ঔপনিবেশিক ভারতে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যেভাবে নারীদের কাছে সাবান-হেলথ ড্রিংক বিক্রি করা হতো
১৯৩৭ সালের ব্রিটিশ ভারত। নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারে কাজ করেন তরুণ ভারতীয় ম্যানেজার প্রকাশ ট্যান্ডন। কে কোন পণ্য কিনছে, কেন কিনছে—সেসব জানতে ঘরে ঘরে গিয়ে জরিপ চালানোর পরিকল্পনা করে ইউনিলিভার। সম্ভবত সেটাই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম বিপণন জরিপ।
প্রকাশ সেই জরিপের অংশ হতে পেরেছিলেন। পরবর্তী জীবনে নামকরা ব্যবসায়ী বনে যাওয়া প্রকাশ ট্যান্ডন তাঁর আত্মজীবনীতে সেই বর্ণনা লিখেন। চিরাচরিত পর্দাপ্রথা থেকে বেরিয়ে সেসময় নারী তথ্য সংগ্রহকারীরা অপরিচিতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মধ্যবিত্ত গৃহিণীদের সাক্ষাৎকার নেন। তাদের জিজ্ঞেস করা হয় তারা কোন সাবান ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
শুরুতে সবাই সেই একই ধরনের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল—'আমার স্বামী যেটা বেছে নেন।' ভারতীয় পুরুষরাই সেকালে পরিবারের প্রধান কর্তা ছিল। সেই ধারার সঙ্গে মেলালে শুরুতে উত্তরটা সামঞ্জস্যপূর্ণই মনে হবে।
কিন্তু বাড়ির গিন্নিদের আরেকটু ঘাঁটাতেই তারা বললেন, 'ওহ, আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। আমার স্বামীই সাবান বেছে আনেন বটে, তবে কোনটা বাছতে হবে সেটা আমিই বলে দিই।'
এই জরিপের পর ইউনিলিভার তথা তৎকালীন লিভার ব্রাদার্স গৃহিণীদের আকৃষ্ট করতে পণ্যের প্রচার শুরু করে।
এভাবেই মাল্টিন্যাশনাল একটি প্রতিষ্ঠান ভারতীয় পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বিষয়টি স্রেফ উদ্ভাবনই করে না, বরং সফলভাবে তাকে কাজে লাগায় বলে মন্তব্য করেন ডার্থমাউথ কলেজের প্রফেসর ডগলাস ই হ্যায়নেস।
প্রফেসর হ্যায়নেস ঔপনিবেশিক ভারতে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞাপনের শুরু কীভাবে হয়, তা নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর নতুন বই 'দ্য ইমারজেন্স অব ব্রান্ড-নেম ক্যাপিটালিজম ইন লেট কলোনিয়াল ইন্ডিয়া'-তে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো কীভাবে ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের প্রলুদ্ধ করত, সেই বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
সংস্থাগুলো স্থানীয় ঐতিহ্যের ওপর নির্ভর করে এমন সব বিজ্ঞাপন নির্মাণ শুরু করল, যেখানে বিয়ে ও মাতৃত্ব নারীদের আদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত হলো। সাবান, বড়ি, পারফিউম, ক্রিম—সব পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীদের ছবি ব্যবহার শুরু হয়ে গেল। এমনকি স্বামীরা কেন তাদের স্ত্রীদের এই পণ্য কিনে দেবেন সেসবও বিজ্ঞাপনে বিস্তারিত লেখা হতে থাকল। সেসময় অবশ্য নারীরা বাজারে যেত না, পুরুষদেরই বাইরে গিয়ে কেনাকাটা সারতে হতো।
দক্ষিণ আফ্রিকায় নারীদের জনপ্রিয় আয়রন সাপ্লিমেন্ট বড়ি ছিল ফেলুনা। ভারতবর্ষের বাজারে আনার পর নারীদের আকৃষ্ট করতে চটকদার বিজ্ঞাপনের কৌশল নেওয়া হলো। গুজরাটি ভাষার পত্রিকার বিজ্ঞাপনে ইউরোপীয় নারীদের ছবি দেওয়া হলো। সেখানে শ্বেতবর্ণা এক নারী ভারতীয় স্বামীদের জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনার স্ত্রী কি সুস্থ নেই?' আরেক নারী সতর্ক করে বললেন, 'স্বামীরা, স্ত্রীর স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিন।'
ফেলুনার অন্যান্য বিজ্ঞাপনে 'মাতৃত্বের ধকল'-এর কথা উল্লেখ করে স্বামীদের উদ্দেশে বলা হলো, 'আপনার স্ত্রীকে ফেলুনার কোর্স গ্রহণ করতে রাজি করান...প্রকৃত অর্থে মা হয়ে উঠতে তাঁর সুস্থতার দিকে নজর দিন।'
শিগগিরই ইউরোপীয় নারীদের জায়গা দখল করে নিল স্মার্ট ভারতীয় নারীরা। এমনই এক বিজ্ঞাপনে মিসেস মেহতার দেখা মিলবে। শাড়ি পরা এই ভদ্রমহিলার হাতে টেনিস র্যাকেট। তিনি 'সপ্তাহে দুই কিংবা তিন সেট টেনিস খেলেন'।
মিসেস মেহতাকে এমন একজন নারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল যিনি দেখতে স্বাস্থ্যবান ও সদা হাসিখুশি। এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিনি নিয়মিত বিজ্ঞাপনের আরেক চরিত্র মিসেস ভাকিলকে হারান। দুর্বল হওয়ায় খেলা, কাজ কিংবা সামাজিক পরিসরে কোথাও মিসেস ভাকিল ফিট নন।
