মায়োপিয়া প্রজন্ম: শিশুদের চশমা ব্যবহারের হার কেন বাড়ছে?
দীর্ঘ এক দশক ধরে অপটোমেট্রি হিসেবে চোখের পাওয়ার পরীক্ষা করেন মেরিনা। কিন্তু একটা জিনিস ইদানীং প্রায়ই তাকে চিন্তায় ফেলে দেয়, আর তা হলো ছোট ছোট বাচ্চাদের চশমা নেওয়ার প্রবণতা। এই শিশুদের অনেকের বাবা-মা চশমা ছাড়াই খুব ভালোমতো দেখতে পারেন। বাচ্চাদের চশমা লাগবে এমন পরামর্শে তারাও হতভম্ব হয়ে পড়েন।
মজার বিষয় হলো মেরিনা যখন চোখ নিয়ে পড়াশোনা করেন তখন মায়োপিয়া বা নিকটদৃষ্টি জিনগত একটি সমস্যা বলে পাঠ্যবইয়ে লেখা ছিল। বাবা-মার যেকোনো একজনের মায়োপিয়া থাকলে শিশুর চশমা নেওয়ার প্রবণতা দ্বিগুণ হয়। আর দুজনেরই এই সমস্যা থাকলে সম্ভাবনা বাড়ে পাঁচগুণ পর্যন্ত।
কিন্তু এর বাইরেও একটা জিনিস মেরিনাকে ভাবিয়ে তুলে। নতুন প্রজন্মের শিশুরা যেন সামগ্রিকভাবেই তাদের বাবা-মার প্রজন্মের তুলনায় অধিকহারে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যার ভুগছে। তিনি ভাবতে থাকেন এটা যদি স্রেফ জিনগত সমস্যাই হয় তাহলে এত নতুন শিশু কোথা থেকে আসছে?
একটা সময় মনে করা হতো জিনগত কারণে এশিয়ায় মায়োপিয়া আক্রান্তদের হার বেশি। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা মাত্র এক শতাব্দীর ব্যবধানে ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়ায়। চীনে মায়োপিয়া এত প্রকট যে তা জাতীয় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১.৪ বিলিয়ন মানুষের মাঝেও তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন সামরিক সদস্য ও পাইলট খুঁজে পেতে কাঠখড় পুড়াতে হচ্ছে তাদের। এমনকি কোভিডের লকডাউনের পর শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার সমস্যা আরও বাড়তে দেখা গেছে।
এশিয়ায় ক্ষীণদৃষ্টির প্রবণতা জিনগত সমস্যা হিসেবে বিশেষজ্ঞরা উড়িয়ে দিলেও সমস্যার পরিধি এখন আরও বিস্তৃত।
চলতি শতকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ১২ থেকে ৫৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৪২ শতাংশের মায়োপিয়া ধরা পড়ে যা ৭০-এর দশকের ২৫ শতাংশের মতো ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বড় কোনো জরিপ করা না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষু চিকিৎসকরা একমত যে মায়োপিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
ইউরোপেও বাবা-মা কিংবা দাদা-দাদীর প্রজন্মের তুলনায় শিশুদের নিকটদৃষ্টির সংখ্যা বাড়ছে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় বর্তমানে মায়োপিয়া আক্রান্তের হার সবচেয়ে কম। কিন্তু একসময় এশিয়াকে যেমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা হত তা আর এখন নেই। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে গবেষণা অনুসারে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হবে।
শিশুদের চশমা নিতে হবে এটাই কিন্তু মায়োপিয়ার বড় সমস্যা না। নিকটদৃষ্টির সমস্যা থাকা শিশুদের মধ্যবয়সে গ্লুকোমা ও রেটিনাল ডিটাচমেন্টের মতো গুরুতর জটিলতায় ভোগার প্রবণতা বেশি। এই সমস্যাগুলো স্থায়ী অন্ধত্বের কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে।
২০১৯ সালে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব অপথালমোলজি (এএও) মায়োপিয়াকে একটি জরুরি বিশ্ব-স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ঘোষণা দিতে টাস্ক ফোর্স গঠন করে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির অপথালমোলজির অধ্যাপক এবং এএও-র সরকার বিষয়ক মেডিকেল ডিরেক্টর মাইকেল রেপকার মতে, 'এটা এমন এক সমস্যা যা কয়েক দশক পরে আমাদের অন্ধত্বের এক মহামারির দিকে নিয়ে যাবে'।
কিন্তু দৃষ্টিশক্তির এই অবনতির পেছনের কারণটা হয়তো সহজেই ধরা যায়। আশেপাশে তাকালেই দেখা যাবে অসংখ্য শিশু ফোন, ট্যাবলেট ও ল্যাপটপে মুখ গুঁজে রয়েছে। আর চোখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে ক্রমাগত তাকিয়ে থাকার কারণে নিকটদৃষ্টি তৈরির বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকেই সতর্ক করছেন।
