বোমা নিক্ষেপে পাখির ব্যবহার: বি এফ স্কিনারের 'প্রজেক্ট পিজিয়ন'
সালটা ছিল ১৯৪৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝড় বইছে তখন! জার্মানির নাৎসিবাহিনীকে নাজেহাল করতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র। হিটলারবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে নির্ভরযোগ্য কোনো উপায় বের করতেই হবে পশ্চিমের। কিন্তু নিশানায় নিখুঁতভাবে বোমা ফেলার মতো যন্ত্রের আবিষ্কার হয়নি তখনও। তাহলে উপায়? অভিনব সমাধান নিয়ে হাজির হলেন প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবক বি এফ স্কিনার। সমাধান ছিল 'পায়রা'।
বর্তমানে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে মিসাইল নিক্ষেপ করার জন্য হরেক রকম ড্রোন রয়েছে, যা কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই কার্যসাধন করতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টা ছিল প্রাযুক্তিক দিক দিয়ে এখনকার চেয়ে ঢের অনুন্নত। বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করলে তা নির্দিষ্ট জায়গায় পড়ার সম্ভাবনা থাকত ক্ষীণ। অনেকটা আন্দাজের ওপর নির্ভর করতে হতো। এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছিলেন তৎকালীন মিলিটারি কর্মকর্তারা।
স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিসার্ভ ডিফেন্স কমিটির কাছে তার অভিনব পরিকল্পনা মেলে ধরলেন স্কিনার, যেটির কোড নাম ছিল 'প্রজেক্ট পিজিয়ন'।
স্কিনার জানান, বিমান থেকে নিশানায় নিখুঁতভাবে বোমা ফেলার একমাত্র নির্ভরযোগ্য অবলম্বন হতে পারে পায়রা। শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান কমিটির সদস্যরা। প্রথমে সন্দিহান থাকলেও শেষমেষ প্রকল্প শুরুর জন্য তাকে ২৫ হাজার মার্কিন ডলার মঞ্জুর করে কমিটি।
এর আগে নিজের মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় পায়রা ব্যবহার করেছিলেন স্কিনার। বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পায়রাগুলোকে হরেক রকমের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল তার। খিদে পেলে নির্দিষ্ট সুইচ টেপার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন পোষা পায়রাগুলোকে।
তিনি একদিন আকাশে এক ঝাঁক পাখিকে উড়তে দেখেন। এই দৃশ্য দেখে তখনই বোমা নিক্ষেপে পাখি ব্যবহারের বুদ্ধি মাথায় আসে নব উদ্ভাবনের নেশায় মত্ত স্কিনারের।
পাখিদের পাখি নয়, বরং একেকটা অসাধারণ চলনক্ষমতাসম্পন্ন 'ডিভাইস' হিসেবে দেখলেন তিনি। ভাবলেন, এরা কি একটা ক্ষেপণাস্ত্রের চালক হতে পারবে না?
প্রকল্প শুরু
পায়রার দৃষ্টিশক্তি প্রখর। এছড়াও কঠিন বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে অবিচলিত থেকে স্বাভাবিক আচরণ করে তারা। তাই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বোমাযুক্ত একটি ছোট রকেট তৈরি করেন, সেটিতে ছিল তিনটি ছোট বৈদ্যুতিন স্ক্রিন এবং তিনটি ছোট পায়রা বসতে পারে এমন ককপিট। রকেটের সম্মুখের দৃশ্য দেখা যেত স্ক্রিনগুলোতে।
প্রকল্পটিতে রাস্তার পায়রাদের ব্যবহার করেছিলেন স্কিনার। সেগুলোকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন যাতে পায়রাগুলো লক্ষ্যবস্তু চিনতে পারে এবং চেনা মাত্রই খোঁচা দেয়। তিনটি পায়রা একসঙ্গে খোঁচা দেওয়া মানে হলো সেই দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা যাবে। এভাবে ঠোকরাতে থাকলে প্রত্যেক পায়রার মাথায় সংযুক্ত তারগুলো বোমাটিকে সচল করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাবে। কিন্তু লক্ষ্যবস্তুর সংকেত দিয়ে বোমা নিক্ষেপের পর পায়রাগুলো সেখান থেকে কীভাবে পালাবে তার সমাধান খুঁজে পাননি স্কিনার। তাই বিস্ফোরণের সাথে সাথে পায়রাগুলোর মৃত্যু ছিল অবধারিত।
প্রকল্পের পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন স্কিনার। দেখিয়েছিলেন প্রশিক্ষিত পায়রাগুলোর সফল প্রদর্শনী। কিন্তু তাতেও সন্দেহ থেকে যায় কর্মকর্তাদের মনে। ফলাফল, শেষমেষ তারা এ প্রকল্প বন্ধ করে দেন।
প্রজেক্ট পিজিয়নের অবসান ঘটলেও প্রশিক্ষিত পায়রাগুলোকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন স্কিনার। কৌতুহলবশত মাঝেমধ্যেই পরীক্ষা করে দেখতেন তাদের দক্ষতা তখনও ঠিকঠাক আছে কি না। ছয় বছর পরেও দেখা যায় পায়রাগুলো আগের মতোই ঠিক জায়গায় ঠোকরাতে সক্ষম।
তবে প্রকল্প বাস্তবায়িত হোক বা না হোক, দেশের অন্যতম প্রভাবশালী মনোবিজ্ঞানী বনে গিয়েছিলেন তিনি।