যেখানে পা রাখার অধিকার ছিল না কালোদের!
তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে শত শত গান। সতেরো বছর বয়সেই তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন এবং বনে যান ফুটবলের রাজা।
বয়স বিশ পেরোনোর আগেই ব্রাজিলের সরকার তাকে 'জাতীয় সম্পদ' আখ্যা দিয়ে বলে দেয়, তিনি 'অরপ্তানিযোগ্য'। ব্রাজিলের জাতীয় দলের হয়ে তিনি তিন-তিনটি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন, সান্তোসের হয়ে জেতেন দুটি। এক হাজারতম গোল করার পরও তিনি থামেননি। আশিটি দেশে এক হাজার তিনশোর বেশি ম্যাচ খেলেছেন। একের পর এক। গোল করেছেন তেরোশোর বেশি।
একবার তিনি একটি যুদ্ধও থামিয়ে দিয়েছিলেন—তার খেলা দেখার জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল নাইজেরিয়া ও বায়াফ্রা।
অবশ্য তার খেলা দেখার জন্য শুধু একটি যুদ্ধবিরতি কেন, আরও অনেক কিছুই করা যায়।
পেলে যখন দৌড়াতেন, প্রতিপক্ষের ফাঁক গলে তিনি এমনভাবে ছুটতেন, ঠিক যেভাবে মাখন কেটে ছুরি এগিয়ে যায়। তিনি যখন থামতেন, তার দুপায়ে সৃষ্ট গোলকধাঁধায় হতবিহ্বল হয়ে যেত প্রতিপক্ষ।
তিনি যখন শূন্যে লাফ দিতেন, মনে হতো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন যেন।
তিনি যখন ফ্রি কিক নিতেন, প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের মন আকুলিবিকুলি করত গোলপোস্টের দিকে ফিরে নির্নিমেষ চেয়ে থাকার জন্য, যাতে মোহনীয় গোলটা নিজ চোখে দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন।
তার জন্ম এক অজ-পাড়াগাঁয়ে। আর সেই তিনিই ক্ষমতা ও সৌভাগ্যের এমন চূড়ায় পৌঁছলেন, যেখানে পা রাখার অধিকার ছিল না কালোদের।
মাঠের বাইরে তিনি কক্ষনো একটা মিনিট অলস বসে থাকতেন না। তার পকেট থেকে কক্ষনো একটা পয়সা গলে পড়ে যায়নি।
তবে আমরা যারা তার খেলা দেখার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেছি, তাদের কপালে জুটেছে অসাধারণ সৌন্দর্যের দান: অমর সব মুহূর্ত। যে মুহূর্তগুলো আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করে, হ্যাঁ, অমরত্ব বলতে একটা জিনিসের অস্তিত্ব সত্যিই আছে।
পেলের 'পবিত্র' গোল
১৯৬৯ সাল। মারাকানা স্টেডিয়ামে ভাস্কো ডা গামার বিপক্ষে খেলছে সান্তোস। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ফাঁকি দিয়ে, মাটি না ছুঁয়েই, বিদ্যুৎগতিতে মাঠের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে চলে গেলেন পেলে। আর ঠিক যখন বলটা জালে জড়াবেন, শিকার হলেন ফাউলের।
রেফারি বাঁশি বাজালেন, পেনাল্টি। পেলে নিতে চাইলেন না। কিন্তু মাঠে উপস্থিত এক লাখ লোক তার নাম ধরে গগনবিদারী চিৎকার জুড়ল। তাদের চিৎকারে পেনাল্টি নিতে বাধ্য হলেন তিনি।
মারাকানায় বহু গোল করেছেন পেলে। তার মধ্যে আছে ১৯৬১ সালের ঐশ্বরিক সেই গোলটিও। ফ্লুমিনেনসের বিপক্ষে সেই ম্যাচে তিনি সাতজন ডিফেন্ডার এবং শেষে গোলরক্ষকে ড্রিবল করে গোলটি করেছিলেন। কিন্তু এই পেনাল্টির ব্যাপারটা আলাদা।
লোকের মনে বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল, এই পেনাল্টির মধ্যে একটা পবিত্রতার ব্যাপার আছে। ঠিক সে কারণেই জগতের সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ জনারণ্যে নেমে এল মৃত্যুর নিস্তব্ধতা। ঠিক যেন কারও হুকুম তামিলের মতো করে থেমে গেল সমস্ত গুঞ্জন: কেউ টুঁ শব্দটি করছে না, একজনও নিশ্বাস ফেলছে না।
আচমকাই যেন সবগুলো মারাকানার স্ট্যান্ড ফাঁকা হয়ে গেছে, খেলার মাঠটাও। আছেন শুধু পেলে ও গোলকিপার, আন্দ্রাদা। বাকি সবকিছুর অস্তিত্ব বিলীন। অপেক্ষা করছেন এই দুজন। সাদা পেনাল্টি স্পটের পাশে রাখা বলটার পাশে দাঁড়িয়ে পেলে। বারো কদম দূরে, দুই গোলপোস্টের মাঝে, একটু সামনে ঝুঁকে প্রস্তুত আন্দ্রাদা।
পেনাল্টি কিক নিলেন পেলে। ওতে আঙুল ছোঁয়াতে পারলেন গোলকিপার, কিন্তু পেলেকে ঠিকই জালে বল জড়ালেন। এটি ছিল তার হাজারতম গোল। এর আগে ফুটবলের ইতিহাসে আর কোনো খেলোয়াড় এক হাজার গোল করতে পারেননি।
পরক্ষণেই প্রাণ ফিরে পেল মারাকানা স্টেডিয়ামের জনারণ্য। শিশুর মতো আবেগে ফেটে পড়ল এক লাখ জনতা, উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাত্রি।
- এদুয়ার্দো গালিয়ানো: উরুগুয়ের লেখক ও সাংবাদিক। ফুটবলকে নিয়ে তার লেখা সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো বইটি ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদাই পেয়ে গেছে। বইটির দুটি অধ্যায় তিনি লিখেছেন পেলে ও তার গোল নিয়ে। ফুটবলের রাজার প্রয়াণে তার প্রতি সম্মান জানাতে অধ্যায় দুটি অনূদিত হলো টিবিএসের পাঠকদের জন্য।
- ভাষান্তর: মারুফ হোসেন