নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রমের ৭৫ বছর: শান্তি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করছে এখনও
দেশ ভাগের পূর্বে ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ভয়ঙ্কর সেই দাঙ্গার পর 'শান্তি মিশনে' নোয়াখালী ছুটে আসেন মহাত্মা গান্ধী। সম্প্রীতির বার্তা দিতে ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গান্ধী আশ্রম। ৭৫ বছর পর আজও আশ্রমটি নিজের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠা বা সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখাই নয়, দারিদ্র বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নেও কাজ করে চলেছে সংস্থাটি।
১৯৪৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস নোয়াখালী ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। শান্তি মিশনের অংশ হিসেবে গান্ধীজি ৪৭টি গ্রামে ভ্রমণ ও প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষত, ক্ষোভ দূর করতে সব সম্প্রদায়ের মানুষদের সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
শান্তি মিশনের অংশ হিসেবে ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে বেগমগঞ্জ উপজেলার জয়াগ গ্রামে আসেন গান্ধীজি। তাঁর আগমণ উপলক্ষে স্থানীয় জমিদার এবং নোয়াখালী জেলার প্রথম ব্যারিস্টার হেমন্তকুমার ঘোষ নিজের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি মহাত্মা গান্ধীকে দান করেন। সেখান থেকেই তিনি 'অম্বিকা-কালীগঙ্গা দাতব্য ট্রাস্ট' প্রতিষ্ঠা করেন।
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট (গ্যাট)-এর পরিচালক রাহা নবকুমার পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, '১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে এই ট্রাস্ট সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তির বার্তা প্রচারের সঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও নোয়াখালী তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত বৃহত্তর নোয়াখালীতে এই ট্রাস্টের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে'।
গত বছর অক্টোবরে দূর্গাপূজা চলাকালে কুমিল্লা থেকে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলাকালে নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ উপজেলায় কয়েকজন দাঙ্গাকারী একটি মন্দিরে হামলা করতে উদ্যত হয়। সেসময় স্থানীয় মুসলিমদের আরেকটি দল তাদের থামায়। রাহা বলেন, স্থানীয় গান্ধী আশ্রমের প্রচারিত দর্শনের কারণেই তা সম্ভব হয়েছিল। তিনি বলেন, ১৯৯৪ সাল থেকে গান্ধী আশ্রম সফলভাবে ২৭ হাজারের বেশি গার্হস্থ্য সহিংসতা ও পারিবারিক বিবাদের সমাধান করেছে। অসংখ্য নারী এই আশ্রম থেকে আইনি ও আর্থিক সহায়তা পায় বলেও জানান তিনি।
'এখানকার অধিকাংশ মানুষ থানা বা আদালতে যাওয়ার পরিবর্তে পারিবারিক সহিংসতাসহ বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। এর ফলে তালাকের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাও অনেক কমে গেছে,' বলেন তিনি।
'আমাদের নারী সদস্যরা বিভিন্ন ঝগড়ার সময় মৌখিক তালাকের ঘটনায় নতুন সমাধান বের করেছে। এরকম কিছু হলে তারা দু-তিনদিনের জন্য স্বামীদের ঘর ছাড়তে বাধ্য করে। এরপর কিছুদিন বাদে তাদের স্বামীরা ঠাণ্ডা মাথায় ফিরে এলে বিভিন্ন কাউন্সেলিং প্রদানের মাধ্যমে সমঝোতার ব্যবস্থা করা হয়,' বলেন তিনি।
জায়াগ গ্রামের নাসরিক আখতার নামের ২৬ বছরের এক নারী আসাম টাইমসের এক সাক্ষাৎকারে জানান, তাঁর অটোরিকশা চালক স্বামী মান্নান হোসেইন তাকে নিয়মিত মারধোর করত। একদিন মেরে বাড়ি থেকে বেরও করে দেয়। নাসরিন বলেন, 'সেসময় আমি গান্ধী আশ্রমে গিয়ে বিষয়টি জানাই। তারা আমার স্বামীকে এই ঘটনার জন্য মোটা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করে। আমি রাজি হই, কারণ এমন মানুষের সঙ্গে আমার সংসার করার ইচ্ছাও ছিল না'।
১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে উগ্রবাদী নাথুরাম গডসের হাতে খুন হন মহাত্মা গান্ধী। এরপর কয়েকজন বাদে গান্ধীর অধিকাংশ অনুসারীই নোয়াখালী ছেড়ে যান। যারা থেকে গিয়েছিল, তাদের ওপর নেমে আসে পাকিস্তান সরকারের কড়াঘাত। অধিকাংশ অনুসারীকেই গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ট্রাস্টের সম্পত্তি লুট করাসহ জমি দখল করে স্থানীয় সুযোগসন্ধানীরা।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর শান্তি মিশনের টিম ম্যানেজার চারু চৌধুরী কারাগার থেকে মুক্তি পান। স্বাধীন দেশে আবারও আশ্রমটি পুনর্প্রতিষ্ঠা করার কাজ শুরু করেন তিনি। আশ্রমের দখল হয়ে যাওয়া জমি পুনরুদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের জারি করা গ্যাজেটের পরআশ্রমটি অসাম্প্রদায়িক ও অরাজনৈতিক জনকল্যাণমূলক সংস্থায় পরিণত হয়। এসময় 'আম্বিকা কালীগঙ্গা দাতব্য ট্রাস্ট' বদলে আশ্রমের নাম রাখা হয় 'গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট'।
ট্রাস্টের কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশ ও ভারত দু'দেশের সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী একটি কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতার পর ট্রাস্টের দৃষ্টিভঙ্গি, উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ডে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে আশ্রমটি কাজ করতে শুরু করে বলে জানান রাহা।
দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে আশ্রমটি এখন ক্ষুদ্র ব্যবসা ব্যবস্থাপনা ও হিসাব রক্ষণের মতো বিষয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ-বাজারে সদস্যদের অবাধ প্রবেশসহ দুর্গতদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতেও কাজ করে গান্ধী আশ্রম।
ট্রাস্টের তরফ থেকে নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য বিশেষ কর্মসূচিরও আয়োজন করা হয়। এর বাইরে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে পানিবাহিত রোগ নির্মূল করাও ট্রাস্টের অন্যতম উদ্যোগ।
নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী জেলা এবং নোয়াখালী ও চাটখিল পৌর এলাকার ১০২টি গ্রামে আশ্রমটি দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করে। আশ্রমটি আশেপাশের এলাকার দরিদ্র প্রায় ২৫ হাজার পরিবারের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে। ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর ১৫২ তম জন্মবার্ষিকীতে ভারত সরকারের সহায়তায় আশ্রমের জাদুঘর সংস্কার করে নতুনভাবে উদ্বোধন করা হয়।
- সূত্র: আসাম ট্রিবিউন