পিটাছড়া কনজারভেশন ইনিশিয়েটিভ: খাগড়াছড়ির ব্যক্তি-মালিকানাধীন বিচ্ছিন্ন বনভূমি বাঁচানোর একক লড়াই
মাহফুজ আহমেদ রাসেল গুগল ম্যাপে আমাদের সঙ্গে তাঁর লোকেশন শেয়ার করলেও অ্যাপের ডিফল্ট ভিউতে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। লোড হলে আরও কিছু জানা যাবে সেই অপেক্ষায় দুর্বল মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ে বসে ছিলাম। তারপরও কিছু আসলো না।
দেখা গেল আমরা যেমনটা খুঁজছিলাম সেরকম কোনো ব্যবস্থাই এখানে নেই। গাড়ি চলার মতো সবচেয়ে কাছের রাস্তাটি শেষ হয়েছে প্রায় দুই কিলোমিটার আগে। আশেপাশে জনবসতির তেমন কোনো চিহ্ন ছিল না বললেই চলে।
প্রথমে স্থানীয় পাকা রাস্তা, এরপর বাইকে করে মাটির রাস্তা এবং সবশেষে পাহাড়ি রাস্তায় ছোটখাটো একটা ট্র্যাকিং শেষে যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছালাম তখন গুগল ম্যাপের 'শূন্য' স্থানের বিপরীতে আমাদের কাছে ধরা দিল সেখানকার সবচেয়ে 'অভিজাত' জায়গা।
আশেপাশের কয়েকটি পাহাড় বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত গাছের মনোকালচার প্ল্যান্টেশনে ছেঁয়ে থাকলেও এর প্রাণী ও উদ্ভিদ সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এখানকার আভিজাত্য।
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলায় অবস্থিত এই ছোট্ট ভূমির জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে রাসেলের আন্তরিক প্রচেষ্টায়। শুধু এখানকার প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্যকে রক্ষার উদ্দেশ্যে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে তিনি এই পাহাড়গুলো কিনেছিলেন।
যখন থেকে বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আসতে শুরু করেছে তখন থেকেই বর্ধিত জনসংখ্যার কারণে স্থানীয় বনাঞ্চল কমতে থাকে। এই বনভূমি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্যের হটস্পটের একটি অংশ ছিল। খাগড়াছড়ি জেলাও ভিন্ন নয়। এখানেও বেশিরভাগ বনভূমিতে গড়ে উঠেছে মানুষের আবাসস্থল কিংবা শুরু হয়েছে একচেটিয়া বাণিজ্যিক বৃক্ষ আবাদ। এখন শুধু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েক টুকরো বন রয়েছে, সেগুলোও যেকোনো দিন চাষাবাদ কিংবা বৃক্ষরোপণ শুরু হয়ে যাওয়ার 'অপেক্ষা' করছে।
এই বন যে একসময় খুব সমৃদ্ধ ছিল তা উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। এখানকার বিশেষায়িত বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে ভাল্লুক, চিতাবাঘ, হরিণ এবং হাতি ছিল অন্যতম।
রাসেল এবং তাঁর বন্ধুরা এখন পিটাছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ইনিশিয়েটিভ নামে একটি উদ্যোগে নিজেদের মালিকানাধীন ২৩ একর বনভূমি সংরক্ষণ করছেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আশেপাশের বনগুলোও রক্ষার চেষ্টা করা হয়। চার বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত অঞ্চলে বন রক্ষায় গ্রামবাসীদের শিকার বন্ধ করার বিষয়টিও বুঝানোর চেষ্টা করেন তারা।
ফলটা অবশ্য মিশ্র। স্থানীয়রা জানান এখন শিকার অনেকটাই কমে গেছে। তবে শিকারই এখানকার একমাত্র সমস্যা নয়।
'শিকার অবশ্যই একটি বড় সমস্যা। কিন্তু আমরা শিকার বন্ধ করলেই কী হবে? বনই যদি না থাকে, বন্যপ্রাণীরা কোথায় যাবে? শুধু গত শুষ্ক মৌসুমেই সেগুন ও বাবলা বাগানের জন্য ১৩০ একরের বেশি বন উজাড় করা হয়েছে,' এখানকার ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা টিবিএসকে জানান রাসেল।
অবশিষ্ট যে জায়গাগুলো এখনও রয়েছে সেগুলো আসলেই সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ।
বনের মধ্যে মাত্র দুবার স্বল্পসময়ের জন্য ঘুরেই আমরা লজ্জাবতী বানর, দুই প্রজাতির কাঠবিড়ালি, তিন প্রজাতির সাপ, উল্টোলেজি বানর এবং বন মোরগসহ বেশ কয়েক প্রজাতির পাখি দেখতে পেলাম। বনবিড়ালসহ অন্যান্য ছোট প্রজাতির প্রাণীদের পায়ের ছাপও দেখেছি যা আমাদের পক্ষে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
দেশের বন্যপ্রাণী বিষয়ে আগ্রহী ও সংরক্ষণবাদীরাও এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে অবগত।
