ভূতরা কি সাজতে পারে? কী তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ!
শিরোনামটি দেখেই মনে হতে পারে, ভূতের আবার কীসের সাজসজ্জা? ভূত মানেই তো এত্তলম্বা লম্বা নখ আর ইয়া বড় বড় দাঁতের এক বীভৎস চেহারা। এরা আবার সাজতে পারে নাকি?
কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, আমাদের ভূতেরাও নাকি আমাদের মতো করেই সাজে! আর ভূতেদের এই সাজের বর্ণনা দিয়ে গেছেন খোদ আমাদের লেখক-শিল্পীসমাজ। তারা ভূত দেখেছেন, কি দেখননি তা জানা না গেলেও, বাঙ্গালী ভূতেদের যে সাজসজ্জার প্রতি একেবারেই উদাসীন নয় (সাহিত্যের বর্ণনানুযায়ী) তা অন্তত বলাই যায়!
যারা ভূতে বিশ্বাস করেন, তাদের মতে ভূত হলো মৃত মানুষ। অর্থাৎ তারা নাকি কোনো একসময়, আমাদের মতোই মানুষ ছিল এবং এই সমাজেই বসবাস করতো। হয়তো একারণেই সাজ-পোশাক নিয়ে মানুষের মতো শখ-আহ্লাদ আছে তাদেরও! তাই ভূতের আড্ডার এই পর্বে চলুন জেনে আসা যাক, আমাদের ভূতেরা আসলে কীভাবে সাজে, আর তাদের পোশাক-আশাকই বা কেমন?
'হাঁউমাঁউখাঁউ….
মানুষের গন্ধ পাঁউ….'
ছোটোবেলায় এই কথাটি শুনলেই মনে হতো এই বুঝি কোনো রাক্ষস মানুষের গন্ধ পেয়ে গেলো! এবার আর নিস্তার নেই, এক্ষুনি এসে বড় বড় দুটি বিষদাঁত আর নখ দিয়ে খপ করে ধরে গিলে ফেলবে! আর সোজা চলে যেতে হবে তার পেটের ভেতর।
ছোটোবেলার সেই ভয়গুলো এখন আর নেই ঠিকই। কিন্তু এখনো রাক্ষসের বড়বড় দাঁত, নখওয়ালা বিশালদেহটার কথা ভাবলে পিলে চমকে ওঠে। সত্যি হোক, আর মিথ্যা- দেখতে তো ভয়ংকরই ছিল! বিশেষ করে, তাদের আগুনের মতো জ্বলন্ত চোখ আর ফুলকি ওঠা চুলগুলোর কথা ভাবলে এখনো রোমাঞ্চ জাগে।
এসব রাক্ষস-রাক্ষসীরা দেখতে প্রাণীদের মতো বলেই হয়তো পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রে তারা উদাসীন। পোশাক বলতে আদিম গুহার মানুষদের মতো কোমরের অংশে একটি কাপড় জড়িয়ে রাখাই তাদের একমাত্র সম্বল।
অথচ, একইরকম শিং, দাঁত, নখের অধিকারী হয়েও রাক্ষসীদের (নারী রাক্ষস) কিন্তু ঠিকই শৌখিন আর সাজগোজপ্রেমী হিসেবে চিত্রিত করেছেন শিল্পীসমাজ। সে হিসেবে, রাক্ষসদের মতো রাক্ষসীরা শুধু মানুষ ভক্ষণেই পড়ে থাকতো না। নিজেদের সৌন্দর্য্যের প্রতিও খেয়াল ছিল তাদের। বাঙ্গালী নারীর মতোই কুচি দিয়ে শাড়ি পরে তারা। কদাকার হলেও, হাতে-পায়ে থাকে চুড়ি আর বাজু। সেই সাথে থাকে, কানে দুল আর গলায় মালা। হয়তো শাড়ি-গয়নায় সাজিয়ে, রাক্ষসীদের রমনীরূপেই দেখতে চায় শিল্পীরা!
বউ সেজে থাকা চাই শাঁকচুন্নীর!
তবে নারী ভূতসমাজে, এই শাড়ি গয়নার প্রতি সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা যায় ভূতের সর্দারনি শাঁকচুন্নির মধ্যে। জীবদ্দশায় খুব শখ ছিল বামুনের ঘরে সংসার করার। কিন্তু সে শখ তার মেটেনি। তাই-তো হাতে শাঁখা-পলা, পায়ে নূপুর, কপালে সিঁদুর, লাল টিপ পরে এরা রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়।
একে তো গায়ের রং সবুজ, তার ওপর লাল সিঁদুর, লাল টিপের সংযোজন, যেন আরও বেশি কদাকার রূপ এনে দেয় চেহারায়। কিন্তু তাতে কী! দেখতে যতই কুৎসিত লাগুক, সাজগোজ করে বামুনের ঘরের বউ সেজে থাকা তার চাই। তবে, সধবার শখ হলেও, বেশিরভাগ জায়গায় সাদা শাড়িতেই তাকে দেখা যায়। লোককথানুযায়ী, কোথাও কোথাও নাকি শাঁকচুন্নিকে রঙ্গিন শাড়ি পরে গাছের ডালে বসে পা দোলাতেও দেখা যায়!
