ভয়েস ওভার আর্টিস্ট: পর্দার পেছনের কণ্ঠশিল্পীরা!
অটোমান সম্রাজ্যের বিখ্যাত সম্রাট সুলতান সুলেমান তার পুত্র মুস্তাফাকে উপদেশ দিচ্ছেন বাংলা ভাষায়- "ঐশ্বর্যের চেয়ে দামী সম্পদ বুদ্ধিমত্তা, আর সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য হচ্ছে মূর্খতা, নিরর্থক ভয় পাওয়া হচ্ছে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, আর সবচেয়ে অধিক মূল্যবান বিষয় হৃদয়বান হওয়া।" দেশের একটি বেসরকারি চ্যানেলে প্রচারিত তুর্কি ধারাবাহিক 'সুলতান সুলেমান'-এর স্মরণীয় এক দৃশ্য এটি। তুরস্কের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের মুখে বাংলা কথার বদৌলতে দেশজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় সিরিয়ালটি। পরবর্তীতে একের পর এক বাংলায় ডাবিং করা তুর্কি সিরিয়াল জনপ্রিয়তা পায় দেশের চ্যানেলগুলোতে। এসব নাটকের বিদেশি চরিত্রগুলোকে দেশের মানুষের কাছে আপন করে তুলতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন যারা তারা হলেন দেশীয় ভয়েস ওভার আর্টিস্ট।
শুধু নাটক বা সিনেমাতেই নয়, বিজ্ঞাপন ভিডিও, অ্যানিমেশন বা ডকুমেন্টারি ফিল্ম, অডিও বুক এমনকি ভিডিও গেইমসের চরিত্রদের জীবন্ত করে তোলার পেছনেও রয়েছে এই ভয়েস ওভার শিল্পীদের সৃজনশীলতা। চরিত্র অনুযায়ী তাল মিলিয়ে কণ্ঠ দিয়ে পর্দার পেছনে কাজ করেন এই শিল্পীরা। কণ্ঠের মাধ্যমে চরিত্রের অভিনয় ফুটিয়ে তুলতে হয় বলে অনেকক্ষেত্রেই ভয়েস অ্যাক্টর বা কণ্ঠ অভিনেতা নামেও তাদের চেনেন অনেকেই। চেহারার পরিচিতি তৈরি না হলেও এই শিল্পীদের গলার স্বর হয়ে ওঠে ঘরে ঘরে সাধারণ মানুষের নিত্য সঙ্গী।
ভয়েস ওভার আর্টিস্টদের কাজের ক্ষেত্র দেশে নতুন না হলেও সম্প্রতি এর বিস্তৃতি বেড়েছে অনেক। ৯০ এর দশক থেকে বিটিভিতে বিদেশি ভাষার নানা সিরিয়াল প্রচার করা হতো বাংলায় ডাবিং করে। তবে সেই ডাবিং এর কাজগুলো মূলত কলকাতা থেকেই করে আনা হতো। ভাষা একই হলেও অঞ্চলভেদে তাতে উচ্চারণের ভিন্নতা থেকেই যেত। ফলে দেশীয় ক্ষেত্রে খুব একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো না সেই কাজ। স্থানীয় শিল্পীদের প্রতিবাদে দেশে অল্পবিস্তর ভয়েস ওভারের কাজ শুরু হয় তখন। সিনেমায় ডাবিং ও বিজ্ঞাপনে ভয়েস ওভারের কাজ করতেন গুটিকতক শিল্পীরাই। সম্প্রতি ডিজিটাল মিডিয়া সম্প্রসারণের সাথে সাথে ভয়েস ওভার শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
প্রমিত ভাষার চর্চা, শুদ্ধ উচ্চারণ, আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, আর অল্পবিস্তর অভিনয় জানা থাকলে যে কেউ আসতে পারেন এই পেশায়। নানা মাধ্যমের দর্শকের চাহিদার সাথে ক্রমেই বাড়ছে ভয়েস ওভার শিল্পীদের কাজ করার নানা ক্ষেত্রও। বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করা পরিচিত কণ্ঠস্বরের তিনজন ভয়েস ওভার শিল্পী তাদের কাজ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানিয়েছেন দ্য বিজনেস স্ট্যাডার্ডের সাথে আলাপচারিতায়।
দীপক সুমন
জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল 'সুলতান সুলেমান'-এর বাংলা ডাবিংয়ে সুলতানের চরিত্রে কণ্ঠদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল কণ্ঠ অভিনেতা হিসেবে দীপক সুমনের পথচলা। প্রায় ২০ বছর আগে কলেজ জীবন থেকেই জড়িয়েছিলেন থিয়েটারের সঙ্গে। কাজ করেছেন বিখ্যাত নানা নাট্যদলে। নিজেও গড়েছেন নাটকের দল। থিয়েটারের পাশাপাশি টিভি নাটক আর সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন এই শিল্পী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পাশ করার পর কয়েকবছর ব্যাংকার হিসেবে চাকরি করেছিলেন দীপক সুমন। কিন্তু শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে সৃজনশীল কাজের সাথেই জড়িত থাকতে চেয়েছেন আজীবন।
অভিনয়ের সূত্র ধরেই ২০১৭ সালে নতুন মাধ্যমে ভয়েস ওভার আর্টিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরু হয় দীপকের। তার ভাষ্যে, "থিয়েটারে একটা শো দেখে আমাকে একটা অ্যানিমেশন সিরিয়ালে ভয়েস ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিল 'টুন বাংলা অ্যানিমেশন স্টুডিও' নামে একটা প্রতিষ্ঠান থেকে। অনেক আলোচনার পর ভয়েস আর্টিস্টদের একটা দল তৈরি করে সেই অ্যানিমেশন সিরিজের কাজও শুরু করে দিয়েছিলাম আমরা। মাঝ পথে সেই স্টুডিও বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় নতুন টিভি চ্যানেল 'দীপ্ত টিভি'র পথচলা। সেখানে 'সুলতান সুলেমান' সিরিয়ালের বাংলা ডাবিংয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া হয় আমাদের পুরো দলকেই।"
শুরুতে ১১ জনের একটা দল নিয়ে বিশাল সেই সিরিয়ালের ডাবিং শুরু করেন দীপক সুমন। ভয়েস ডিরেক্টর হিসেবে ছিলেন তিনি। মূল চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়ার উপযুক্ত শিল্পী না পেয়ে নিজেই কাজ করেন সুলেমান হিসেবে। সিরিয়ালের ১৩০টির মতো চরিত্রে দলের একেকজন ৫-৬টিতে কণ্ঠ দিতেন। চ্যানেলের নানা পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে চালাতে হচ্ছিল বাংলায় কণ্ঠ দেওয়ার কাজ। ৬০টির মতো পর্ব বানাতে হয়েছিল এই স্বল্প জনবলেই। কারণ দীপ্ত টিভিতে তখন ফ্রিল্যান্সার কণ্ঠ অভিনেতা নেওয়ার সুযোগ ছিল না।
"ধীরে ধীরে কর্তাদের বোঝাতে সক্ষম হই এত অল্প মানুষ নিয়ে কাজ করা সম্ভব না। বারবার ঘুরে ফিরে একই মানুষের কণ্ঠ সিরিয়ালের বৈচিত্র ধরে রাখতে পারবে না। চরিত্রের ধরণ, বয়সসহ নানা বৈশিষ্ট্যভেদে কণ্ঠের প্রয়োজনও আলাদা হয়। এরপর চ্যানেলে ফ্রিল্যান্সার ভয়েস আর্টিস্ট কাজ করার সুযোগ পায়," বলেন তিনি।
কোনো বিদেশি সিরিয়াল বা সিনেমা ডাবিং করার আগে অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হয়। 'সুলতান সুলেমান' ডাবিং করার আগে সিরিয়ালের প্রেক্ষাপট ভালোভাবে অনুধাবন করার জন্য অটোমান সাম্রাজ্যসহ তার আগে পরের বিস্তারিত ইতিহাস প্রতিদিন নিয়ম করে পাঠ করেছেন দীপকসহ কন্ঠ অভিনেতাদের পুরো দল। নিজেদের চর্চার জন্য বিভিন্ন বই পড়ে, অন্য সিরিয়ালে কণ্ঠ দিয়ে রেকর্ড করেছেন আগেই। কণ্ঠ ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিনই করতে হয়েছে নানান ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম। যেকোনো ভয়েস ওভার আর্টিস্টকেই কাজ সংক্রান্ত এধরনের প্রস্তুতির মধ্যে থাকতে হয় বলে জানান দীপক সুমন।
