২০২২-এ মহাকাশবিজ্ঞানের সেরা ঘটনা: পর্যটক ও বিশ্বের অভূতপূর্ব অগ্রগতি!
করোনা মহামারি প্রাদুর্ভাব, তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব—এতকিছু সত্ত্বেও বর্তমানে মহাকাশ খাতের বিকাশ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতির। মহামারির প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে থাকা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও গুটি গুটি পায়ে আবার মহাকাশ জয়ের লক্ষ্যে এগোনো শুরু করেছে আমাদের সৌরজগতের নীল গ্রহটি।
মহাকাশবিজ্ঞানের অর্জন এবং অগ্রগতি বিবেচনায় ২০২২ ছিল একটি অন্যতম বছর। সৌরজগতের নানা অজানাকে জানতে সরকারি ও বেসরকারি—দু'ভাবেই পরিচালিত হচ্ছে মহাকাশ অভিযান।
চলতি বছর পৃথিবীর জন্মেরও আগের মহাবিশ্ব দেখতে পেয়েছে মানবজাতি। অন্যদিকে মহাকাশ স্টেশনে মানুষ পাঠিয়েছে চীন। আবার এ বছরই বেসরকারি রকেটের সফল উৎক্ষেপণ করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, ২০২২ সালের মহাকাশ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে শীর্ষ কিছু অগ্রগতির কথা। সূত্র দ্য প্রিন্ট।
বেসামরিক মহাকাশ ভ্রমণ
মহাকাশ ঘুরে দেখার ইচ্ছা আমাদের অনেকেরই থাকে। কিন্তু এতদিন কেবল নভোচারী বা মহাকাশচারীরাই নানা গবেষণার অংশ হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণ করতে পারতেন। কিন্তু ২০২২ সালে এসে পাল্টে গেছে এই চিত্র।
মানুষকে মহাকাশ ঘুরে দেখাতে বিশেষ রকেট বানিয়েছে জেফ বেজোসের কোম্পানি ব্লু অরিজিন। নিউ শেপার্ড নামক এই রকেটে করেই গতবছর মহকাশ ভ্রমণ করে এসেছেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজনের এই প্রতিষ্ঠাতা। চলতি বছরের মার্চ, জুন ও আগস্ট মাসে প্রতি ফ্লাইটে ছয়জন যাত্রীকে মহাকাশে ঘুরিয়ে এনেছে নিউ শেপার্ড।
আবার, এপ্রিলে প্রথমবারের মতো পর্যটকদের একটি দল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভ্রমণ করে, যাদের সবাই ছিলেন বেসামরিক। ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠিত স্পেসএক্স এবং মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার উদ্যোগে এ ভ্রমণ পরিচালিত হয়। ইতোমধ্যে এই দুই প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয়বারের মতো আরেকটি ট্রিপের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
এছাড়াও জাপানের বিলিয়নিয়ার ইউসাকু মায়েযাভা গত বছরের ডিসেম্বরে পর্যটক হিসেবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) ঘুরে এসেছিলেন। আর চলতি বছর চাঁদে ঘুরে আসার কথা জানালেন তিনি।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ
পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে নিঃসঙ্গ প্রহরীর মতো মহাবিশ্বের দিকে নজর রাখছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি)।
নাসার নেতৃত্বে এই আন্তর্জাতিক মহাকাশ অভিযান প্রকল্পের অন্যান্য অংশীদার হলো, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ও কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি। গত বছরের (২০২১) ডিসেম্বরে উৎক্ষেপণ করা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী এই স্পেস টেলিস্কোপ।
২০২২-এর জুলাইয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেয় জেমস ওয়েব। এতে ধরা পড়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি বছর আগের মহাবিশ্বের ছবি। তখন আমাদের পৃথিবীর জন্মও হয়নি। এই ছবি এখনও পর্যন্ত পৃথিবী থেকে তোলা সর্বোচ্চ দূরত্বের ছবি।
ভারতের সফল রকেট উৎক্ষেপণ
