ভোররাতে ভিড় জমে পুরান ঢাকার যে পোলাওয়ের জন্য
ফজরের আজান শেষে আলো ফোটার সময় হয়নি তখনো। পুরান ঢাকার বকশী বাজারের রাস্তায় নামাজ পড়তে বের হওয়া দুই-একজন মুসল্লির হেঁটে চলা ছাড়া কোনো সাড়া-শব্দ নেই।
এই শুনশান রাস্তায় কিছুটা অঘটনের ভয় নিয়েই গুগল ম্যাপ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম বন্ধুদের আড্ডায় খোঁজ পাওয়া মানিক চানের পোলাওয়ের টানে। শুনেছিলাম ভোরের আগেই শেষ হয়ে যায় পোলাও-মাংস বিক্রি।
সময় তখন সাড়ে পাঁচটা পেরিয়ে গেছে। খাবার না পাওয়ার অঘটনটা এড়ানো যাবে না ভেবে নিলেও দিগু বাবু লেনে পৌঁছে হাসি ফুটল মুখে। পোলাওয়ের গন্ধে মুখরিত রাস্তায় ভোররাতের নীরবতা ভেঙে অপেক্ষা করছেন ভোজনপ্রেমীরা। গলির মোড়ের পাশেই ডেকচি সাজিয়ে খাবার পরিবেশন করছেন স্বয়ং মানিক চান।
খেতে পাব কি না, জিজ্ঞেস করতেই রাস্তার পাশে পেতে রাখা চেয়ারে বসে পড়তে বললেন। মেন্যুতে সেদিন পোলাওয়ের সঙ্গে ছিল বুটের ডাল দিয়ে খাসির মাংস। দুই পাশের চেয়ার আর বেঞ্চিতে বসে রাতজাগা ভোজনরসিকেরা পেটপুজোয় ব্যস্ত। কেউ এসেছেন মিরপুর থেকে, কেউ মগবাজার, কেউ বা গেন্ডারিয়া থেকে। মোটরসাইকেলে করে তিন বন্ধুর একটা দল এসে খাবার অর্ডার করতে করতে জানালেন, পাঁচ মাস ধরে এখানে খেতে আসার প্ল্যান করছেন। অবশেষে সময় করতে পারলেন আজ।
ধোঁয়া ওঠা পোলাওয়ের উপর ডাল-মাংস বেড়ে দিলেন মানিক কাকা। সৌভাগ্যক্রমে খাসির নলির পিস এলো পাতে। তুলতুলে নরম মাংসে হাত দিতেই ছিঁড়ে গেল। লেবুর রস দিয়ে পোলাও-মাংস মাখতে মাখতে পেটের খিদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল আরো।
প্রথম লোকমা মুখে দিতেই মনে হলো মুখে মুখে শুনে আসা প্রশংসাগুলো একটুও অতিরঞ্জন নয়। অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে মাংসের স্বাদ ঢাকা পড়েনি রান্নায়, বরং সব মশলার ঠিকঠাক অনুপাতে ডাল-মাংসের যুগলবন্দী হয়ে উঠেছে অনন্য স্বাদের। নরম ঝরঝরে পোলাওয়ে নেই তেলের আধিক্য। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে বাধ্য হলাম।
পাশের চেয়ারে বসে খাচ্ছিলেন গেন্ডারিয়া থেকে আসা সোহেল। জানালেন মানিক চানের পোলাও-মাংসের জন্য ১৫০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে এই দিগুবাবু লেনে এসেছেন তিনি।
সোহেলের ভাষ্যে, 'সাধারণত বিয়ে বাড়ির রান্নার যে স্বাদ হয়, সেটাই পাওয়া যায় এখানে। সবসময় তো বিয়েবাড়িতে যাওয়া হয় না, তাই সুযোগ পেলেই ভোররাতে ঘুম থেকে ওঠে চলে আসি মানিক চানে। কোনো কোনো দিন আসতে একটু দেরি হয়ে গেলে খাবার পাই না। আমরা ঢাকাইয়াদের কাছে তো পোলাও-মাংস সবচেয়ে প্রিয় খাবার। সকালের নাস্তায় পোলাও খাওয়ার আমেজই অন্যরকম।'
খাওয়া শেষে বাসার জন্য পার্সেল নিচ্ছিলেন মগবাজার থেকে আসা মধ্যবয়সী ভদ্রলোক ফারুক। বন্ধুর সাথে এসেছেন তিনি। বন্ধুর মুখে শুনে আর ইউটিউবে ভিডিও দেখেই মানিক চানের পোলাও নিয়ে আগ্রহ জন্মেছিল তার। প্রথমবার খেয়ে বেশ সন্তুষ্ট তিনি।
রাতের ডিউটি শেষে টহলরত পুলিশেরাও খাবার পার্সেল নিয়ে যাচ্ছিলেন সঙ্গে করে। মিটফোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার আলভীও এসেছিলেন তার নাইট ডিউটি শেষে। বললেন, 'এখানের খাবারে হোমমেড ফিলটা পাওয়া যায়। ভোরবেলার খিদে মেটাতে তাই প্রায় রেগুলারই খেতে আসা হয় আমার।'
সোয়া ছয়টা নাগাদ হাড়িতে মাংস শেষ। তবুও খেতে আসা মানুষের সংখ্যা কমেনি। পোলাওয়ের সাথে ডাল-ঝোল দিয়েই খাচ্ছেন বাকিরা। মোবাইলে কল করে খাবার আছে কি না জানতে চেয়ে নিরাশ হচ্ছিলেন অনেকেই।
মানিক কাকার সহকারী অনিক জানালেন, ফুটবল বিশ্বকাপে জনপ্রিয় দলগুলোর খেলা যেদিন থাকে সেদিন ফজরের আজানের সাথে সাথেই খাবার শেষ হয়ে যায়। খেলা শেষ হওয়ার পর থেকেই ফুটবলপ্রেমীরা এসে ভিড় জমান। বেশি ভিড় হলে লাইন ধরে আগে টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। ফজরের আজানের কিছুটা আগেই তখন খাবার দেওয়া শুরু হয়।
