ভৌতিক সাহিত্যে ভয় ও মায়ার কারিগর তিনি!
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রাম-বাংলার অনাবিল প্রকৃতি ও তার ভেতরে বাস করা মানুষগুলোর শাশ্বত জীবনযাপনের অনুপম চিত্রায়ণ। তবে পথের পাঁচালী, আরণ্যক, ইছামতীর মতো উপন্যাসের লেখক বিভূতিভূষণ কেবল জীবনধর্মী সৃষ্টিতেই আটকে থাকেননি, বরং বিভিন্ন আধিভৌতিক বিষয় নিয়েও করেছেন সাহিত্য রচনা। ভয় ও রোমাঞ্চের নতুন ভুবন উন্মোচিত হয়েছে তার লেখায়।
বিভূতিভূষণের পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা মূলত 'তারানাথ তান্ত্রিক'-এর লেখক হিসেবেই চিনি। তবে এর প্রথম গল্প দুটো লিখেছিলেন বিভূতিভূষণই। এর বাইরে তার লেখা মিসমিদের কবচ, দেবযান, মেঘমল্লার-এর মতো উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থগুলো ছিল অতিপ্রাকৃত প্রপঞ্চ নিয়েই।
বিভিন্ন পত্রিকাতেও ভৌতিক গল্প লিখেছিলেন বিভূতিভূষণ। পরে সেসব গল্প একত্র করে ভয় সমগ্র নামে বইও বেরিয়েছে।
বিভূতিভূষণ ব্যক্তিজীবনে ভূত বিশ্বাস করতেন। তাই তার লেখা গল্পগুলোতেও ভৌতিক সত্তাকে বেশ জীবন্তই মনে হয়। আবার আধিভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত ব্যাপারগুলো জীবনের অংশ হিসেবেই তার গল্পে ধরা দেয়। তার বিখ্যাত গল্প রঙ্কিনীদেবীর খড়্গ-এ নিজেই লিখেছেন:
'জীবনে অনেক জিনিস ঘটে, যাহার কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তাহাকে আমরা অতিপ্রাকৃত বলিয়া অভিহিত করি। জানি না, হয়তো খুঁজিতে জানিলে তাহাদের সহজ ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কারণ বাহির করা যায়। মানুষের বিচার-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতালব্ধ কারণগুলি ছাড়া অন্য কারণ হয়তো আমাদের থাকিতে পারে; ইহা লইয়া তর্ক উঠাইব না। শুধু এইটুকু বলিব, সেরূপ কারণ যদিও থাকে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দ্বারা তাহা আবিষ্কার হওয়া সম্ভব নয় বলিয়াই তাহাদিগকে অতিপ্রাকৃত বলা হয়।'
এ গল্পে বহুপ্রাচীন এক দেবীর সাধনা ও কিংবদন্তির কথা তুলে এনেছেন বিভূতিভূষণ। সেই দেবীর আরাধনার সঙ্গে তন্ত্রসাধনা এবং মড়ক বা মহামারির সঙ্গে দেবীর খড়গের সম্পর্ক নিয়েই এগিয়েছে কাহিনী
মেঘমল্লার গল্পটির কথাই ধরা যাক। এ গল্পের মুখ্যচরিত্র ঘটনাচক্রে এক তান্ত্রিকের সাধনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তান্ত্রিক তাকে ব্যবহার করে সরস্বতী দেবীকে নিজের করায়ত্ত্বে আনতে চান। গল্পে সরাসরি কোনো ভূত নেই, কিন্তু আছে অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা। আর তার সঙ্গে আছে বিভূতিভূষণের অন্য সব লেখার মতোই মায়াময়তা। এক্ষেত্রে মুখ্য চরিত্রটিকে যখন দেবী তার আবাসে থেকে যেতে বলেন কিংবা পায়েস বানিয়ে খেতে দিতে চান, তখন তাকে বাংলার ঘরে ঘরে থাকা সন্তানবৎসল মায়েদের থেকে আলাদা করা যায়না। দেবীর মুক্তির জন্য মুখ্যচরিত্রটি যে ত্যাগ স্বীকার করেন, তা ভৌতিকতা বা অতিপ্রাকৃত ব্যাপারকে ছাপিয়ে মায়া, স্নেহ ও ভালোবাসাকে বড় করে তোলে।
এমনটা আমরা দেখি বিভূতিভূষণের বিখ্যাত গল্প মায়াতেও। পরিত্যক্ত এক বাড়িতে থাকতে আসেন গল্পের মুখ্য চরিত্র ব্রাহ্মণ। ক্রমে বাড়িতে থাকা অশরীরী আত্মাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটতে থাকে তার। কিন্তু না, এখানে নৃশংস কোনো ব্যাপার ঘটেনা। শুরুতে অস্বস্তি বোধ হলেও ক্রমে সেই অশরীরীদের কার্যকলাপের সঙ্গে মানিয়ে নেন তিনি। এখানেও ভূতুড়ে ভীতির চেয়ে মানুষের মাঝে থাকা মায়াই বড় হয়ে ওঠে।