চার শতাব্দী আগে জার্মান অ্যাস্ট্রোনমার জোহানেস কেপলার বইয়ের দিকে তাকিয়ে সারাদিন পড়াশোনা করাকে তার ক্ষীণদৃষ্টির জন্য দায়ী করেন। ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থীদের মধ্যে চশমা পড়ার হার সামরিক সদস্যদের চেয়ে বেশি। ১৯ শতকের শেষে অপথালমোলজির বইয়ের মায়োপিয়ার চিকিৎসায় লেখা ছিল হাওয়া বদল করা। বিশেষ করে সমুদ্র ভ্রমণে যাওয়া, যেখানে গেলে চোখ দূর-দূরান্তে তাকিয়ে কিছুটা স্বস্তি পাবে।
২০ শতকের গোড়ার দিকে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যে কাছাকাছি তাকিয়ে থেকে কাজ করার কারণে মায়োপিয়া দেখা দেয়। এর মধ্যে আছে বই পড়া, লেখা কিংবা যেমনটা আজকাল দেখা যায় টিভি দেখা বা ইন্সটাগ্রম স্ক্রল করা।
চীনে বিষয়টি এতটাই গুরুতর যে আনুষ্ঠানিকভাবে শিশুদের পড়াশোনা ও অন্যান্য অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বড় পরিসরে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির আগে শিক্ষার্থীদের লিখিত পরীক্ষা এখন সীমিত। ভিডিও গেম খেলাও বারণ। এমনকি বাচ্চারা যেন টেবিলে ঝুঁকে খুব কাছ থেকে না পড়ে সেজন্য অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেস্কে ধাতব বারও স্থাপন করেছে।
টেক্সট পড়তে বা ছবি দেখতে দেখতে দিনের অধিকাংশ সময় কাটলে নিকটদৃষ্টির সমস্যা বাড়াটাই স্বাভাবিক। অপটোমেট্রিস্ট লিয়ান্ড্রা জাং-এর মতে, 'অনেক কাল আগে মানুষ ছিল শিকারী ও সংগ্রহকারী। সে সময় শিকার খুঁজতে কিংবা পাকা ফল খুঁজে পেতে মানুষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তির ওপর নির্ভর করত। কিন্তু আমাদের বর্তমান জীবন বেশ সীমাবদ্ধ। আমরা বদ্ধ ঘরেই বেশিরভাগ সময় কাটাতে অভ্যস্ত। খাবার খুঁজতে আমরা উবার ইটসে ঢুকি'।
তার মানে আধুনিক জীবনই আমাদের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করছে। কিন্তু এটা প্রমাণ করা কঠিন। 'কিছু গবেষণায় যেমন দেখা যায় যে খুব কাছ থেকে কাজ করায় মায়োপিয়া হচ্ছে, তেমনই অনেক গবেষণায় এর ভিন্নটাও দেখা যায়।
বই বা স্ক্রিনের সামনে কত ঘণ্টা কাটানো হয় তার সঙ্গে মায়োপিয়ার সম্পর্ক অনেকটাই অস্পষ্ট। তবে অনেকের মতে অংশগ্রণকারীরা সম্ভবত ঘণ্টার হিসাব ঠিকমতো রেকর্ড করে না বা দিতে পারে না বলেই এই যোগসূত্র সরাসরি স্থাপন করাটা কঠিন। হয়তো কয় ঘণ্টা কাজ করা হলো তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কতক্ষণ পর পর সেই কাজে বিরতি নেওয়া হচ্ছে সেটা।
২০১৯ সালের নভেম্বরে এফডিএ মায়োপিয়া যেন দ্রুত বিকাশ লাভ না করে তা ঠেকাতে মাইসাইট নামে কুপারভিশনের একটি নরম কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহারে সবুজ সংকেত দেয়। এই লেন্স বিশেষভাবে মায়োপিয়ার কথা মাথায় রেখেই তৈরি।
মায়োপিয়ার বিকাশ ধীর করতে আরও অনেক ট্রিটমেন্ট চশমা নিয়ে ট্রায়াল চলছে। ইতোমধ্যে এর কিছু ইউরোপ ও কানাডার বাজারেও মিলছে।
আমরা হয়তো নিশ্চিতভাবে জানি না যে কীভাবে সারাদিন স্ক্রিনে তাকিয়া থাকা বা ঘরের ভেতর সময় কাটানো আমাদের নিকটদৃষ্টিকে প্রভাবিত করছে। তবে এটা নিশ্চিত যে, মায়োপিয়া হলো প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সাংঘর্ষিক জীবনযাপনের ফল। সব চোখের ডাক্তাররাই স্ক্রিন টাইম কমানো ও শিশুদের বাইরে খেলতে যাওয়ার ওপর জোর দেন। কিন্তু আজকের দিনে কোনো টিনেজারের কাছ থেকে ফোন কেড়ে নেওয়াটা কোনো বাচ্চাকে কাঁচা মাংস খাওয়ানোর মতোই অস্বাভাবিক এক আচরণ হবে যা বিবর্তনের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ না।
আর তাই সম্ভবত চোখে প্লাস্টিকের লেন্স কিংবা কেমিক্যাল ব্যবহার করেই আমাদের এখন চোখের স্বাভাবিক অবস্থা ধরে রাখতে হবে।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক