গ্রামীণ নারীদের অবদান ছাড়া বৈশ্বিক খাদ্য সংকট সমাধান সম্ভব নয়
বিশ্বে খাদ্য অনিরাপত্তায় ভোগা নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি। গত তিন বছরে এই ব্যবধান আরও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটে নারীদের এই অসম বোঝা বহন ক্রমবর্ধমান জেন্ডার ভেদাভেদকেই নির্দেশ করে। এসব তথ্য উঠে এসেছে দ্য হিল- এ প্রকশিত ক্লডিয়া স্যাডফ-এর লেখায়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কেয়ার-এর একটি গবেষণার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে ২০২১ সালে বিশ্বে খাদ্য অনিরাপত্তায় ভোগা পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ১৫ কোটি বেশি। অথচ ২০১৮ সালেও এ সংখ্যাটি ছিল কেবল ১ কোটি ৮ লক্ষ।
যেখানে জেন্ডার অসমতা যত বেশি, সেখানে ক্ষুধাও তত বেশি- গবেষণার ফলাফল তা-ই বলছে। খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় নারীদের অপরিহার্য ভূমিকা বিবেচনায় এটি নিষ্ঠুর এক পরিহাস। এত বড় অসমতাকে মোকাবেলা না করে বর্তমান খাদ্য সংকট মোকাবেলা করা কখনোই সম্ভব নয়, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দ্বিতীয় অভীষ্ট 'ক্ষুধা মুক্তি' অর্জন করাও সম্ভব নয়।
নারীরা বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোতে খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ, খুচরা বিক্রয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। এছাড়াও, গৃহস্থালির প্রধান হিসেবেও নারীর অবদান বেশি। এসব কারণেই গ্রমীণ নারীরা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের অবদানকে যথার্থ উপায়ে কাজে লাগানো গেলে তারাই এক একজন হতে পারেন পরিবর্তনের প্রতিনিধি।
বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবেলায় জেন্ডার ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে নারীদের এমনভাবে সক্ষম করে তুলতে হবে, যেন খাদ্য ব্যবস্থায় তাদের কাজের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব হয়। তবেই পরিবর্তন ও উন্নতি আসবে, সমগ্র সম্প্রদায় আরও শক্তিশালী হবে। পাশাপাশি ক্ষুধার ক্ষেত্রে যে জেন্ডারবৈষম্য রয়েছে সেটিও দূর হবে।
এটি প্রমাণিত যে, গৃহস্থালির কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর সম্পৃক্ততা পুষ্টি, জীবিকা, সুস্থতা এবং ভারসাম্য নিশ্চিত করে। এছাড়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যের উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং ব্যবস্থাপনায় পরিবার কিংবা সমাজের প্রত্যেকের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে।
উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোতে দেখা যায়, পারিবারিক চাষাবাদে যখন নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, তখন তাদের পরিবারে জলবায়ু সহনশীল কর্মপদ্ধতির চর্চা ছিল। আবার, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে পরিবারগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতা রয়েছে, সে পরিবারগুলো বিচিত্র ফসল উৎপাদনে বেশি সক্ষম, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিও অনেকটা কমায়। এর পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি অনেকাংশে নিশ্চিত হয়।
খাদ্য ব্যবস্থায় জেন্ডার অসমতা ও নারীদের অন্তর্ভুক্তিতে যেসব বাধা কাজ করে সেগুলো নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করতে হবে। কারণ অন্তর্ভুক্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি ও পরিবেশ তৈরি করা নির্ভর করে এসব গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও প্রমাণের ওপর।
খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কিংবা গবেষণার ক্ষেত্রে জেন্ডার বিবেচনায় রাখলে অনেক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে করে মানবিক ও উন্নয়ন প্রচেষ্টাগুলো আরও কার্যকরী হয়। এসব তথ্য ছাড়া গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলোতে নারী ও নারীর ক্ষমতায়নকে লাভবান করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় সময় অসম্ভব, অনেক ক্ষেত্রে হিতে বিপরীতও হতে পারে।
খাদ্য নিরাপত্তা উন্নয়নের উদ্দেশ্যে পরিচালিত পদক্ষেপগুলোতে যেন অন্তর্নিহিত জেন্ডারবৈষম্য মোকাবেলার লক্ষ্য থাকে, সেজন্য অনেক সংস্থা জেন্ডার অন্তর্ভুক্ত গবেষণার গুরুত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশিকা দিচ্ছে। এরকমই একটি প্রোগ্রাম হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃষি গবেষণা সংগঠন সিজিআইএআর- এর সদ্য চালু করা জেন্ডার ইমপ্যাক্ট প্ল্যাটফর্ম।
বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবেলার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, উদ্ভাবন, কৃষিভিত্তিক কর্মসূচি এবং হস্তক্ষেপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের বিশেষ প্রয়োজন এবং চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় রাখতে সরকারগুলোকে এরকম অন্তর্ভুক্তিমূলক গবেষণালব্ধ তথ্য সাহায্য করতে পারে।
খাদ্য সংকটের সময় খাদ্যাভ্যাসের যে সমস্যা দেখা দেয়, তা নারী ও পুরুষ ভেদে ভিন্ন হয়। যেমন, পরিবারের অন্য সদস্যদের খাবার জোগান দিতে নারীরা অনেক সময় নিজেরাই অভুক্ত থাকেন, যা তাদের পুষ্টিহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।
কৃষি প্রযুক্তিতে নারীদের প্রবেশাধিকার বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে সুচারুভাবে পরিকল্পিত কর্মসূচিগুলো পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় একাধিক সুবিধা এনে দিতে পারে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বেনিনে এমনটিই দেখা গেছে। সেখানে সৌর চালিত ড্রপ সেচে নারীদের অংশগ্রহণ তাদের সমৃদ্ধির খাদ্যতালিকা এনে দিয়েছে।
বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবেলায় বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ চলমান। তবে এসব পদক্ষেপে নারীদের ভূমিকা অনুপস্থিত। ফলে ক্রমাগত জেন্ডারবৈষম্য বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ দুর্বল দিকগুলোকে আরও দীর্ঘায়িত করছে।
এই সংকটে বিরাজমান এবং আসন্ন ক্ষতিগুলোকে ঠেকাতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নারী ক্ষমতায়ন প্রচার ও প্রসারে কাজ করতে হবে। এতে কেবল একক কোনো ব্যক্তি বা পরিবার নয়, বরং পুরো সম্প্রদায়ই লাভবান হবে।
- লেখক: ক্লডিয়া স্যাডফ; বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃষি গবেষণা সংগঠন সিজিয়াইএয়ার-এর প্রধান ব্যবস্থাপনা পরিচালক।