পাতলা ফালির মাছে মোড়ানো খাবার: জাপানে সুশির সুপ্রাচীন সংস্কৃতি কি জলবায়ু সংকট থেকে বাঁচতে পারবে?
জাপানি ভোক্তাদের সবচেয়ে পছন্দের খাদ্য তালিকায় রয়েছে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য প্রাণী। আর এই খাদ্যাভ্যাসকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সুশি সংস্কৃতি। আজ জাপান ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে সুশি; কিন্তু, সঙ্গত কারণেই তা জাপানিদের মতোন গভীর নয়। খবর দ্য গার্ডিয়ানের
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিপন্ন হচ্ছে সুশির ভবিষ্যৎ। তার প্রমাণ মেলে জাপানের বিখ্যাত সামুদ্রিক খাদ্যের ঠিকানা– শিগোমা সিফুড মার্কেটে ঢুঁ মারলেই। তবে একটু অন্যভাবে দেখলেই বোঝা যাবে বিষয়টি।
এ বাজারের খাবারের স্টলগুলির খ্যাতি আছে সুশির ভক্তদের কাছে। কারণ, এখানকার পরিবেশনে মেলে বিশালাকৃতির কাঁকড়ার পা থেকে শুরু করে লোভনীয় আকৃতির নানান ধরনের স্যামন। এগুলির মাংস ছোট ছোট করে কেটে আঠালো ভাত আর নোরি সামুদ্রিক আগাছায় মুড়িয়ে সুশিরূপে সাজিয়ে পরিবেশন করেন দক্ষ শেফরা।
স্টলগুলিতে দেখা মেলে ব্লুফিন টুনা মাছের বড় বড় সব টুকরো। চাকু-ছুরির কেরামতিই সুশিকে দেয় ভিন্নতা। এ দক্ষতায় সুশি শেফেদের জুড়ি মেলা ভার। টুনাগুলির ফালি ছোট ছোট করে কেটে, ভোক্তাদের রসনা অনুযায়ী নানান অনুষঙ্গ যোগ করে পরিবেশন করাটাই তাদের শিল্প। দারুণ ব্যস্তই থাকে তাই শিগোমা সিফুড মার্কেটের স্টলগুলি।
স্টলের সামনে বাক্সে রাখা ঘণ্টাখানেক আগেই ধরা স্কুইড, ফ্লাউন্ডার ও সি পাইনাপেলের মতো বিচিত্র সব সামুদ্রিক প্রাণীও ঘুরেফিরে দরদাম করতে দেখা যায় ক্রেতাদের।
এই প্রাচুর্য দেখে বিভ্রান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীর কোনো অভাব নেই জাপানে–মনেও হবে তাই। কিন্তু, দিনে দিনে এমন বৈজ্ঞানিক প্রমাণই জোরালো হচ্ছে, যে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ও অন্ধকারে ঘেরা জাপানিদের এ রসনার। অভিজ্ঞ জাপানিদের জেলেদের কাহিনিগুলোও সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
শিগোমা বাজারের একজন স্টল মালিক মিকি সিইনো। দোকানে রাখা 'প্যাসিফিক সাউরি' নামক একটি মাছের দিকে দ্য অবজার্ভারের প্রতিবেদক ইঙ্গিত করতেই কিছুটা বিব্রত দেখায় তাকে। এই মাছটি জাপানে বসন্তকালীন একটি জনপ্রিয় খাবার, হোক সে গ্রিল করে বা সাশিমি হিসেবে কাঁচা খাওয়ার আয়োজন।
মাছটির আকার নিয়ে তিনি বলেন, 'জালে ধরা পড়া মাছের ঝাঁক এখন দিনে দিনে ছোট হচ্ছে। ধরা পড়া মাছও হৃষ্টপুষ্ট নয়। সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ায় আমাদের টোহুকু এলাকায় মাছ ধরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে– বলে শুনতে পাচ্ছি। আর মাছও এখন আগের চেয়ে অনেক দামি'।
সাওরি, স্যামন, স্কুইডসহ জাপানের অন্যান্য প্রধান সামুদ্রিক খাদ্যপ্রাণ আহরণ কমে আসার পেছনে— বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সামুদ্রিক পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানে আসা পরিবর্তনই দায়ী বলে জানিয়েছে জাপানের মৎস দপ্তর।
টোহুকু অবস্থিত জাপানের উত্তরপূর্বে। জাপানের এই পূর্ব উপকূলের প্রধান সমুদ্র স্রোতকে বলা হয় কুরোশিও। সাম্প্রতিক সময়ে এই স্রোত প্রবাহে উষ্ণ জলরাশি দেখা যাচ্ছে। এতে সাওরি মাছের প্রজনন ও ডিম দেওয়ার এলাকা উপকূল থেকে আরও গভীর সমুদ্রের দিকে সরে গেছে। কিন্তু, সেখানে পর্যাপ্ত খাবার নেই, ফলে বংশবিস্তার কমছে। আর সেখান থেকে ধরা মাছের মানও ভালো নয়।