মাস দুয়েক আগে মাঝরাত থেকেই খাবার দেওয়া হতো মানিক চানের দোকানে। দিনের আলো ফোটার আগেই বিক্রিবাট্টা শেষ করে ভোর নাগাদ ঘরে ফিরে যেতেন মানিক কাকা আর তার সঙ্গীরা। ইউটিউব, ফেসবুকে ভিডিও ব্লগ দেখে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় জমাতেন রাত তিনটার আগেই। ঘণ্টাখানেক লাইনে থেকে টোকেন নিয়ে খাবার পাওয়া যেত।
কিন্তু মানুষের ভিড় বাড়তে থাকায় মাঝরাতে অতিরিক্ত শব্দের কারণে এলাকাবাসী বিরক্ত হয়ে অভিযোগ জানান। গভীর রাতে দূর থেকে আসতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগতেন অনেক কাস্টমার। স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তখন নির্দেশ দেয় ফজরের পর থেকে খাবার দেওয়া শুরু করতে।
তবে মাঝরাতে খাবার দেওয়ার সময়ই তার বেশি বিক্রি হতো বলে জানান মানিক কাকা। গভীর রাতের অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে আসতেন অনেক কাস্টমার। ঘণ্টাখানেকেরও কম সময়ে তখন বিক্রি হয়ে যেত ৪০ কেজির মতো পোলাও-মাংস। সময় পরিবর্তন হওয়ায় এখন আগের চেয়ে বিক্রি কমে গেছে অনেক। প্রতিদিন ভোরে ৮০ থেকে ১০০ জনের জন্য রান্না করেন তিনি বর্তমানে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি ব্যবসার উপর ভ্যাট আরোপ করায় বাড়াতে হয়েছে খাবারের দামও। প্রতি প্লেট খাবার এখন ১৮০ টাকা।
সপ্তাহের একেকদিন রান্না হয় একেক মেন্যু। শনিবারে থাকে সাদা পোলাওয়ের সঙ্গে খাসি-আলুর ঝোল, রবিবারে খাসি-বুটের ডালের ঝাল তরকারি, সোমবারে মুরগির রোস্ট, মঙ্গলবারেও খাসি-বুটের ডাল, বুধবারে থাকে মুগডাল, ঘি, জাফরান দিয়ে খাসির স্পেশাল তেহারি আর বৃহস্পতিবারে থাকে মুরগির ভুনা খিচুড়ি। শুক্রবারে সাপ্তাহিক বন্ধ।
মানিক চানের বাবা প্রায় ৭০ বছর আগে শুরু করেছিলেন এই ব্যবসা। তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার আগে থেইকাই মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে মেইন রোডের সাথে আমার আব্বা পোলাও-মাংস বেচতেন ভোরে।
'আব্বা মারা যাওয়ার পরে এরশাদের আমলে আমি ব্যবসার দায়িত্ব নিই। মেইন রোড থেইকা গলির ভিতরে দিগুবাবু লেনে আসি। আমার বাসাও এখানেই। বাবার ঐতিহ্য বজায় রাইখাই নিজের বাসার রান্নাঘরে পরিবারের সাথে রান্নার করি।'
মানিক কাকার গল্প শুনতে শুনতেই দেখলাম বাইসাইকেলে করে খাবার খেতে এসেছেন দুজন। মাংস শেষ হয়ে গেছে শুনেও পোলাও আর ডাল-ঝোল দিয়ে খেতে বসলেন তারা।
আলাপ করে জানতে পারলাম নবাগত দুই কাস্টমারের একজন বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার কামার আব্বাস খোকার। বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে বেশ আগ্রহী তিনি। বছরখানেক ধরে ঢাকায় কর্মরত আছেন। এখানে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি নানারকম খাবারের স্বাদ নিতে ভালোবাসেন তিনি। ভোরবেলায় বন্ধুকে নিয়ে গুলশান থেকে সাইক্লিং করে এসেছেন মানিক চানের পোলাও খেতে।
খাসির মাংস না পেলেও ঝোল-পোলাও খেয়েই তৃপ্ত কামার আব্বাস। মানিক কাকার স্পেশাল খাসির তেহারি খেতে আরেকদিন আসার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন এরমধ্যেই। ঢাকায় সবচেয়ে ভালো নেহারি কোথায় পাওয়া যায় তারও খোঁজ করছিলেন তিনি।
মানিক কাকা জানালেন, একদিন আগে কল করে খাবার বুক করে রাখার ব্যবস্থাও আছে এখানে। সেক্ষেত্রে অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে রাখতে হয়। তবে ভোরবেলায় নিজে এসেই খাবার নিয়ে যেতে হয়। ডেলিভারির কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের।
রাস্তার পাশে খাওয়ার ব্যবস্থা হলেও সর্বোচ্চ পরিচ্ছন্নতা বজার রাখার চেষ্টা করা হয় এখানকার খাবারে। ইন্টারনেটে দেখে দেশের বাইরে থেকেও প্রবাসী মানুষজন এসে প্রায়ই খোঁজ করেন মানিক চানের পোলাওয়ের।