২০১৮ সালে দীপক সুমন নিজেই গড়ে তোলেন অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রোডাকশন হাউজ 'প্ল্যাটফর্ম কমিউনিকেশন্স'। বর্তমানে যেখানে কাজ করছেন ১১ জন ফুল টাইম ভয়েস ওভার আর্টিস্ট, সাথে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে যুক্ত আছেন নানা বয়সী আরো ১০০ জনের বেশি শিল্পী। 'সহস্র এক রজনী', 'আকাশ জুড়ে মেঘ'-এর মতো জনপ্রিয় সব সিরিয়াল ছাড়াও নানা বিখ্যাত সিনেমার বাংলায় ডাবিং করা হয় এই হাউজ থেকে। এছাড়াও ডকুমেন্টারি, বিজ্ঞাপন বা অ্যানিমেশনে কণ্ঠ দেওয়ার কাজও করেন প্ল্যাটফর্ম কমিউনিকেশন্সের শিল্পীরা।
নাসরিন অনু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজের শিক্ষার্থী নাসরিন অনুর ভয়েস ওভার শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিলো দেশীয় একটি নাটকের চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যেমে। এরপর বিজ্ঞাপন, সিনেমা, অ্যানিমেশন, সিরিয়ালসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন কণ্ঠ অভিনেতা হিসেবে। বর্তমানে জনপ্রিয় তুর্কি সিরিয়ালের বাংলা ডাবিং 'আকাশ জুড়ে মেঘ' এর প্রধান নারী চরিত্র 'আদা'-র ভূমিকায় কণ্ঠ দিচ্ছেন অনু।
ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পদচারণা এই শিল্পীর। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বাচিক অভিনয়সহ অভিনয়ের নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত শিখতে শুরু করেন। ভয়েস ওভার আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ অভিনয়ের জগতে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে বলে মনে করেন নাসরিন অনু।
তার ভাষ্যে, "বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে থিয়েটার করে আসলে আর্নিংটা হয়ে ওঠে না। সেখান থেকে থিয়েটার করা মানুষগুলো যখন ভয়েসের কাজ করার সুযোগ পায় তখন তাদের কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি আলাদা একটা ইনকাম সোর্সও হয়। ফলে আর আর্নিং এর বার্ডেনটা অত থাকে না। স্বপ্রণোদিত হয়েই আমরা থিয়েটারের প্যাশন টিকিয়ে রাখার সুযোগ পাই।"
ভয়েস এক্টিং বা ভিজ্যুয়াল এক্টিং যেকোনো ক্ষেত্রেই কণ্ঠ ঠিক রাখা একটি বড় বিষয়। সেজন্য প্রতিনিয়ত চর্চায় থাকাটা খুব জরুরী মনে করেন অনু। ভয়েস ওভার শিল্পী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা বেশ সুন্দর তার। বর্তমানে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন দীপ্ত টিভি, গ্রিন টিভি, দুরন্ত টিভি, প্ল্যাটফর্ম কমিউনিকেশন্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। পড়াশোনার পাশাপাশি মাসে প্রায় ২০ দিনই কাটে এই কাজের ব্যস্ততায়।
প্রমিতি কর্মকার
