বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুলে পাক ধরে কেন? এটি কি থামানো সম্ভব?
মাথার চুলে হালকা পাক ধরতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। মাথায় প্রথম যখন রুপালি চুল ধরা পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে আঁতিপাঁতি করে আরও রুপালি চুল আছে কি না খুঁজতে শুরু করি আমরা।
ব্যাপারটা আমাদের পছন্দ হোক বা না-ই হোক, চুল পাকা প্রত্যেকের জন্যই অবধারিত নিয়তি। চুল নিয়ে সবার মনেই দুটো প্রশ্ন কখনও না কখনও উঁকিঝুঁকি মারে—১. মাথার চুলে পাক ধরার কারণ কী এবং ২. চুলে পাক ধরা বিলম্বিত করার কোনো উপায় আছে কি না।
চুল পাকে কেন—এ প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারলেও আরেকটি প্রশ্ন থেকেই গেছে—চুলে পাক ধরানোর প্রক্রিয়া কি উল্টে দেওয়া যায়? অর্থাৎ পাকা চুল ফের কালো করা সম্ভব কি না।
চুল পাকে কেন
মাথার চুলের রং কী হবে—কুচকুচে কালো নাকি সোনালি, কিংবা অন্য কিছু—তা নির্ধারণ করে মেলানিন। মেলানিন—অর্থাৎ চুলের রঞ্জক পদার্থ—প্রত্যেক চুলের গ্রন্থিকোষে মেলানোসাইট নামক কোষ উৎপাদন করে। আর এই কোষগুলো দুটি ভিন্ন ধরনের মেলানিন তৈরি করে, যা ইউমেলানিন ও ফিওমেলানিন নামে পরিচিত।
ইউমেলানিন হলো গাঢ় রঞ্জক। অর্থাৎ এটি যত বেশি থাকবে, চুলও তত গাঢ় রঙের হবে। কাজেই ইউমেলানিনের পরিমাণ বেশি থাকলে চুলের রং কালো বা বাদামি হয়। এই মেলানিন না থাকলে চুল হয় সোনালি রঙের। আর ইউমেলানিন না থেকে ফিওমেলানিন থাকলে চুলের রং হয় লাল।
কিন্তু চুলের রং ধূসর হয় কখন? ধূসর চুলের জন্য দায়ী মেলানিন—অর্থাৎ মেলানিন না থাকা। ধূসর চুলে মেলানিনের পরিমাণ সবচেয়ে কম থাকে। আর সাদা বা রুপালি চুল বর্ণহীন, অর্থাৎ এ চুলে মেলানিন থাকে না।
চুলের রং এরকম ধূসর, রুপালি বা সাদা হওয়ার প্রধান কারণ হলো বার্ধক্য।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চুলের গ্রন্থিকোষের মেলানোসাইট কোষগুলো মারা যেতে শুরু করে। ফলে মেলানিন বা রঞ্জক পদার্থ কমে যায়। সময়ের পরিক্রমায় মাথার চুল আরও রং হারায়, যা রুপালি বা ধূসর দেখায়।
চুলে পাক ধরার কারণ বের করতে পারলেও বিশেষজ্ঞরা এখনও আমাদের মেলানোসাইট কোষগুলোর মারা যাওয়ার কারণ বোঝার চেষ্টা করছেন। আর বার্ধক্যকের কারণ নিয়েও কয়েকটি তত্ত্ব রয়েছে।
প্রধানত দু-ধরনের বার্ধক্য আছে—অন্তর্গত ও বহির্গত বার্ধক্য। অন্তর্গত বার্ধক্যের জন্য দায়ী মৌলিক জৈবিক কাজ সম্পন্ন করা অভ্যন্তরীণ জৈবিক কোষগুলো। একটি কোষ যখন বিভাজিত হয়, প্রতিবারই এটি ডিএনএ হারায়। এতে কোষগুলোর বয়স বাড়ে এবং ঠিকমতো কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর একটি উদাহরণ হলো ধূসর চুলের জন্য দায়ী মেলানোসাইট কোষের ক্ষয়।
বহির্গত বার্ধক্য হয়ে থাকে বাহ্যিক ফ্যাক্টরের কারণে। মানসিক চাপ, খাদ্যাভ্যাস এবং ভিটামিন বি-১২-এর অভাব বা অটোইমিউন রোগের মতো কিছু অসুস্থতার কারণেও চুল ধূসর হয়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপ ও ধূসর চুলের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে।
চুলে পাক ধরা আটকানো
বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশের কোঠার মাঝামাঝি হওয়ার পর আমাদের চুল ধূসর হতে শুরু করে পারে। কখন পাক ধরা শুরু হবে সেটি নির্ভর করে আমরা কোন জাতিগোষ্ঠীর সদস্য, তার ওপর।
