শুক্রগ্রহে প্রথম প্রাইভেট মিশনে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজা হবে কেবল ৫ মিনিটের জন্য
২০২০ সালে বিজ্ঞানীরা শুক্রগ্রহে হঠাৎ ফসফিন গ্যাসের চিহ্ন দেখতে পেলেন। এ গ্যাসটি আমাদের পৃথিবীতে জৈবিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়। তাই শুক্রে এর অস্তিত্ব কোত্থেকে এল তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে প্রশ্ন তৈরি হলো।
তবে কি শুক্রে কোনো মাইক্রোবায়াল প্রাণের অস্তিত্ব আছে যা থেকে এ গ্যাস উদ্গিরিত হচ্ছে? বিজ্ঞানীদের এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই আগামী বছর গ্রহটিতে একটি মিশন পরিচালনা করা হবে।
যদিও পরবর্তী গবেষণাগুলোতে ফসফিনের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, প্রথমদিকে গ্যাসটি আবিষ্কারের পর শুক্রগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ পুনরায় তুঙ্গে উঠেছিল। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা ও ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) শুক্রগ্রহে গিয়ে ঘটনার অনুসন্ধানের জন্য তিনটি মিশনের পরিকল্পনা করে। বিজ্ঞানীদের অন্যান্য প্রশ্নের মধ্যে আরও একটি প্রশ্ন হলো, এখন না হলেও অতীতে কি শুক্রগ্রহ প্রাণধারণের জন্য উপযোগী ছিল কিনা। চীন ও ভারতেরও শুক্রে মিশন পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কলিন উইলসন ইউরোপের শুক্র মিশন এনভিশন-এর একজন উপ-প্রধান বিজ্ঞানী। তিনি বলেন, 'ফসফিন পাওয়ার পর আমরা বুঝতে পারলাম শুক্রের চরিত্র সম্পর্কে আমার কত কম জানি।'
কিন্তু শুক্র নিয়ে পরিকল্পিত এ মিশনগুলোর ২০২০-এর দশকের শেষদিকে বা ২০৩০-এর দশকের শুরুর আগে কোনো ফলাফর জানাতে পারার সম্ভাবনা নেই। অথচ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা চান যত দ্রুত সম্ভব সব রহস্যের উত্তর জানতে। নিউজিল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রকেট ল্যাব রকেট উৎক্ষেপণের সেবা প্রদান করে থাকে। এটির সিইও পিটার বেক। বেকের সঙ্গে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অভ টেকনোলজি'র (এমআইটি) একদল বিজ্ঞানী যোগাযোগ করেন। এ দুপক্ষ মিলে এখন শুক্রগ্রহে রকেট ল্যাবের নিজস্ব রকেট ব্যবহার করে মিশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের লক্ষ্য ২০২৩ সালে মিশনের জন্য শুক্রের পথে রকেট উৎক্ষেপণ করা।
ফসফিনের অস্তিত্ব বিজ্ঞানীরা পেয়েছিলেন শুক্রগ্রহের মেঘের মধ্যে। তবে তারা মনে করেন, যদি শুক্রে প্রকৃতই প্রাণের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে সেটা গ্রহটির পৃষ্ঠ থেকে অনেক ওপরে ভেসে থাকা সালফিউরিক এসিডের ক্ষুদ্র ফোঁটার ভেতরে মাইক্রো-অর্গানিজমের রূপে নেই। শুক্রের পৃষ্ঠদেশ প্রায় বসবাসের অযোগ্য। এখানকার তাপমাত্রায় সীসা পর্যন্ত গলিয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখে। আর শুক্রের পৃষ্ঠতলে চাপের পরিমাণ পৃথিবীর যেকোনো সমুদ্রের তলদেশে চাপের পরিমাণের সমান। তবে গ্রহটির পৃষ্ঠদেশ থেকে ৪৫-৬০ কিলোমিটার ওপরে ভেসে থাকা মেঘের অঞ্চলে তাপমাত্রা তুলনামূলক নাতিশীতোষ্ণ।
রকেট ল্যাবের এ মিশনটি অন্য কোনো গ্রহে প্রথমবারের মতো ব্যক্তি-উদ্যোগে পরিচালিত কোনো মিশন। প্রতিষ্ঠানটি ফোটন নামক একটি ছোট ও বহুমুখী স্পেসক্রাফট তৈরি করেছে। এটির আকার একটি ডাইনিং টেবিলের মতো। এ রকেট সৌরজগতের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো সম্ভব। গত জুন মাসে নাসা'র জন্য চাঁদে একটি মিশন পরিচালনা করেছে রকেট ল্যাব। শুক্রের মিশনের ক্ষেত্রে ফোটন স্পেসক্রাফটে করে একটি প্রোব গ্রহটির নভোমণ্ডলে পাঠাবে এটি।
এমআইটি-তে সারা সিগারের অধীনে ৩০ জনের চেয়ে ছোট একটি দল এ প্রোবটি বর্তমানে তৈরি করছে। ২০২৩ সালের মে মাসে এটি উৎক্ষেপণ করা হলে শুক্রের কাছে পৌঁছাতে এর পাঁচ মাস সময় লাগবে। মিশনটির তহবিল যোগাচ্ছে রকেট ল্যাব, ও এমআইটি; আর সঙ্গে আছেন আরও কিছু অজানা ব্যক্তি। এ মিশনের ঝুঁকি বেশি থাকলেও এটির খরচ কম, কেবল ১০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে এর পেছনে। এ পরিমাণ অর্থ নাসা'র যেকোনো শুক্র মিশনের কেবল দুই শতাংশ।