তবে খেলতে খেলতে যে গিন্নিরা ঘরের কাজ ভুলতে বসছেন না, সেটাও বিজ্ঞাপনেই মনে করিয়ে দেওয়া হলো—'তিনি নিপুণ হাতে ঘরের সব কাজও সুন্দরমতো পরিচালনা করেন।' এবার আর নারীদের 'উচ্ছন্নে' যাওয়ার ভয়ও থাকল না।
কিছু বিজ্ঞাপন আবার প্রবাসী ও অভিজাত ভারতীয় নারীদের উদ্দেশ্যে প্রচারিত হতো। জনপ্রিয় ব্রিটিশ মল্টেড হেলথ ড্রিংক ওভালটিনের একটি বিজ্ঞাপন ইংরেজি ও স্থানীয় পত্রিকাসহ রাস্তাঘাটে, বাস স্টপেজে প্রায়ই দেখা যেত। অধ্যাপক হ্যাইনেসের মতে এগুলো 'ইউরোপীয় মূল্যবোধসম্পন্ন প্রবাসীদের স্ত্রী ও অভিজাত নারীদের উদ্দেশ্যে প্রচারিত হতো'।
ঔপনিবেশিক শাসকদের গিন্নিদের জন্য ওভালটিন এক বিশেষ 'গরম আবহাওয়ার পানীয়' হিসেবে বিক্রি হতো, যা কিনা ভারতীয় আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করবে বলে প্রচারিত হয়েছিল। স্থানীয় যেসব বিজ্ঞাপন ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে প্রচারিত হতো সেখানেও ভারতীয় ঘরদোরের পরিবর্তে ভারতীয় পোশাক পরা মানুষদের ইউরোপীয় ধাঁচের ঘরে দেখা যেত। ছিমছাম সেসব ঘরে ভৃত্যদের জায়গা ছিল না। বিজ্ঞাপনের মূল লেখা, 'পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি চাহিদা'র দিকে লক্ষ রাখা গৃহিণীর দায়িত্ব।
তবে প্রসাধন পণ্যগুলোর বিপণনে একটু ভিন্নতা দেখা যেত। ১৯২০-এর দশকে পন্ডস ও ইউনিলিভারের মতো মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানগুলো বিবাহিত নারীদের সৌন্দর্যের প্রতি মনোযোগী হওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিত।
জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনগুলোতে সৌন্দর্য বলতে বোঝাত স্বামীর মনোযোগ ও আকর্ষণ লাভ, তাকে খুশি রাখা ইত্যাদি। আরেকটি সাবান তো বলেই বসল, এটা এখন 'সামাজিক চাহিদা', যেহেতু নারী সুন্দর হলে ভালো পাত্র পাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়, এমনকি বিয়ের বাজারে যৌতুকও কম পড়ে।
অধিকাংশ বিজ্ঞাপনে ত্বককে আরও তরুণ, সতেজ এবং উজ্জ্বল দেখতে মনে হওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া শুরু হলো। অনেকে তো সরাসরিই 'ফর্সা' ত্বকের ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করল। একটি ক্রিম প্রতিশ্রুতিও দিলো 'কালো ত্বককে চিরতরে করে দেবে ফর্সা'।
এসব বিজ্ঞাপনে ছোট চুলের ইউরোপীয় আধুনিক তরুণীদের দেখানো হতো। অভিজাত ও উঁচুশ্রেণির নারীরা এরকম হয়, এমন একটি ধারণা উপস্থাপনের চেষ্টা চলত বলে মত দেন অধ্যাপক হ্যায়নেস। সময়ের সঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপনের জন্য বোম্বের নায়িকাদের সঙ্গে চুক্তি করা শুরু করল।
সৌন্দর্যকে পণ্যে রূপান্তরিত করাই ছিল ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকের বড় সাফল্য। তবে বিষয়টি নিয়ে খুব একটা কাজ হয়নি বলেও মন্তব্য তাঁর।
গৃহিণী নারীরা স্পষ্টভাবেই বিজ্ঞাপনের মূল চরিত্র ছিলেন। ধীরে ধীরে তাদের জায়গায় আরও আধুনিক বোম্বের নায়িকারা আসতে শুরু করলেন।
পুরোনো একটি বিজ্ঞাপনে স্ত্রী-মিত্র নামে একটি টনিকের বিজ্ঞাপনে দেখা যায় পেছনে চুল বাঁধা এক নারীর ঠোঁটে লিপস্টিক। শাড়ি পরিহিতা সেই নারীর কপালে টিপ, গলায় মঙ্গলসূত্র—যা থেকে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান যে তিনি বিবাহিত।
কিন্তু এই 'আধুনিক' নারীর ছবি কি সবাই মেনে নিয়েছিল? স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী এই কনজ্যুমার কালচার ও বিজ্ঞাপনের 'আধুনিক নারী'র সমালোচনা করেছিলেন।
১৯৩৯ সালে গান্ধী লিখেন, 'আমার তো মনে হচ্ছে এই আধুনিক মেয়ে জুলিয়েট সেজে হাফ ডজন রোমিওর সঙ্গে খেলবে। সে অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসে...নিজেকে রক্ষায় সে পোশাক পরছে না, বরং অন্যকে আকৃষ্ট করতে সাজছে। নিজেকে নতুন রঙে রাঙিয়ে অসামান্য করে তোলাতেই তার যত মনোযোগ।'
কিন্তু তাতে অবশ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো ক্ষতিই হয়নি। ঔপনিবেশিক ভারতে নারীদের প্রলুদ্ধ করার কাজটা তারা সফলভাবেই করতে সক্ষম হয়েছিল।
- সূত্র: বিবিসি