তবে ত্রিশ কিংবা চল্লিশ, যে বয়সেই শুরু হোক না কেন, শেষতক আমাদের সবার চুলেই পাক ধরা অবধারিত। অবশ্য বিজ্ঞান জার্নাল ইলাইফ-এ প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের চুলে পাক ধরা আটকে দেয়া কিংবা বিলম্বিত করা সম্ভব।
চুলে পাক ধরার অন্যতম কারণ মানসিক চাপ—যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এ বিশ্বাসের সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ভ্যাগেলোস কলেজ অভ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস-এর একদল গবেষক।
গবেষকরা ৯ থেকে ৬৫ বছর বয়সি ১৪ জন সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকের ৩৯৭টিরও বেশি চুলের গোছা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। স্বেচ্ছাসেবকদের কেউই তাদের চুলের প্রাকৃতিক রং বদলানোর জন্য কোনো হেয়ার ডাই বা রাসায়নিক ব্যবহার করেননি, তবে প্রত্যেকেই নিজের মাথায় পাকা অথবা কাঁচাপাকা চুলের গোছা পেয়েছেন।
একটি হাই রেজোলুশন স্ক্যানার দিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের চুলের গোছার ছবি তোলা হয়। স্ক্যানারে চুলের রঙে অতি ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম পরিবর্তন ধরা পড়ে, যা সাদা চোখে ধরা পড়ে না। এরপর ফলাফলগুলো প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবকের মানসিক চাপের ডায়েরির সঙ্গে তুলনা করা হয়। ওই ডায়েরিতে একটি ক্যালেন্ডার এবং সেই সপ্তাহে তারা কে কতটা চাপে ছিলেন, সে সম্পর্কে নোট ছিল।
গবেষকরা অবাক হয়ে দেখেন, স্বেচ্ছাসেবকরা চাপমুক্ত হওয়ার পর তাদের ধূসর চুল ফের আসল রং ফিরে পেয়েছে। এই পরিবর্তন দেখে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১০ জন চাপ কমানোর জন্য সক্রিয় ব্যবস্থা নেন। যেমন, তারা ছুটিতে যান কিংবা কোনো উত্তেজনাপূর্ণ সমস্যার সমাধান করেন। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর বেলায়ই দেখা গেল, চাপ কমানোর পর চুলের ডগা সাদা থাকলেও গোড়ার দিকে রং গাঢ় হয়েছে কিংবা আসল রং ফিরে পেয়েছে।
তবে এ খবর শুনে ধূসর চুলের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যদি চুল রং করা বন্ধ করে দিয়ে লম্বা ছুটিতে যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেন, তবে আপনার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে। মানসিক চাপ কমানো স্বাস্থ্য ও চুলের জন্য ভালো হলেও এটি আমাদের চুলের স্বাভাবিক রং ফিরিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, চুলের রঞ্জক পদার্থ সবার বেলায় ফিরে আসে না। একটি নির্দিষ্ট সময় ও পরিস্থিতিতেই কেবল এই মানসিক চাপ কমানোর দাওয়াইটি কাজে দেয়। এর অন্যতম কারণ জীববিজ্ঞান। মধ্যবয়সে পৌঁছানোর পরপরই আমাদের চুল ধূসর হয়ে যাওয়ার জৈবিক বয়সের কাছাকাছি পৌঁছে যায়।
গবেষণাটির ফলাফল বলছে, মধ্যবয়সে মানসিক চাপ কমালে চুলে পাক ধরা বন্ধ কিংবা অন্তত স্থগিত রাখতে পারার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
তবে আপাতত আমরা এটুকু ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারি যে, আমরা শুধু আমাদের একার চুলেই রুপালি চুলের গোছা খুঁজে পাইনি, আরও অনেকেই পেয়েছেন—এবং পাবেন।
- সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন