বাঙালির মতোই ভোজনপ্রিয় বাংলার ভূত: ভাত, মাছ, মিষ্টি এমনকি চা প্রেমী ভূতও আছে
বাঙালি যে ভোজনপ্রিয় জাতি তাতে নিশ্চয় কারো কোনো সন্দেহ নেই। অনেকে তো এমনটাও বলেন যে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ বাঁচার জন্য খায়, আর বাঙালি খাওয়ার জন্যেই বাঁচে।
খাবারের প্রতি অগাধ ভালোবাসা বোধ হয় বাঙালি ভূতেদেরও কম নেই। আবার একেক ভূতের প্রিয় খাবার একেক রকম। হরেক রকম ভূত এবং তাদের পছন্দের খাবার নিয়ে কন্ডে নাস্ট ট্রাভেলার-এ লিখেছেন সিদ্ধার্থ রায়, যা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
মাছখেকো 'মেছো ভূত'
'মাছে ভাতে বাঙালি', বাঙালি যে মাছপ্রেমী জাতি এই একটা কথাতেই তা স্পষ্ট। পৃথিবীতে ভূত আছে কি নেই তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাঙালির অশেষ মাছপ্রেম নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। অবাক হলেও সত্যি বাঙালি ভূতেদের ক্ষেত্রেও তা সত্য।
বাংলা সাহিত্য ও লোককাহিনীতে যেসব ভূতের বর্ণনা পাওয়া যায় তার একটি বড় অংশজুড়ে আছে মেছো ভূত। মাছ শব্দ থেকেই মেছো শব্দের উৎপত্তি।
অনেক মেছো প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে নিজেরাই মাছ ধরেন। কেউ কেউ মাছের দলগুলোকে তাড়া করে খাল, বিল কিংবা পুকুরে নিয়ে গিয়ে ধরে টাটকা মাছ গ্রাস করে। আবার অনেকে ভীষণ ধৈর্য নিয়ে জনশূন্য পুকুরপাড়ে বসে থাকে, পানিতে কখন মাছ নড়ে ওঠার সাড়া মিলবে।
এ থেকে বোঝাই যায়, কেবল মাছের প্রতি অগাধ ভালোবাসাটাই মূল ব্যাপার নয়। যেনতেন নয়, মাছ হতে হবে টাটকা!
তবে মেছোদের মাছ হাতে পাওয়ার সবচেয়ে সাধারণ উপায়- ছিনতাই করা। বাজার থেকে মাছ কিনে সন্ধ্যা কিংবা রাতের অন্ধকারে ফেরা 'বোকা' লোকদের হুমকি ধামকি দেখিয়ে মাছ ছিনিয়ে নেওয়াই তাদের জনপ্রিয় একটি তরিকা। পদের সাথে পদ মিলিয়ে, তবে আঁধারে অস্পষ্ট হয়ে দূরে থেকে তারা লোকেদের ভয় দেখাতে শুরু করে। 'সাবধান,মানুষ', এভাবেই শুরু হয় তাদের হুমকি।
এরপর শুরু হয় তাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ। অনুনাসিক সুরে তারা বলতে থাকে 'আমি খুব-খুব-খুব ক্ষুধার্ত।' তবে অনুরোধ আর বেশিক্ষণ অনুরোধ থাকে না, পরিণত হয়ে গালাগালিতে, ভয়ানক হুমকিতে।
বলা হয়ে থাকে এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার উপায় হলো, মেছোদের মাছ না দেওয়া। লোকেরা হয়তো ভাবে মাছ দিয়ে ভূত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মেছোরা মাছ এবং জীবন দুটোই কেড়ে নেয়। অন্যদিকে, মানুষ যদি নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত করে রাখে, মেছোরা ধৈর্য হারিয়ে একসময় উন্মাদ হয়ে যায়। তারা তখন গাছে মাথা আঘাত করা অথবা নিজের হাত চিবিয়ে ফেলার মতো বীভৎস কাণ্ড শুরু করে।
বাংলা গদ্য অসংখ্য মেছো ভূতের গল্প দিয়ে ভরপুর। যাইহোক, আমি ব্যক্তিগতভাবে তিনজনের গল্প জানি যারা 'মেছো ভূতের সাথে লড়ে জিতেছিলেন'; বরিশালের একজন নববিবাহিত পুলিশ কর্মকর্তা, হুগলির এক গেঁয়ো লোক যে কি না বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে ভালোবাসে এবং আরেকজন চট্টগ্রামের একজন মুসলিম দর্জি।
পুলিশটির গল্প এরকম: তার হাতে ছিল একটা বড় ইলিশ মাছ। সারারাত ধরে এক মেছো তাকে ধানের খেত জুড়ে গোলাকারভাবে ধাওয়া করেছিল। নেহাত পুলিশটির কপাল ভালো বলে সকালে এক কৃষক খেতটিতে চলে আসেন এবং তাকে মাছসুদ্ধ উদ্ধার করে নিয়ে যান।
এবার দ্বিতীয় গল্পে আসা যাক। গেঁয়ো লোকটি তার থলেতে শোল মাছ নিয়ে খুশি মনে এক ভূতুরে প্রহরীদুর্গের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার পিছু নিয়েছিল এক মেছো। প্রাণভয়ে পালাতে পালাতে একসময় লোকটি তার বাড়ির দ্বারে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। যা-ই হোক, পরে তিনি নিজেও বেঁচে যান, তার মাছটিরও রক্ষে হয়।
সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয় দর্জিটির। কেবল একজন নয়, মেছোদের পুরো একটি দল তার পেছনে লেগে যায়। সাপ্তাহিক হাট থেকে মাছ কিনে ফেরার সময় তার নৌকাটি যেইমাত্র ঘাটে বাঁধতে গেলেন, এক মেছো এসে উপস্থিত! হাতে মাছ নিয়ে প্রাণভয়ে পালাতে থাকেন তিনি। একসময় বাড়ি ফিরতি এক কৃষককে দেখতে পান। শুষ্ক মুখে দর্জি জিজ্ঞেস করল, 'বাড়ি কোন দিকে?' উত্তর না নিয়ে কৃষকটি শয়তানি হাসি দিয়ে দিক বলে দেওয়ার বিনিময়ে মাছ দাবি করে বসল। এ যে আরেক মেছো! আবার সেখান থেকে দৌড়ে পালাতে পালাতে একসময় একটি দোকানে এসে পড়েন দর্জি। দোকানদার তাকে বসতে দিলে। যে-ই বসলেন, অমনি দোকানদার বললনে, 'আমাকে মাছটি দেন, আমি রেঁধে দিই।'
শেষমেশ দর্জিসাহেব বেঁচে যান বটে। তবে মাছটির নিয়তি কী হয়েছে সেটি বোঝাই যাচ্ছে।
এই তিনটি গল্প থেকে একটা বিষয় একেবারে পরিষ্কার; ধর্ম, রাজনীতি যতই ভিন্ন হোক না কেন, বাঙালি জীবন ছাড়বে তবুও মাছ ছাড়বে না।
ভাতের পেত্নি: ভাতপ্রেমী যে ভূত
বাঙালি সংস্কৃতিতে মাছের কথা এসে গেলে ভাতের কথা আসবেই। আর মাছ ও ভাত- এ দুটো একসাথে আসলে বলা হয়ে থাকে সেখানে ভাতপ্রেমী পেত্নি আসবেই। নিঝুম রাতে যখন সমাই ঘুমিয়ে থাকে, তখন পেত্নিরা বেড়িয়ে আসে। উদ্দেশ্য রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট থেকে মাছের নাড়িভুঁড়ি ও হাড় চিবিয়ে খাওয়া এবং গোগ্রাসে বাসি ভাত খাওয়া!
বলা হয়ে থাকে কালো জাদুর দুনিয়ায় ভাত এবং পচা মাছে উৎসর্গ করে অতিপ্রাকৃত পেত্নিদের ডেকে আনা যায়। এই ভয়টা আগে এতটাই প্রচলিত ছিল যে অনেক গেরস্থে, এমনকি আমার পূর্বপুরুষদের বাড়িতেও নাকি সন্ধ্যার পর মাছ রাঁধা কিংবা খাওয়া কোনোটাই করা হতো না।
সত্তর দশকের কোনো এক সময়ে আমার বাবার দুই বড় ভাই তাদের নানিকে দেখতে বরিশাল গিয়েছিলেন। ততদিনে এলাকাটি বিদ্যুতের আওতায় এসে গেছে বলে বাতির আলোয় নৈশভোজ সেরে নেওয়া যেত। অনেকদিন পর দেখা হয়ে নানি তার আদরের নাতিদের থালায় খাবার ঢালছেন তো ঢালছেন। এদিকে এত খাবার খেতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে ভাইয়েরা। যাই হোক, সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ করে বাতি মিটমিট করল এবং কিছুক্ষণ পর নিভে গেল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। খেতে খেতে এ কি মহাবিপদ! নানি রান্নাঘর থেকে কেরোসিন চেরাগ জ্বালাতে গেলেন। এসময় রান্নাঘরের পেছন থেকে সবাই এক অদ্ভূত আওয়াজ শুনতে পেল। আনন্দে গবগব করে কিছু গিলে ফেলার আওয়াজ; ঠিক মানুষেরও নয়, আবার কুকুর, বিড়ালেরও নয়।
পরে নানি যখন চেরাগ হাতে ফিরে এলেন, সবাই দেখলেন বড় ভাইয়ের থালা থেকে এক টুকরো মাছ নেই। উদ্ভট এ ঘটনা দেখে সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। নানি বুঝে ওঠার জন্য অল্প সময় নিয়ে হঠাৎ হাতে বিশাল এক আঁশ বঁটি নিয়ে রাতের আঁধারের মাঝেই উঠোনে গিয়ে অভিসম্পাত শুরু করে দিলেন।
সত্তরের দশকে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা দুইজন দু'ভাবে বর্ণনা করেন। নানি জোর দিয়ে বলেন যে তিনি ছেঁড়া শাড়ি পরা অদ্ভূত দেখতে এক নারীকে দৌড়ে পালাতে দেখেন। তবে এটি একেবারেই বিশ্বাস করেন না দুই ভাইয়ের বড়জন। তার ভাষায়, 'নানি যদি সত্যিই তা দেখে থাকেন, তবে তিনি হয়তো এমন একজন দরিদ্র নারীকে দেখেছেন যিনি বাধ্য হয়ে আবর্জনা থেকে খাচ্ছিলেন। আর মাছের যে টুকরোটি উধাও হয়ে গিয়েছিল, সেটি আসলে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর অন্ধকারে আমার ভাই কব্জা করেছিল।'
বিশ্বের বহু জায়গায় অন্তহীন ভূতের গল্প শোনা যায়। আর বাংলায়, যা একসময় এক ঔপনিবেশিক দুর্ভিক্ষের কারণে মৃতের স্তূপে পরিণত হয়েছিল, অহরহ ভূতের কাহিনী শুনতে পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া যুগযুগ ধরে নারী নির্যাতনের যে জঘন্য ইতিহাস আছে তা দেখে তার নানির চেয়ে আমার চাচার বর্ণনাটাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়।
এবার আসি মিষ্টিপ্রেমীদের কথায়
মাছ এবং ভাতের কথা তো গেল, এবার মিষ্টিপ্রেমী ভূতেদের পালা।
শীতের শেষের দিকে যখন সুগন্ধে ভরপুর গুড়ের সময় চলে আসে, বাংলার ঘরে ঘরে তখন পিঠা বানানোর ধুম লেগে যায়। অমৃতের মতো স্বাদের এই পিঠাগুলো স্বর্গীয় মনে হলেও বদহজম ঘটাতে পটু।
বড়রা ছোটদের নির্ধারিত কিছু পিঠা খেতে দিয়ে বলত, 'বাকিটা জমা থাকবে। সকালে খেতে পাবে। পিঠা তো আর উধাও হয়ে যাচ্ছে না। তাই না?'
কিন্তু ঝামেলাটা হলো পিঠা প্রায়ই উধাও হয়ে যায়। কিছু বাচ্চা ভূত নাকি দরজার ফাটল দিয়ে ঢুকে পিঠা চুরি করে নিয়ে যায়। এই উপদ্রপ থেকে বাঁচার উপায় হলো তাদের জন্য বাইরে এক প্লেট পিঠা রেখে দেওয়া।
আমার নানি সবথেকে সুস্বাদু পিঠা বানাতেন। তিনি প্রতি পৌষ সংক্রান্তির রাতে রান্নাঘরের দেওয়ালে একটি পিরিচে করে পিঠা রেখে দিতেন। আর সকালে দেখা যেত একটিও অবশিষ্ট নেই। নানির মতে পিঠাগুলো খেত বাচ্চা ভূতেরা। এ বিষয়ে আমার বরাবরই ভিন্নমত ছিল। বাইরে কত ক্ষুধার্ত প্রাণীই না ঘুরে বেড়ায়। আমার মতে, বাড়ির পাশের ঝোপেঝাড়ে থাকা ভামগুলোই পিঠা খেয়ে নিত। কিন্তু এসব বললে তো আবার তর্ক লেগে যাবার জোগাড়! জেনেশুনে এমন পিঠা তৈরিকারীর সাথে কে তর্কে যাবে!
আরেক ভূত, চেতনায় যে ব্রিটিশ
লীলা মজুমদারের ছোটগল্প 'চেতলার কাছে' পড়ার পর মাকে বলেছিলাম, 'কী মজার এক ভূত আছে এতে! বহুকাল আগে মৃত এক ব্যক্তি উঠোনের একটি পুরোনো গাছে এসে থাকে। বাড়িতে যতবার চা বানানো হয়, সে গন্ধ শোঁকতে শোঁকতে চলে আসে এবং এক কাপ চায়ের অনুরোধ করে। মাছ নয়, মাংসও নয়। তাই বলে চা!'
উত্তরে মা বলেন, 'আমাদেরও ওরকম একটি ভূত আছে। সে তোমার নানির মাতুলালয়ে, আমার মামার বাড়িতে দেখা দিত।'
গ্রীষ্মের ছুটিতে নানির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেছিলেন, 'আমার বাওয়ালী (দক্ষিণ ২৪ পরগণায় অবস্থিত) বাড়ি ভূতে ভরপুর ছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিরীহ ছিল ব্রহ্মদৈত্য।'
ব্রহ্মদৈত্য ছিলেন এক মৃত বাঙালি ব্রাহ্মণের ভূত। বাঙালি হিন্দুদের জাতপ্রথার মতো ভূতেদেরও জাতের শ্রেণী ছিল। গল্পানুসারে, ব্রহ্মদৈত্য জীবিত থাকাকালে ছিলেন উপনিবেশ যুগের এক ইংরেজ-শিক্ষিত ব্যক্তি। এক পাড়ার গলিতে সে প্রায়ই দেখা দিত। রাতে যারা দেরিতে বাড়ি ফিরত এবং ভোরের আগে যারা বের হতেন তাদের পথ আটকে দাঁড়াত সে।
কোনো মন্ত্র বলেও পার পাওয়া যেত না। বদমাশটা নিজেই মন্ত্র বলাতে যোগ দিত। মানুষদের নিয়ে মজা করা শেষ হলে সে জিজ্ঞেস করত, 'তোমার সিগারেট আছে, তাই না? আমায় একটা দিলে আমি তোমাকে যেতে দেব। আর সিগারেটের সাথে যদি এক কাপ চা দিতে পার, তবে প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাকে আর কোনোদিন বিরক্ত করব না।'
আমার কয়েক দশকের আগ্রহের দরুণ আমি জানতে পারি যে বাংলা বহু কোম্পানি সাহেব এবং তাদের দেশীয় দালালের ভূতে ভরপুর! তাদের দেখা মিলত শহরে যেখানে কোম্পানির গ্যারিসন (রক্ষীনগরী) কিংবা বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল।
এমনই সব মজার মজার গল্পে ভরপুর বাংলা লোককাহিনী এবং সাহিত্য। ব্রহ্মদৈত্যের মতো নিরীহ ভূতের বর্ণনা যেমন আছে, সত্যজিৎ রায়ের 'নীলাতঙ্ক' কিংবা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নীলকর'-এ দেখা মিলবে ভয়ঙ্কর সব অশরীরি প্রেতাত্মা ও ভূতের।