টেকসই সামুদ্রিক খাদ্য ব্যবসা ও পরিবেশবাদী গ্রুপগুলির জাপান ভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা– সিফুড লিগ্যাসির ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আইকো ইয়ামাওচি জানান, জাপানে খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় সাওরি মাছ ধরা পড়ার পরিমাণ ২০১৪ সাল থেকেই খাড়া পতন লক্ষ করছে।
তিনি বলেন, 'এটা খুবই সম্ভব, অন্যান্য প্রজাতির মাছ ধরার পরিমাণও একই রকমভাবে বর্তমানে তুলনায় অনেক নিচে নেমে আসবে। এই আশঙ্কা নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। এতে জাপানের মৎস খাত– যেটি দেশের অর্ধেকের বেশি সামুদ্রিক খাদ্য চাহিদা মেটায়– ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে'।
জাপানের আরেকটি অঞ্চল কোচি। এখানে রয়েছে গোলাকৃতির এক উপসাগর। কোচির উপসাগরটি মাছের উর্বর বিচরণ স্থল হিসেবেই চিরকাল বিখ্যাত। এখানে বড় আকারের মাছের পরিমাণ বেড়েছে সম্প্রতি। কিন্তু, এ ঘটনাকে কল্যাণকর নয়, বরং আসন্ন দুর্যোগের সতর্কবার্তাই বলছেন বিজ্ঞানীরা।
আসলে গত চার দশকে শীতকালে এই উপসাগরের জলের উপরিভাগের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি বেড়েছে। এতে ওই সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাদ্য থাকছে মাছের জন্য। কিন্তু, ধীরে ধীরে এই উষ্ণায়ন যত বাড়বে– দীর্ঘমেয়াদে ততোটাই সমূহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাস্তুসংস্থান। কারণ তখন সাগরতল থেকে খনিজ সমৃদ্ধ পানি উপরে উঠতে পারবে না। খনিজের অভাবে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য ভাণ্ডার উধাও হতে থাকবে। খাদ্যচক্রে কমবে বড় মাছের খাদ্য ছোট মাছের পরিমাণ। ফলে স্কিপজ্যাক টুনার মতো বিশাল মাছগুলিও বিপন্ন হবে।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডল ও সামুদ্রিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শিন- ইচি ইতো বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই ইয়েলোটেইল ও স্প্যানিশ ম্যাকরেল মাছ– সাধারণত এগুলি বিচরণ করে না এমন জায়গাগুলোয় ধরা পড়ছে।
তিনি বলেন, 'আজ থেকে ১০ বছর আগে যতোটা কাছে ধরা যেত, এখন তার চেয়েও উত্তরের সমুদ্রে মিলছে প্রজাতিগুলো। এটা সম্ভবত জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রভাব'।
শিন- ইচি ইতো আরও মনে করেন, এতে জাপানি রসনার আবশ্যক উপাদানগুলি বিপন্ন হচ্ছে। যেমন দেশটির সর্ব উত্তরের হোক্কাইডো দ্বীপ এবং টোকিও উপসাগরের প্রবেশমুখে কেল্প নামক সামুদ্রিক আগাছা হুমকির মধ্যে রয়েছে। এই আগাছাই নোরি তৈরিতে ব্যবহার হয়।
সুশিতে ব্যবহৃত আরেকটি উপাদান ওয়াসাবি। এটি অবশ্য মাটিতেই চাষাবাদ করা হয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন থেকে এটিও নেই নিরাপদে। দিনে দিনে সামুদ্রিক ঝড়গুলির বাড়ছে তীব্রতা। এতে উপকূলীয় ওয়াসাবি খামারগুলি তছনছ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সংবেদনশীল এই সবজির চাষ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ পানির তাপমাত্রা ১০-১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে স্থির থাকলেই শুধু এটির চাষ করা সম্ভব।