'পিটাছড়ায় তুলনামূলকভাবে বেশি গাছপালা ও একটি সক্রিয় পাহাড়ি জলপ্রবাহ থাকায় তাই এলাকাটি ক্যাচার বুলবুল ও বিশ্বব্যাপী হুমকির সম্মুখীন প্রজাতি লাল বুকের মদনা টিয়ার মতো প্রায় ১৫০ প্রজাতির স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখিদের আশ্রয়ণ হয়ে উঠেছে,' বলেন কনজারভেশন বায়োলজিস্ট এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রার্থী ড. সায়াম উ চৌধুরী।
'এছাড়াও এখানে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন লজ্জাবতী বানর, ঝুঁকিতে থাকা উল্টোলেজি বানর, ১০টি অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ন্যূনতম ২০ প্রজাতির সরীসৃপ ও উভচর প্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্র,' বলেন তিনি।
এই উদ্যোগের আওতায় এখন আরও বনভূমি কেনার চেষ্টা চলছে। তবে সমস্যাও আছে অনেক। কিছু ক্ষেত্রে মালিকানা প্রশ্নবিদ্ধ, আবার কিছুক্ষেত্রে মালিকরা সহযোগিতা করছেন না। অর্থায়নও একটি বড় সমস্যা, যা বর্তমানে নেই বললেই চলে।
গল্পের শুরুটা যেভাবে
ছয় বছর আগে এই উদ্যোগ শুরু করেন মাহফুজ রাসেল। এরপর থেকে তিনি এই বনেই বসবাস করছেন। এর আগে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে তাঁর জীবনটা আসলে সম্পূর্ণ উল্টো ছিল।
তবে প্রকৃতির প্রতি রাসেলের এই ভালোবাসার বীজ সম্ভবত তিনি ছোট থাকতেই বোনা হয়েছিল।
'আমার জন্ম ঢাকায়। আমার বাবা একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি পটুয়াখালীতে বদলি হয়ে যান। তখন সেটা এক ছোট শহর। আমাদের বাড়ির চারপাশে অনেক গাছপালা, আর কাছাকাছি একটি খাল আর একটি নদী ছিল। অনেক পাখি আর জন্তু ছিল সেখানে। সেই খাল পেরিয়ে হরিণ আসত। পোকামাকড়, গাছপালা আর পাখির সঙ্গে আমার দিন কাটত। আমি মনে করি তখনই আমি প্রকৃতির প্রেমে পড়েছিলাম,' বলেন রাসেল।
এমবিএ শেষ করে রাসেল আরএমজি বায়িং সেক্টরে দুই বছর কাজ করেন। এরপর তিনি ফ্যাশন মার্কেটিং পড়ার জন্য যুক্তরাজ্যে চলে যান। পড়াশোনা শেষ করে একই সেক্টরে চার বছর কাজ করেন এবং বায়িং ম্যানেজারের দায়িত্ব পর্যন্ত পালন করেন।
সেই পর্যায়ে রাসেল বুঝতে পারেন তিনি আসলে এই জীবনটা চান না। নিজের সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ দান করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আরও বেশি সময় কাটাতে শুরু করেন। কিছুদিন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ এবং আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। এমনকি ২০১০ সালে তিনি কিলিমাঞ্জারো পর্বত আরোহণ করেন।
রাসেল একটি টেকসই জীবনধারা চেয়ছিলেন। তিনি সমমনা মানুষ ও বিভিন্ন দলের সঙ্গে মিশতে শুরু করেন এবং অর্গানিক বাগান, বিপন্ন প্রজাতির মৌমাছি পালন, বিকল্পধারার ঘর নির্মাণ ইত্যাদি শিখেন।
রাসেল আমাজনে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গেও বাস করেছেন। এই জীবনধারা আসলেই মানুষকে মানসিক শান্তি দিতে পারে কিনা তা যাচাই করতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বয়ংসম্পূর্ণ টাকাপয়সাবিহীন এক জীবনধারা আয়ত্ত করতে চেয়েছিলেন রাসেল।
অবশেষে তিনি ম্যানচেস্টারে নিজের বাড়ি বিক্রি করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন, বিশেষ করে বয়স্ক মাকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু তিনি জানতেন যে শহরে আর থাকতে পারবেন না। শৈশবের কিছু বন্ধুর সাহায্যে রাসেল এই বনভূমির সন্ধান পেয়ে তা কিনে নেন।
তখন অবধি রাসেল বন সংরক্ষণ নিয়ে খুব বেশি ভাবেননি। কিন্তু যখন তিনি লক্ষ্য করলেন যে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো নির্বিচারে বন্যপ্রাণী শিকার করে, তখন তিনি একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন।
বন বিভাগ এখানকার বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য কিছুই করবে না, কারণ এই বনভূমিগুলো সবই ব্যক্তিমালিকানাধীন। তাই রাসেল আশেপাশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিকার বন্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন।