দৈত্য হোক আর পেত্নী হোক, শখের নেই কোনো কমতি!
কালো জিহ্বা, মোটা নখ, কুঁচকানো লম্বা চুল, মোটা রুক্ষ ঠোঁট এবং বাকানো উল্টো পায়ের পেত্নীরা দেখতে খুবই বীভৎস হয়। যদিও, মায়াবলে এরা ঠিকই মানুষের সামনে নিজের রূপ পরিবর্তন করে সুন্দরী নারীরূপে ধরা দিতে পারে।
পেত্নীরা সাধারণত উজ্জ্বল রঙের ছেঁড়া শাড়ি পরে থাকে। সেই সাথে টিপ, গয়নাগাটি পরতেও এরা ভোলে না।
এদিকে দৈত্য-দানবদের দেখে মনে হবে, রাক্ষসের সঙ্গে তাল মিলিয়েই পোশাক পরে তারা। দেখতে যত বীভৎসই হোক, সাজগোজে খামতি নেই তাদের। বিশাল শরীরেও গয়না পরা চাই-ই চাই! তাইতো বটগাছের মতো কোমরেও বাঘের ছালের মতো অদ্ভুত পরিচ্ছদ। আবার, তালগাছের মতো হাতেও শোভা পাচ্ছে এক জোড়া বাজু।
বুকটা তাদের নৌকার পাটাতনের মতো চওড়া আর মাথাটি মাঝারি একটি জালার মতো। সে মাথায় চুল না থাকলেও, শিং ঠিকই আছে। আছে দুটি মোটা মোটা কান, সে কানেও রয়েছে আবার এক জোড়া সোনার দুল। এভাবেই গয়নাগাটির সমারোহে শিল্পী যেন আরও পরিপূর্ণ করে তোলেন দৈত্যের শরীর!
নিজেদের গয়নায় সাজাতে পারেনা হতভাগী 'স্কন্ধকাটা'রা…
মাথা থাকেনা বলে নিজেদের গয়নায় সাজাতে পারে না 'স্কন্ধকাটা' ভূত। অবশ্য এরা নারী না পুরুষ তা স্পষ্ট না। তবে, বেশিরভাগ জায়গায় এদের খালি গাত্র এবং পরনে শুধু ধুতি দেখে এদের পুরুষ বলেই আন্দাজ করা হয়।
তবে স্কন্ধকাটাদের সাহেবি পোষাকে ঘোড়ায় চড়তে নাকি দেখা গেছে কখনো কখনো। এ থেকে ধারণা করা যায়, জীবিত অবস্থায় যার যার সামাজিক শ্রেণি অনুযায়ীই হয়তো তাদেরকে সাজানো হয়। যেমন, সাহেব হলে প্যান্ট, আর বামুন হলে ধুতি।
ধুতি না- সাহেবি পোশাক?
ভূত সমাজের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানীয় স্থানে রয়েছে ব্রহ্মদৈত্য। দয়ালু এবং মানবোপকারী বলেই হয়তো পবিত্রতার প্রতীকস্বরূপ ধবধবে সাদা ধুতি আর খালি গায়ে পৈতে জড়িয়ে থাকে তারা।
আবার মতান্তরে, ব্রহ্মদৈত্য জীবিত থাকাকালে ছিলেন উপনিবেশ যুগের এক ইংরেজ-শিক্ষিত ব্যক্তি, এমন কথাও প্রচলিত আছে। সে হিসেবে ব্রহ্মদৈত্যকে, সাহেবদের মতোই কোট-প্যান্ট, টাই পরতে দেখা গেছে নিশ্চয়ই!
যকভূতের ছেঁড়া জুতো আর প্রেতদের ছেঁড়া ধুতি
ব্রহ্মদৈত্যের মতো উঁচু সামাজিক অবস্থান না থাকলেও যকভূতরা জীবদ্দশ্যায় ছিল অগাধ সম্পত্তির মালিক। ফলে এরা দেখতে বেশ স্বাস্থ্যবান, পেটের দিকটা ফোলা। পোশাক আশাকও ভদ্রগোছের হয়ে থাকে। তবে কৃপণ হওয়ায় ধুতি আর ফতুয়ার নিচ দিয়ে পেটের ভুঁড়িটাকে উঁকি মারতে দেখা যায় প্রায়সময়ই।
ব্রহ্মদৈত্যের পায়ে মাঝে মাঝে যেমন খড়ম দেখা যায়, যকভূতের পায়ে দেখা যায় ছেঁড়া জুতো, যা তার কৃপণতারই প্রতীক।
এদিকে তুলনামুলকভাবে নিচু জাতের হওয়ায়, শরীরে ধুতিটুকু ছাড়া আর কোনো কাপড় থাকেনা প্রেতদের। তবে যকভূত, ব্রহ্মদৈত্যের মতো পরিস্কার ধবধবে ধুতি থাকে না তাদের। বরং নোংরা, ছেঁড়া ধুতিই তাদের একমাত্র সম্বল। এদের সঙ্কুচিত ত্বক, সরু অঙ্গ এবং অতিশয় ফোলা পেট তাদের অর্থনৈতিক দৈন্যতাই প্রকাশ করে।
তবে, মাঝে মাঝে নাকি এদের মাথায় পাগড়িও দেখা যায়!
