের একটিতে দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ আমেরিকান লটারিতে ১০০ বিলিয়ন ডলারই জিততে চান; অন্যদিকে চীনে এই ১০০ বিলিয়ন ডলার চাওয়া মানুষের সংখ্যা মাত্র ৮ শতাংশ।
দ্বিতীয় জরিপে দেখা গেছে, লটারিতে সবচেয়ে মোটা অংকের টাকা জিততে চাওয়া মানুষের সংখ্যা ইন্দোনেশিয়ায় বেশি (৩৯ শতাংশ)। অন্যদিকে, রাশিয়ার মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ লটারিতে ১০০ বিলিয়ন ডলার চেয়েছেন।
তবে যারা ১০০ বিলিয়ন ডলার বা সীমাহীন সম্পদ চেয়েছেন, তারা যে শুধুমাত্র স্বার্থপরতা বা লোভের কারণে চেয়েছেন তা নয়। এ গবেষণায় 'আদর্শ জীবন বা স্বপ্নের জীবন' কেমন হবে তার কোনো পরিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। অংশগ্রহণকারীরা যার যার মতো করে নিজেদের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার সীমা নির্ধারণ করেছেন এবং সে অনুযায়ী টাকার অংক বেছে নিয়েছেন।
যদিও গবেষকরা জানিয়েছেন, যারা ১০০ বিলিয়ন ডলার নিতে চেয়েছেন তারা সবাই সামাজিক ইস্যু নিয়ে কাজ করতে চান বলে দাবি করেন। কিন্তু দিনশেষে সবাই নিজেদের ব্যক্তিগত চাহিদা ও পরিবার-পরিজনের পেছনেই টাকা ব্যয় করার কথা জানিয়েছেন।
এ গবেষণাটির সঙ্গে আগের একটি গবেষণারও যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে। টাকা ও সুখের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল তখন। গবেষণায় বলা হয়, একটা পর্যায়ে গিয়ে মানুষের মনে হয় অঢেল অর্থসম্পদ মানে অনেক সুখ। কিন্তু গবেষণায় এও দেখানো হয়েছে যে একটি কাটঅফ পয়েন্ট আসে যখন গড়পড়তা ব্যক্তির কাছে মনে হয়, টাকা মানেই সুখ নয়। (যুক্তরাষ্ট্রে এই কাটঅফ পয়েন্ট হলো যখন কোনো পরিবারের বার্ষিক আয় ১০৫,০০০ ডলারে দাঁড়ায়।)
জীবনধারণ করতে, ভালোভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে টাকার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন অনেক সময়ই বড় পার্থক্য গড়ে দেয়। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়ার পরেও টাকা আমাদের আরো বড় স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করে এবং এভাবেই ব্যক্তিকে সুখ এনে দেয়।
নতুন এ গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে যা বোঝা যায় তা হলো, বেশিরভাগ মানুষই যে ধরনের জীবনের স্বপ্ন দেখে তা পূরণ করতে অতটা টাকারও দরকার হয়না যা বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কাছে আছে। বরং গবেষকরা বলছেন, মানুষ স্বস্তি ও শান্তির জীবন চায়, বেহিসাবী জীবন নয়।
- সূত্র- কোয়ার্টজ ডট কম