ইতো জানান, সুশির আরেক প্রধান অনুষঙ্গ স্যামনও আছে ঝুঁকিতে। 'এই মাছটি নিজ শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই তাদের একমাত্র বিকল্প ঠাণ্ডা স্রোতের জন্য আরও উত্তরে পাড়ি দেওয়া'। কিন্তু, যেভাবে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে তাহলে কয়েক দশকের মধ্যেই জাপানের সর্ব উত্তরের হোক্কাইডো দ্বীপের আশেপাশের সমুদ্র থেকেও স্যামন উধাও হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তিনি।
'মাছের কিছু কিছু প্রজাতি যখন আর পাওয়া যাবে না, তখন জাপানের খাদ্যাভ্যাসও স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তিত হবে। আর আমরা অনেক আগ্রাসী নতুন প্রজাতিও দেখব'।
অর্থাৎ, সমুদ্রের স্বাভাবিক বাস্তুসংস্থানে আমূল বদলের আশঙ্কা করছেন এ বিশেষজ্ঞ।
জাপানিদের খাদ্যতালিকা থেকে সুস্বাদু কাঁকড়া, চিংড়ি, ঝিনুকের মতো খোলস যুক্ত খাবার একদিন হারিয়েই যাবে একথা আজ কল্পনাও করা মুশকিল। কিন্তু, সেটাই বাস্তব করে তুলবে ওশেন অ্যাসিডিফিকেশন বা সাগরের অম্লতা বৃদ্ধি। অম্লতা বাড়ার ফলে এসব প্রাণীর পক্ষে খোলস গঠনের জন্য দরকারি ক্যালসিয়াম কার্বনেট জমানো আরও কঠিন হয়ে উঠবে। ফলে ওয়েস্টার, ক্ল্যাম ও ক্যালোপের মতো সামুদ্রিক শামুক ও ঝিনুকের বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইতো বলেন, 'এই সমস্যা কতটা গভীর বেশিরভাগ মানুষই তা বুঝতে পারেন না। কারণ তারা মনে করে, এগুলি দূর ভবিষ্যতের ঘটনা, যখন তারা বেঁচেই থাকবেন না। তারা মনে করে, একবিংশ শতকের সমস্যা তাদের নয়… যদিও তাদের জানা নেই, আমরা সংকটের গিরিখাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি'।
ছবির মতো সুন্দর জাপানের ইয়াকুশিমা দ্বীপ। এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও দিয়েছে ইউনেস্কো। এই দ্বীপে চার দশক ধরে বাস করছেন জুন হোশিকাওয়া। এই এলাকায় জেলেদের মাছ ধরার অনেক পরিবর্তন লক্ষ করেছেন তিনি এ সময়ে। এখন তিনি জেলেদের কাছে হলুদ পাখনার ম্যাকারেল কমই দেখেন। অথচ এই মাছটি দক্ষিণের এই অঞ্চলে প্রচুর মিলতো।
গ্রিনপিস জাপানের সাবেক নির্বাহী পরিচালক হোশিকাওয়া বলেন, 'সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ার কারণে মাছগুলি আরও উত্তরদিকে চলে গেছে। উত্তরমুখী এই প্রবণতা অন্যান্য জলজ প্রজাতির ক্ষেত্রেও ঘটছে, আর এটি ব্যাপক রূপ নিতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে'।
'দুর্ভাগ্যের বিষয়, বেশিরভাগ জাপানির নজর এড়িয়ে গেছে তাদের খাওয়া সামুদ্রিক খাদ্য সরবরাহের এই মৃদু পরিবর্তন; তবে আগামী বছরগুলিতে তাদের টনক নড়বে'।
ফিরে আসা যাক শিগোমা বাজারে। সেখানে এখনও ক্রেতা আর পর্যটকের ভিড়ে পা ফেলাই দায়। বেশিরভাগ জাপানি কিনতে এসেছেন বাড়িতে 'কাইসেন ডনবুড়ি' নামক ভাত দিয়ে সামুদ্রিক খাবার তৈরি করার নিজ নিজ পছন্দের উপকরণ। যাতে সিজনিং করা হয় সয়া সস আর ওয়াসাবি দিয়ে।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্যের কদর আছে জাপানিদের এই খাদ্যাভ্যাসে। মাস অনুযায়ী অবশ্য তাতে নানান পরিবর্তন আসে। একেক মাসে জনপ্রিয় থাকে সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীর একেক প্রজাতি। আর তাতেই বাহারি ডানা মেলে সুশির মেন্যু।
বাছাবাছির এই সুবিধা আর বেশিদিন থাকবে না এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে স্টল মালিক মিকি সিইনো বলেন, 'আগে যে মাছ শুধু গ্রীষ্মকালে বিক্রি করতাম, আমরা তা এখন শীত ও হেমন্তেও করছি। এখন মনে হয়, ঋতু কোনো বিষয়ই না'।