রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার জন্য ব্যবহার হতে পারে; কী এই যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র অ্যাটাকমস?
প্রথমবারের মতো ইউক্রেনকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণ চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরবরাহকৃত ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এটি একটি বড় নীতিগত পরিবর্তন।
এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো "আর্মি টেকনিক্যাল মিসাইল সিস্টেম"- এটিএসিএমএস নামে পরিচিত (উচ্চারণ: "অ্যাটাকমস")। মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, এগুলো প্রথমে রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের কুরস্ক এলাকায় রুশ এবং উত্তর কোরীয় সেনাদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সহায়তার জন্য ব্যবহার করা হতে পারে।
ইউক্রেন অনেক বছর ধরে এই অনুমতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবেদন করে আসছিল। বাইডেন প্রশাসনের শেষ মাসগুলোতে এই অনুমতি মিলল। এদিকে, নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেবেন।
ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর কাজ কী?
লকহিড মার্টিনের তৈরি করা অ্যাটাকমস একটি স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর মডেলের ওপর ভিত্তি করে এটি প্রায় ১৯০ মাইল দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে এবং এতে প্রায় ৩৭৫ পাউন্ড বিস্ফোরক থাকে।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আর্টিলারি রকেটের তুলনায় অনেক উঁচুতে ওঠে এবং অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছায়। মাটিতে ফেরার সময় মাধ্যাকর্ষণের টানে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নেমে আসে। এই মিসাইলগুলো এইআইএমএআরএস (হাইমারস) মোবাইল লঞ্চার, যেটি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করেছে এবং ব্রিটেন ও জার্মানি থেকে পাঠানো পুরোনো এম২৭০ লঞ্চার থেকেও ছোঁড়া যেতে পারে।
অ্যাটাকমস ক্ষেপণাস্ত্রকে অনেক সময় "দীর্ঘ-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র" বলা হলেও, এটি আপেক্ষিক একটি শব্দ। এটি ইউক্রেনের অন্য যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে রাশিয়ার আরও গভীরে আঘাত করতে পারে। তবে এটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বা আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো দীর্ঘ দূরত্বে পৌঁছাতে পারে না।
এই ক্ষেপণাস্ত্রের ১৯৮০-এর দশকে তৈরি করা হয় শত্রুপক্ষের গভীরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ সোভিয়েত লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার জন্য। এটি তখনকার দিনে একটি দুর্লভ গাইডেড অস্ত্র ছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত "ডাম্ব বোম্ব" বা আনগাইডেড অস্ত্রের ওপর নির্ভর করত।
বর্তমানে পেন্টাগনের কাছে অ্যাটাকমস-এর দুটি সংস্করণ রয়েছে; একটি ক্লাস্টার অস্ত্র এবং অন্যটি একটি একক বিস্ফোরক বহন করে।
যুক্তরাষ্ট্র কেন অপেক্ষা করছিল?
ইউক্রেনকে অ্যাটাকমস ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া একটি সংবেদনশীল বিষয় ছিল, বিশেষ করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালানোর পর থেকে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দীর্ঘদিন ধরে এমন অস্ত্রের দাবি জানিয়ে আসছেন, যা রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে গভীরে আঘাত করতে সক্ষম।
যদিও গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে অ্যাটাকমস সরবরাহ করেছিল, বাইডেন প্রশাসন এতদিন ধরে সেগুলো রাশিয়ার সীমান্তে ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি।
এই বিলম্বের মূল কারণ ছিল, উত্তেজনা বৃদ্ধির আশঙ্কা। প্রেসিডেন্ট বাইডেন স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, "আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করছি।"
পেন্টাগনের কিছু কর্মকর্তাও এই ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহে আপত্তি জানিয়েছিলেন, কারণ এটির মজুদ সীমিত।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র তার দেশের বড় ধরনের পালটা আক্রমণ চালানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, এই অস্ত্র রাশিয়ার শহর বা সাধারণ মানুষের ওপর ব্যবহার করা হবে না।
রোববার (১৭ নভেম্বর) রাতে এক ভাষণে জেলেনস্কি এই নীতিগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেন, যদিও সরাসরি কিছু জানাননি। তিনি বলেন, "এ ধরনের বিষয় ঘোষণা করা হয় না। রকেটগুলোই নিজের কথা বলবে।"
ইউক্রেন কীভাবে এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করবে?
রাশিয়ান সেনাবাহিনী প্রায় ৫০,০০০ সৈন্য নিয়ে একটি বড় আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যার মধ্যে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যও রয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো আগস্টে ইউক্রেন যে রাশিয়ার এলাকা দখল করেছিল, তা পুনরুদ্ধার করা। এই হামলা ইউক্রেনের কুরস্ক অঞ্চলের ওপর কেন্দ্রীভূত হবে।
ইউক্রেন অ্যাটাকমস ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সৈন্য সমাবেশ, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম, সরবরাহ কেন্দ্র, গোলাবারুদের গুদাম এবং রাশিয়ার গভীরে থাকা সরবরাহ লাইন ধ্বংস করতে পারে। এতে রাশিয়ার পালটা আক্রমণের কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়বে।
২০২২ সালে প্রেসিডেন্ট বাইডেন কয়েকশ' অ্যাটাকমস ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের অনুমোদন দিয়েছিলেন, যা রাশিয়া-অধিকৃত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড, যেমন ক্রিমিয়ায় ব্যবহারের জন্য ছিল। তবে কুরস্ক অঞ্চলে ব্যবহারের জন্য ইউক্রেনের হাতে এখনো কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র অবশিষ্ট রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
যুক্তরাষ্ট্র কি অ্যাটাকমস ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে?
মার্কিন সেনাবাহিনী ১৯৯১ সালে অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম-এ প্রায় ৩০টি অ্যাটাকমস ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইরাকের মধ্যম-পরিসরের ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার এবং সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সাইট ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
সেই সময় প্রথম প্রজন্মের ক্লাস্টার মিউনিশন সংস্করণ প্রায় ১০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারত। লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর পর মিসাইলগুলো ৯৫০টি ছোট বোমা ছেড়ে দিত।
২০০৩ সালের অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম-এর প্রথম দিকের অভিযানে মার্কিন সেনাবাহিনী ৪০০টিরও বেশি অ্যাটাকমস নিক্ষেপ করেছিল।
তবে, ক্লাস্টার মিউনিশনের বেশ কিছু ব্যর্থতার কারণে [যুদ্ধের পরে বিস্ফোরিত না হয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে থাকত এবং সৈনিক ও সাধারণ মানুষের ক্ষতি করত] পেন্টাগন পরে এগুলোর ব্যবহার সীমিত করে।
২০০০-এর দশকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রাথমিক অ্যাটাকমস সংস্করণগুলো সংস্কার করে এবং বোম্বলেটের পরিবর্তে একটি একক বিস্ফোরক ওয়ারহেড যুক্ত করে।