বিভূতিভূষণ ভূত আছে বলে যেমন বিশ্বাস করতেন, তেমনি তন্ত্রসাধনাকেও সত্য জ্ঞান করতেন। ভৌতিক সাহিত্যে তার অনন্য সংযোজন তারানাথ তান্ত্রিক।
তারানাথের শুধু দুটো গল্পই লিখে যেতে পেরেছিলেন তিনি। দুটোতেই তন্ত্রসাধনা ও পিশাচদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। বিভূতিভূষণ নিজেও এসবে বিশ্বাস রাখতেন বলেই হয়তো গল্প দুটো একদম বাস্তব ও জীবন্ত মনে হয়। তারানাথের জন্ম হয়েছিল এমন এক লগ্নে যখন আকাশে হয়েছিল নীল উল্কাপাত। তারানাথের সঙ্গে শ্মশানে পরিচয় ঘটে মাতঙ্গিনী ওরফে মাতু পাগলির। মাতু পাগলীর বর পেয়েছিলেন তারানাথ। তবে বড় তান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারেননি তিনি নানা কারণে। সেসবের গল্পই শুনিয়েছিলেন কথক ও তার বন্ধু কিশোরী সেনকে।
অশরীরীর উপস্থিতির পাশাপাশি অশরীরী সত্তার ব্যক্তিকে গ্রাস করা বা সহজ কথায় 'আছর' করার ব্যাপারেও বিশ্বাস ছিল বিভূতিভূষণের। সেরকম একটি ঘটনাই উঠে এসেছে তিরোলের বালা গল্পে। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পটিতে আমরা দেখি আছরগ্রস্থ বোনকে নিয়ে তার দাদা ট্রেনে করে তিরোল যাচ্ছেন। পথিমধ্যে রাত নেমে আসায় তারা এক গ্রামে আশ্রয় নেন। মেয়েটি তখন একেবারে স্বাভাবিক। গ্রামবাসির সঙ্গে সে কথা বলে, গল্প করে, রান্নার কাজও করে। তবে শেষ পর্যন্ত বীভৎস এক ঘটনা ঘটে। মেয়েটির শেষ ঠিকানা হয় রাঁচির মানসিক এক হাসপাতাল। এ গল্পে বিভূতিভূষণের সিগনেচার হিসেবে সেই মায়াময়তা ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা যেমন আছে; তেমনি আছে করুণ ও মর্মান্তিক এক পরিণতির উল্লেখ।
কখনো কখনো ঐতিহাসিক ব্যাপারও উঠে এসেছে তার গল্পে। তার লেখা আলোচিত গল্প অভিশপ্ত-এ ঐতিহাসিক এক প্রেক্ষাপটে বর্ণিত হয়েছে কাহিনী। এ গল্পে প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি রাজ্যের দুই রাজপুত্রের বন্ধুত্ব ও স্বামীর বন্ধুর প্রতি এক নারীর বোনসুলভ স্নেহ ফুটে উঠেছে। স্নেহ থেকেই স্বামীর বন্ধুকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনেন ওই নারী। কিন্তু এরপর তার কী পরিণতি হয় আর সেই পরিণতি কীভাবে যুগের পর যুগ ধরে বহন করে চলেছে এক অভিশাপ — এমনটাই এ গল্পে তুলে এনেছেন বিভূতিভূষণ।
এর বাইরেও আরও বেশকিছু ভৌতিক ও অতিপ্রাকৃত গল্প লিখেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেসব গল্পে তেনারা এসেছেন নানাভাবে। যেমন বোমাইবুরুর জঙ্গলে-এর সেই রহস্যময় নারী, মেডেল গল্পের সেই সৈনিক, বউ চণ্ডীর মাঠ-এর সেই বউ, মশলা ভূত-এর সেইসব বস্তা — প্রতিটি গল্পে অতিপ্রাকৃত ও আধিভৌতিক ব্যাপারগুলো বিভূতিভূষণ ফুটিয়ে তুলেছেন স্বতন্ত্ররূপে।
কাশী কবিরাজের গল্প, গঙ্গাধরের বিপদ, কবিরাজের বিপদসহ আরও কিছু গল্পে তন্ত্র ও অশরীরীর উল্লেখ আছে। এর সঙ্গে প্রায় সব ভৌতিক গল্পেই রয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশের অনুপম বর্ণনা। আর তার সঙ্গে নানাভাবে এসেছে স্নেহ, মায়া, মমতার মতো চিরন্তন অনুভূতি। অতিপ্রাকৃত ও আধিভৌতিক সত্তাসমূহ এক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেন তারা রয়েছেন আমাদের আশপাশেই, তারা থাকবেন প্রকৃতিতে মিশে চিরকালই!