পাগড়ির মতো মাথায় টুপি আর লম্বা লম্বা দাড়ি আছে মামদো ভূতদের। এরা নিরীহ শ্রেণির ভূত। ভয় দেখালেও ক্ষতি করে না কারও। তবে, এদের শরীরের গঠন নাকি ভারী অদ্ভূত। এদের কোমরের নিচের দিকটা ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে গেছে। মামদো ভূতদের লম্বা লম্বা হাত, কুলোর মতো কান, মুলোর মতো দাঁত। এবং পা নেই বলে, এরা বাতাসে ভেসে থাকে।
সাজতে ভালোবাসে না, এমন ভূতও আছে!
যেমন, ডাইনী। ডাইনীকে ভূতের কাতারে ফেলা হলেও এরা আসলে জীবিত নারী। বৃদ্ধ নারী, যারা কালোজাদু জানেন, তাদেরকেই ডাইনি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় অনেকসময়। বাঙ্গালী ডাইনিরা শাড়ি পরে ঠিকই। তবে, গয়নাগাটি বা সাজগোজের বালাই নেই তাদের মধ্যে। বয়স্ক বুড়ি বলেই হয়তো সাজগোজে আগ্রহী না তারা। তবে, তাদের মুখে লেগে থাকে ছোটোদের কাঁচা রক্ত!
আরেক শ্রেণির অশরীরী চরিত্র হলো জীন-পরী। এরা ভূত নয়, তবে এরা ভূতের চেয়ে ক্ষমতাবান। এদের না আছে কোনো শারীরিক কাঠামো না পোশাক। বরং সাদা বা কালো লম্বা অবয়বেই তাদের নাকি দেখা যায়। লোকমুখে প্রচলিত আছে, পরীরা নাকি দেখতে অসম্ভব রূপবতী হয়ে থাকে।
জীন-পরীদের মতোই আকার অবয়বহীন হলো আলেয়া। আলেয়া জলায় থাকে। এরা হাঁ করলে দপ করে আলো জ্বলে ওঠে আর মুখ বন্ধ করলে ওই আলো নিভে যায়। যদিও আলেয়া কোনো ভৌতিক ব্যাপার নয়, এর নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। তবুও, গ্রামাঞ্চলে একে ভূত হিসেবেই ধরা হয়।
এদিকে আকার-অবয়ব থাকলেও সাজসজ্জার বালাই নেই পিশাচদের। পিশাচ অনেকটা পশ্চিমাদের ভ্যাম্পায়ারের মতো। পেছনে ফেরানো গাধার মতো লম্বা মুখ আর পায়ে ঘোড়ার মত ক্ষুর। এদের উপস্থিতি নাকি টের পাওয়া যায় তাদের শরীরের বোটকা গন্ধ থেকে। এই বোটকা গন্ধই বলে দিচ্ছে পোশাক-পরিচ্ছদ বা সাজগোজে তারা আসলে আগ্রহী নয়। আবার একদম অদৃশ্য ভূত নিশিরও উল্লেখ আছে আমাদের ভূতসমাজে।
অপরদিকে কখনো মানুষের বেশে, কখনো বামুনের বেশে এবং কখনো অন্য কোন বেশে ঘুরে বেড়ায় গেছোভূত আর মেছোভূত। এদেরও কোনো আলাদা সাজ-পোশাক নেই। তবে মেছোভূতের হাতে বর্শী দেখা যায় মাঝে মাঝে।
ভূত আছে কি নেই, জানিনা। কিন্তু ভূত নিয়ে এসব জল্পনাকল্পনা মানুষের লোকেমুখে, সাহিত্যে উঠে এসেছে বরাবরই। হয়তো এসবের পুরোটাই কল্পনা, হয়তো এর কিছুটা সত্য। তবে, সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, মৃত্যুর পরও এসব ভূতেরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে ভুলতে পারেনি।
বাংলার ভূতরা যেমন বাঙ্গালীদের মতো ভোজনরসিক, তেমন সাজসজ্জাতেও শতভাগ বাঙ্গালীয়ানা থাকে তাদের। এখনো তারা শাড়ি-গয়না আর কপালে লাল সিঁদুর-টিপ দিতে ভোলেনা! পুরুষ ভূতেরাও ভোলেনা ধুতি-খড়ম পায়ে দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে। হয়তো আমাদের মতো ভূতদের শেকড়টুকুও এই ভূখণ্ডেই ছড়িয়ে আছে, অথবা আর তা-ই হয়তো সেই পৌরাণিক কাল থেকে মন্ত্র, জাদু, খাদ্যাভ্যাসের মতো সাজগোজেও বাঙ্গালীয়ানা বজায় রেখে এসেছে এই ভূত সমাজ- এমনটা তো বলাই যায়!