ফোটনের পরিবহন করা প্রোবটিও স্বভাবতই আকারে ক্ষুদ্র; ভর সাড়ে ২০ কেজি, ব্যাস ১৫ ইঞ্চি। শুক্রের আকাশে প্রোবটি ঘণ্টায় ৪০ হাজার কিলোমিটার গতিতে প্রবেশ করার সময় যে তাপ তৈরি হবে তা থেকে বাঁচার জন্য কোণাকৃতির নকশার এ প্রোবটির সামনে রয়েছে একটি তাপমাত্রা প্রতিরোধী আবরণ।
প্রোবটির ভেতরে কেবল এক কেজি ভরের একটি একক ইকুইপমেন্ট বসানো হবে। এ প্রোবে কোনো ক্যামেরার ব্যবস্থা রাখা হবে না। কারণ যখন শুক্রের মেঘের ভেতর দিয়ে এটি পড়তে থাকবে, তখন ছবি তোলা ও সেটা পৃথিবীতে ফেরত পাঠানোর জন্য পর্যাপ্ত বেতার তরঙ্গের শক্তি পাওয়া যাবে না।
ছবি না থাকলে তাহলে বিজ্ঞানীরা কীভাবে তাদের অনুসন্ধান চালাবেন? আসলে তাদের উদ্দেশ্য ছবি নয়, বরং শুক্রগ্রহের মেঘপুঞ্জকে কাছ থেকে দেখা। আর এ কাজটি করবে একটি অটোফ্লুরেসিং নেফেলোমিটার যন্ত্র। এ ডিভাইসটি শুক্রের নভোমণ্ডলের বিভিন্ন কণার ওপর একটি অতিবেগুনি লেজার নিক্ষেপ করবে। লেজারের সংস্পর্শে এসে মিথস্ক্রিয়া প্রদর্শন করবে ওই কণাগুলো। এর মাধ্যমে জানা যাবে সেগুলো আদতে কী উপাদান দিয়ে তৈরি।
'আমরা শুক্রের মেঘের বিন্দুগুলোতে কোনো জৈবিক কণিকা আছে কিনা তা খুঁজতে চেষ্টা করব,' জানান সিগার। তবে জৈবিক কণিকা থাকলেও তা-তে শুক্রে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণিত হবে না। কারণ জৈবিক প্রক্রিয়া ছাড়াও এ ধরনের কণা তৈরি হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের কণার অস্তিত্ব থাকলেও বিজ্ঞানীরা শুক্রকে সম্ভাব্য বাসযোগ্য গ্রহ হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবেন।
তবে রকেট ল্যাবের এ মিশনটিতে ফসফিন খোঁজা হবে না, কারণ এর জন্য যে যন্ত্রের প্রয়োজন তা ওই প্রোবটিতে আঁটানো যাবে না। ২০২৯ সালে নাসা'র ডাভিন্সি+ মিশনে ফসফিনেরে অনুসন্ধান করা যাবে।
স্পেসক্রাফট থেকে প্রোবটি শুক্রগ্রহের নভোমণ্ডল লক্ষ্য করে পতন শুরু করার পর মেঘের ভেতরে অনুসন্ধান পরিচালনা ও তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য পৃথিবীকে পাঠানোর জন্য এটি কেবল মিনিট পাঁচেক সময় পাবে। শুক্রের মেঘের বাধা পার হওয়ার পর প্রোবটি যদি তারপরও টিকে থাকে, তখন বাড়তি ডেটা সংগ্রহ করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। শুক্রের নভোমণ্ডলে প্রবেশের ঘণ্টাখানেক পর প্রোবটি এর পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করবে। তার আগেই এটির সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
শুক্রে ফসফিন সন্ধানের প্রাথমিক গবেষণার পরিচালক জেন গ্রিভস মনে করেন এ মিশনে গ্রহটিতে জৈবিক উপাদান পাওয়ার বড় সুযোগ রয়েছে, যার দ্বারা বোঝা যেতে পারে শুক্রে প্রাণের অস্তিত্ব আছে।
সিগার আশা করছেন এটি কেবল শুক্রে অনুসন্ধানের শুরু। এ প্রাথমিক মিশনের পর তার দল গ্রহটিতে আরও মিশন পরিচালনার পরিকল্পনা করছে। এ পরিকল্পনায় আছে শুক্রের মেঘে বেলুন স্থাপন করা যেটি দিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালানো সম্ভব।
এ মিশনটি দেখাতে পারবে মহাকাশ গবেষণায় বেসরকারি সংস্থাগুলো কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। যেখানে নাসা'র মতো বড় সংস্থাগুলো মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের রকেট মহাকাশে পাঠাচ্ছে, সেখানে ছোট ও কমদামি স্পেসক্রাফট পাঠানোর কাজটি রকেট ল্যাবের মতো ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো করতে পারে। শুক্রের এ ছোট মিশনটি কি প্রথমবারের মতো মহাবিশ্বে এলিয়েনের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে যাচ্ছে? বেকের উত্তর, 'সম্ভাবনা কম, কিন্তু একবার চেষ্টা করাটা সবদিক থেকে উপযুক্ত।'
সূত্র: এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