কলেজে পড়ার সময় এক আন্তর্জাতিক সংস্থার ডকুমেন্টারিতে কণ্ঠ দিয়ে ভয়েস ওভার শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু হয়েছিল প্রমিতি কর্মকারের। ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর নিজের হাতখরচ চালাতে টিউশনের পাশাপাশি খুঁজতে শুরু করেছিলেন ভয়েস ওভার শিল্পী হিসেবে কাজ করার নতুন সুযোগ। ছোটবেলা থেকেই গান শেখা আর পরবর্তীতে সঙ্গীত বিভাগে পড়ার সুবাদে কণ্ঠের চর্চাটা তার ভালোভাবেই ছিল।
ফেসবুকে ভয়েস আর্ট সম্পর্কিত নানান প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করে প্রফেশনাল কাজ খুঁজতেন প্রমিতি। তখন ইউটিউব ভিডিওর জন্য ভয়েস ওভারের কাজের প্রস্তাবই বেশি আসতো। তবে সেসব কাজের জন্য পারিশ্রমিক অফার করা হতো খুবই অল্প। প্রমিতির ভাষ্যে, "ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিওতে ভয়েস দেওয়ার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতি মিনিটে ১০-২৫ টাকা সম্মানী অফার করা হতো। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। এক্ষেত্রে প্রফেশনালদের সাথে কথা বলে আমার যেমন ধারণা জন্মেছিল তার থেকে পুরোই বিপরীত চিত্র ছিল বাস্তবে। শুরুতে তবু বেছে বেছে কয়েক জায়গায় কাজ করেছিলাম নিজের হাতখরচ চালানোর জন্য। একটু বেশি সময়ের কাজ হলে বা সপ্তাহে কয়েকদিন কাজ থাকলে তাও মোটামুটি একটা এমাউন্ট পাওয়া যেত হাতখরচ হিসেবে।"
দেশের ভয়েস ওভার আর্টিস্টদের এক জায়গায় জড়ো করতে প্রমিতি ফেসবুকে 'ভয়েস ওভার আর্টিস্টস অব বাংলাদেশ' নামে গ্রুপ খোলেন ২০২০ সালে। যারা শিল্পী হিসেবে কাজ করতে চায় আর যারা কাজের জন্য শিল্পী খুঁজতে চায়- উভয় দলই উপকৃত হচ্ছেন এই গ্রুপ থেকে।
এমনকি অভিজ্ঞদের কাছ থেকে কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নানা টিপসও পাওয়া যায় সেখানে। 'সেল্ফ ব্র্যান্ডিং' এর মাধ্যমে ভালো পরিচিতি তৈরি করতে পারলে কাজের ক্ষেত্রে পারিশ্রমিকও ভালো পাওয়া যায় বলে জানান প্রমিতি।
ফ্রিল্যান্সার শিল্পী হিসেবে দুরন্ত টিভিতে 'এন্ট বয়' সিরিজসহ বিভিন্ন সিনেমায় কন্ঠ অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছেন প্রমিতি কর্মকার। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, সহজ, দারাজ, কান পেতে রই ইত্যাদি নানা প্রতিষ্ঠানের ডকুমেন্টারি, বিজ্ঞাপনেও কণ্ঠ দিয়েছেন। ভয়েস ওভার আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও কাজের ভালো পোর্টফোলিও থাকায় বর্তমানে এই কাজে আয়ও বেশ ভালো হচ্ছে তার।
পেশাগত দক্ষতা, আয়, ভবিষ্যৎ
ভয়েস ওভার আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করতে হলে আবৃত্তি, গান বা অভিনয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকতেই হবে এমন নয়। নাসরিন অনুর ভাষ্যে, "যেকোনো ব্যাকগ্রাউন্ডের, যেকোনো পেশার মানুষ যদি নিজের যত্ন নিয়ে, আঞ্চলিকতা কাটিয়ে, প্রমিত উচ্চারণ শিখতে পারেন তাহলেই এই ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ পেতে পারেন। কাজের ক্ষেত্রে ভাষার আঞ্চলিকতাকে কাটিয়ে ওঠা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিজে ইচ্ছা পোষণ করে একটু সচেতন হলেই সহজেই এটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।"
দীপক সুমনের মতে, ভয়েস এক্টিং এর কাজ করতে হলে অভিনয়ের টুকটাক জ্ঞান থাকা খুবই প্রয়োজনীয়। কণ্ঠের মাধ্যমেই যেকোনো ভিডিওচিত্রের চরিত্রগুলোকে অর্থপূর্ণ করে তোলা হয়। চরিত্রের প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আবেগ কণ্ঠে না থাকলে চরিত্র প্রাণ পায় না। তাই যে চরিত্রের কন্ঠ দিতে হবে তার আদ্যোপান্ত ভালোভাবে জেনে নিজের মধ্যে চরিত্রটিকে ধারণ করতে হবে শুরুতেই। অভিনয়ের দক্ষতা অর্জন না করতে পারলে সেটি সম্ভব নয়।
অন্যান্য ভয়েস ওভার আর্টিস্টদের কাজ নিয়মিত শুনে নিজেকে যাচাই করার কথা বলেন প্রমিতি কর্মকার। নিজে নিজেই বারবার চর্চা করা, অভিজ্ঞদের সাজেশন নেওয়ার মাধ্যমে কাজের দুর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে ওঠার পরামর্শ দেন তিনি।
কণ্ঠের সৃজনশীলতাকে পুঁজি করেই যেহেতু কাজ করতে হয় এক্ষেত্রে তাই শিল্পীর কণ্ঠের যত্ন নেওয়া জরুরী। ভয়েস ওভার শিল্পীদের নিয়মিত কণ্ঠ, শ্বাস-প্রশ্বাস ও মুখের ব্যায়াম করা, গরম পানি খাওয়া, আইসক্রিমের মতো ঠান্ডা খাবার এড়িয়ে চলার মতো অভ্যাস গড়ে তুলতে হয় নিষ্ঠার সাথে।
ভয়েস ওভারের কাজের ক্ষেত্র অনুযায়ী পারিশ্রমিকে থাকে ভিন্নতা। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় কাজের চুক্তি হয় প্যাকেজ হিসেবে। শিল্পীর কাজের অভিজ্ঞতা, তার ব্র্যান্ড ভ্যালু আর প্রতিষ্ঠানের বাজেট অনুযায়ী একটি বিজ্ঞাপনের কাজে এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা এমনকি ২০ হাজার টাকা সম্মানীও নির্ধারিত হয়।
সিরিয়ালে ভয়েস দেওয়া বা ডাবিং এর ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সার শিল্পীরা কাজ করেন আট ঘণ্টার শিফট ভিত্তিতে। প্রতি শিফটে পারিশ্রমিক থাকে ২ হাজার টাকার মতো। বিভিন্ন চ্যানেল বা ভয়েস ওভার এক্টিং এর হাউজে ফুল টাইম চাকরির সুযোগও আছে। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সেখানে মাসিক বেতন হয় ১৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
এছাড়া অনলাইনে নানা ক্ষেত্রে ভয়েস ওভারের কাজে পারিশ্রমিক হিসেব করা হয় কাজের সময় অনুযায়ী। এক্ষেত্রে প্রতি মিনিটে ৩০০-৬০০ টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন অভিজ্ঞ শিল্পীরা। বাসায় নিজের সেটাপে রেকর্ড করা ও সরাসরি স্টুডিওতে গিয়ে কাজ করার উপর ভিত্তি করেও নির্ধারিত হয় এই পারিশ্রমিক।
ইতোমধ্যেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ভয়েস ওভার শিল্পীদের কাজের বিশাল ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশে প্রচলিত কাজগুলোর বাইরেও ডিজিটাল মিডিয়া, ভিডিও গেইম ইত্যাদি ক্ষেত্রে কণ্ঠ শৈলীর এই কাজের বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরির সম্ভাবনা আছে। আগামী কয়েকবছরের মধ্যেই নতুন সেই ক্ষেত্রগুলো আরো বেশি উন্মোচিত হবে বলে মনে করেন দেশীয় শিল্পীরা।