কিন্তু এটা সহজ ছিল না। অনেক শিকারী প্রথমে ক্ষুব্ধ হন। তারা বহিরাগতের পরামর্শ নেবেন না। এমনকি রাসেলকে নিয়েও তাদের সন্দেহ ছিল, ভেবেছিল সে নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ করে আইনের হাত থেকে বাঁচতে এখানে পালিয়ে এসেছে।
কিন্তু রাসেল যখন স্থানীয়দের শিক্ষা, জীবিকা ও চিকিৎসার প্রয়োজনে যখন যেভাবে সম্ভব সাহায্য করতে শুরু করলেন, তখন তিনি স্থানীয়দের মধ্যে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন। ধীরে ধীরে তারাও তাঁর কথা শুনতে শুরু করলো।
'শিকার অন্তত অর্ধেক কমে গেছে,' জানান পূর্ব-খেদাছড়ার মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বলেন, 'গ্রামে গ্রামে পোস্টারিং আর প্রচারণার মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে।
এখনও অনেকটা পথ যাওয়া বাকি
রাসেল পূর্ব-খেদাছড়ায় নিজের জঙ্গল বাড়িতে থাকা শুরু করার পর গাছ লাগানোর জন্য আশেপাশের অনেক পাহাড় পরিষ্কার করা হয়েছে।
বনপ্রেমী শহুরেদের সঙ্গে তুলনা করলে স্থানীয়দের বাস্তবতা ভিন্ন। আমরা স্থানীয় এক লোককে সুন্দর দেখতে একটি গাছের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'এটা বাজে গাছ (কোনো কাজের নয়)'।
রাসেল যেখানে থাকে তার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে হেমাঙ্গো কারবারি পাড়ায় শচীন্দ্র ত্রিপুরার (৭০) সঙ্গে দেখা। শচীন্দ্র বনের জীববৈচিত্র্যের হারিয়ে যাওয়ার জীবন্ত সাক্ষী। প্রায় ৩০ বছর আগে জঙ্গলে বাঁশ কাটতে তিনি ভাল্লুকের আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন।
গ্রামবাসীরা জানিয়েছিল আক্রমণের কিছুদিন আগেই স্থানীয় শিকারীদের হাতে মা ভাল্লুকটি তার বাচ্চা হারিয়েছিল।
শচীন্দ্র ত্রিপুরার মতো মানুষ যারা চিরকালের জন্য দাগ আর কাঁধের বিচ্ছিন জয়েন্ট নিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, তাদের কাছে জঙ্গল খুব ভালো জায়গা নয়। অবশ্য একটু আড্ডা দেওয়ার পর শচীন্দ্র স্বীকার করলেন যখন বন ছিল তখন তিনি প্রচুর প্রাণী শিকার করতেন এবং সেখান থেকে বাঁশ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে পারতেন।
বেশিরভাগ স্থানীয়দের কাছে বৃক্ষরোপন, চাষাবাদ বা ইটভাটার জন্য জ্বালানি সরবরাহের মতো লাভজনক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বন উজাড় করাটাই যুক্তিসঙ্গত।
পিটাছড়া ইনিশিয়েটিভ এই সমস্যাটি বুঝতে পেরে এর সমাধানের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করছে। তাদের আশা এখানে একটি জঙ্গল রিসোর্ট স্থাপন এবং প্রকৃতি সচেতন পর্যটকদের জন্য সতর্কতার সঙ্গে গাইডেড ট্যুরের আয়োজন করার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তা স্থানীয়দের সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারা করে নেওয়া। মূল উদ্দেশ্য যাতে করে স্থানীয়রা ভবিষ্যতে বন সংরক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের প্রেরণা পায়।
'যখন গ্রামবাসীরা দেখবে তারা পর্যটকদের গাছ দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারছে, তখন তারা আর শুধু বাণিজ্যিক জাতের গাছপালাগুলো লাগানোতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না,' বলেন পিটাছড়া ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা।
রাসেল বলেন, তিনি স্থানীয় সম্প্রদায়ের দেখাতে চান যে মাশরুম চাষের মতো বিকল্প পেশা রয়েছে যার জন্য খুব বেশি বন পরিষ্কারের প্রয়োজন নেই।
উদ্যোগটি আইনি সংস্কারের জন্যও চাপ প্রয়োগের চিন্তাভাবনা শুরু করেছে।
এ ধরনের বনভূমির আইনগত সুরক্ষা না থাকায় হতাশা ব্যক্ত করে রাসেল বলেন, 'আমরা ব্যক্তিগত বনভূমিকে আইনিভাবে রক্ষার নির্দেশনা পেতে হাইকোর্টে যেতে চাই।'
যদিও এখনও অনেক পথ যেতে হবে তবু রাসেল আশাবাদী।
'আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব৷ ধীরে ধীরে আমাদের সঙ্গে অন্যান্য আরও অংশীদার ও বিভিন্ন দল হাত মেলাবে। বন্যপ্রাণীসহ সবার জন্য কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ভালো হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা একসঙ্গে বসে বনভূমি রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব,' বলেন তিনি।