আর্টেমিস ১: নাসা'র নতুন চন্দ্রাভিযানের শুভ সূচনা
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেইস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)-এর জন্য ২০২২ সালটা সোনালি বছর হয়ে থাকবে। ২০২১ সালে ডিসেম্বরে উৎক্ষেপণের পর এ বছর জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) গভীর মহাকাশের দুর্দান্ত সব ছবি পাঠিয়েছে। আর সে সাফল্য উদযাপনের রেশ ফুরোতে না ফুরোতেই নতুন মিশন শুরু করেছে নাসা। এবার চাঁদের কক্ষপথে রকেট পাঠাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এর ধারাবাহিকতায় আগামী ২০২৫ সালে মধ্যে আবারও চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে নাসা'র।
আর্টেমিস ১ নামক এ মিশনটির সূচনা ঘটবে আগামীকাল ২৯ আগস্ট। এখন পর্যন্ত নাসা'র তৈরি করা সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এসএলএস)-এ করে অরিয়ন নামক একটি স্পেস ক্যাপসুল চাঁদের দিকে উৎক্ষেপণ করা হবে। এ মিশনে কোনো মানুষ নভোচারী থাকবে না, কারণ এটি একটি পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ। এর মাধ্যমে নাসা তাদের ভবিষ্যৎ মিশনের সার্বিক সক্ষমতা ও সম্ভাব্যতা যাচাই করবে।
এ মিশনে অরিয়ন স্পেসক্রাফটি চাঁদের মাটি স্পর্শ করবে না। কিন্তু এটি চাঁদকে একটি বড় কক্ষপথে কেন্দ্র করে ঘুরবে। আর এখন পর্যন্ত মানুষের চড়ার উপযোগী করে বানানো কোনো স্পেসক্রাফটের এটাই হবে মহাকাশের সবচেয়ে দূরে যাওয়ার ঘটনা। এ মিশনে কোনো মানুষ না থাকলেও হেলগা, জোহর, ও মুনিকিন ক্যাম্পোস নামক তিনটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ম্যানিকিন রেখেছে নাসা। এত দীর্ঘ ভ্রমণে এদের ওপর কী কী প্রভাব পড়বে তা পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যাবে মানুষ নভোচারীরা এ ধরনের মিশনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেন।
নাসা'র এ মিশনের প্রাথমিক লক্ষ্য চাঁদ হলেও মূল লক্ষ্য হচ্ছে মঙ্গলযাত্রার উপযোগিতা পরীক্ষা করা। ফ্লোরিডা'র কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চপ্যাড ৩৯বি থেকে সোমবার রকেটটি উৎক্ষেপণ করা হবে। এখান থেকেই অ্যাপলো মিশন উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। এসএলএস রকেটের চূড়ায় বসানো হয়েছে অরিয়ন স্পেসক্রাফটি। মূল রকেটের সঙ্গে রয়েছে আরও দুইটি সলিড রকেট বুস্টারও। পুরো রকেটের ৯০ শতাংশই জ্বালানি দিয়ে ভর্তি। এটি ৪০ লাখ কেজি থার্স্ট (ধাক্কা) উৎপাদন করতে সক্ষম। ৩২২ ফুট উঁচু এ রকেটটি উৎক্ষেপণের পর বিভিন্ন পর্যায়ে এটির নানা অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সর্বশেষ অরিয়ন স্পেসক্রাফটি চাঁদকে আবর্তন করে পাক খাবে। মোট ৪২ দিন ধরে এ মিশনটি চলমান থাকবে।
উৎক্ষেপণের দুই মিনিট পর সলিড বুস্টার জোড়া খুলে গিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পড়বে। আট মিনিটের মাথায় রকেটের মূল অংশটিও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এরপর একবারের জন্য পৃথিবী প্রদক্ষিণ করবে অরিয়নসহ রকেটের বাকি অংশটি। ফ্লাইটের ৯০ মিনিট সময় অরিয়ন চাঁদের দিকে যাত্রা শুরু করবে।
নাসা'র এ প্রজেক্টে কাজ করছে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানিও। চাঁদে পৌঁছানোর জন্য স্পেসএক্সের স্টারশিপ রকেট ব্যবহার করা হবে আর্টেমিস মিশনে। বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি বর্তমানে কম খরচে রকেট প্রযুক্তি তৈরি করছে। আর আর্টেমিস ১-এর জন্য নাসা এখন পর্যন্ত চার বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। পুরো প্রকল্পটির সম্পন্ন করতে নাসাকে খরচ করতে হবে ৯৩ বিলিয়ন ডলার। সেজন্য কংগ্রেস নাসাকে এ মিশনের তহবিল দিতে একটু উষ্মা প্রকাশ করেছে। বাজেটের এ সমস্যা ও কিছু প্রাযুক্তিক চ্যালেঞ্জের কারণে আর্টেমিস মিশন ইতোমধ্যে বিলম্বের শিকার হয়েছে।
অরিয়ন ক্যাপসুলের সঙ্গে চাঁদের কক্ষপথে যাচ্ছে সাধারণ মহাকাশ ফ্যানদের নামও। ঐতিহ্য অনুযায়ী, নাসা সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানিয়েছিল তাদের নাম জমা দেওয়ার জন্য। নাসা'র একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এ নামগুলো জমা দিয়েছিল মানুষজন। এরপর সেগুলো একটি ফ্ল্যাশড্রাইভে করে অরিয়নে রাখা হয়েছে। এভাবে প্রায় ৩৪ লাখ নাম যাচ্ছে মহাকাশে।
আর্টেমিস প্রকল্পটি নাসা'র জন্য একটি মহাকর্মযজ্ঞ। নাসা'র লক্ষ্য হলো চাঁদে মানুষ পাঠানো, মানুষের একটি বসতি স্থাপন করা, ও চাঁদের কক্ষপথে লুনার গেইটওয়ে নামক একটি স্পেস স্টেশন তৈরি করা। মোট তিনটি মিশন পরিচালনা করবে নাসা। আর্টেমিস ১-এর পর ২০২৪ সালে আর্টেমিস ২ একই ধরনের মিশন হবে। তবে সেক্ষেত্রে ম্যানিকিনের বদলে মানুষ যাবে চাঁদের কক্ষপথে। আর ২০২৫ সালে আর্টেমিস ৩-এ চড়ে আবারও চাঁদের বুকে পা রাখবে মানুষ। তবে এবারের মিশনটি আরও একদিক থেকে অনন্য। এ প্রথমবারের মতো কোনো নারী ও কোনো আফ্রিকান-আমেরিকান চন্দ্রপৃষ্ঠে পদার্পণ করবেন।
আর্টেমিস ১ বিভিন্ন মিশন পরিচালনা করার জন্য ১০টি অতিক্ষুদ্র স্যাটেলাইট (কিউবস্যাট) পরিবহন করবে। এগুলো সূর্য, চাঁদ, ও পৃথিবীর কাছাকাছি থাকা গ্রহাণু পর্যবেক্ষণের কাজ করবে। ফেরার সময়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৩৯,৫০০ কিলোমিটার বা মাক ৩২ গতিতে প্রবেশ করবে অরিয়ন। এর ফলে ক্যাপসুলটির বাইরের অংশে তাপমাত্রা পৌঁছাবে ২৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। সব ঠিক থাকলে চাঁদের কক্ষপথে আবর্তন শেষে আগামী ১০ অক্টোবর প্রশান্ত মহাসাগরে পতিত হবে অরিয়ন ক্যাপসুলটি। এরপর সাগর থেকে উদ্ধার করা হবে স্পেসক্রাফটিকে।
মঙ্গলের বুকে মানুষ পাঠানোর জন্য চাঁদকে 'যাত্রাবিরতি' কেন্দ্র হিসেবে তৈরি করতে চাইছে নাসা। ২০৩০-এর দশকের শেষের দিকে মঙ্গলে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও সফল এ মহাকাশ সংস্থার। তাই আর্টেমিস প্রজেক্টটি স্রেফ অ্যাপোলো প্রোগ্রামের আধুনিক কোনো সংস্করণ নয়, বরং এর মাধ্যমে মহাকাশে মানুষের আধিপত্য আরও বিস্তার করার পথে যাত্রা শুরু করলো নাসা।
সূত্র: ভক্স, স্পেস ডটকম, ইউরোনিউজ