এ বছর মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছে ভারতে প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত রকেট বিক্রম-এস।
১৮ অক্টোবর অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে সফলভাবে উড্ডয়ন এই রকেট উড্ডয়ন করা হয়।
ভারতের সরকারি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর কয়েক দশকের আধিপত্যের অবসান ঘটায় দেশটির প্রথম বেসরকারিভাবে নির্মিত রকেট বিক্রম-এস।
চীনের স্পেস স্টেশন
চলতি বছর জুলাই ও অক্টোবর মাসে লাবরেটরি মডিউল সংযুক্ত করে চীন তাদের তিয়ানগং স্পেস স্টেশন সম্পূর্ণ করেছে। মহাকাশে নিজেদের স্টেশনে থাকার জন্য দেশটির এটাই প্রথম নভোচারী পাঠানোর ঘটনা।
এই স্টেশনে রয়েছে দুটো বিজ্ঞানাগার, একটি ডকেবল লাইফবোট ও রবোটিক কার্গো শিপ। এখানে বর্তমানে তিনজন নভোচারী আছেন। তারা সেখানে ছয় মাস থাকবেন। পরে তারা ফিরে এলে আবার নতুন নভোচারীদের সেখানে পাঠানো হবে।
মহাকাশে ধ্বংসাবশেষ
দিন দিন পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইটের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সাথে মহাকাশে জমা হচ্ছে নানা আবর্জনা বা ধ্বংসাবশেষ। এই যেমন, রকেটের ফেলে দেওয়া অংশ, অকেজো স্যাটেলাইট বা স্যাটেলাইটের ভাঙা টুকরো ইত্যাদি।
এটি ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। তাই আগেভাগেই এ সমস্যা মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন মহাকাশবিজ্ঞানীরা।
২০২২-এর জানুয়ারি মাসে এক চীনা স্যাটেলাইট একটি অব্যবহৃত পড়ে থাকা স্যাটেলাইটকে উচ্চতর কক্ষপথে রেখে আসে, যেখানে থাকলে মহাকাশের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। এভাবেই বিদায়ী ২০২২ সালে মহাকাশের পরিবেশের যত্ন দেখেছে বিশ্ববাসী।
আর্টেমিস-ওয়ান
আর্টেমিস-ওয়ান-এর মাধ্যমে আবার চাঁদে অভিযানের মিশন শুরু করেছে নাসা। দীর্ঘ ৭০ বছরের বেশি সময় পর পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহে আবার মানুষের পদচিহ্ন ফেলার লক্ষ্য রয়েছে এই মিশনের।
এর অংশ হিসেবে যাত্রীবিহীন চন্দ্রাভিযানে পাঠানো হয় ওরিয়ন ক্যাপসুল। ডিসেম্বরে ২৬ দিন চাঁদের কক্ষপথে পরিভ্রমণের পর পৃথিবীতে ফিরেছে নাসার এই মহাকাশযান।
নাসা এই মিশনকে শতভাগ সফল বলে ঘোষণা দেয়। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পর ফের চাঁদের বুকে পদচিহ্ন আঁকার লক্ষ্যে আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন মহাকাশবিজ্ঞানীরা।
১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছয়টি অ্যাপোলো মিশনে মোট ১২ জন নভোচারী পা রেখেছেন চাঁদের মাটিতে। কিন্তু এরপর চাঁদে আর মানুষের পা পড়েনি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যাত্রা করবে আর্টেমিস-টু মিশন। প্রথমটির মতো যাত্রীবিহীন এই দ্বিতীয় মিশনটিও সফল হলে, ২০২৫ সালে আবার চাঁদের বুকে পা রাখতে যাবে মানুষ।
মঙ্গল গ্রহ অভিযানকে বিদায়!
২০২২ সালে বন্ধ হয়ে যায় দুটি মঙ্গল গ্রহ অভিযান। যাত্রা শুরুর প্রায় এক দশক পর এ বছরের অক্টোবর মাসে সমাপ্তি ঘটে মঙ্গল গ্রহে ভারতের প্রথম অভিযানের। 'মার্স অরবিটার মিশন' বা সংক্ষেপে 'মম' (MOM)-এর সমাপ্তি ঘটে বিদায়ী বছরে।
ধারণা করা হয়, সোলার প্যানেলে চার্জ করতে যথেষ্ট পরিমাণ সূর্যের আলো না পাওয়ায় এই মঙ্গলযান বন্ধ হয়ে যায়।
এপ্রিলে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)-এর পরিচালিত এই মঙ্গলযানের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে প্রবেশের আট বছর পরে, অক্টোবর মাসে এসে এই অভিযান সমাপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়।
অন্যদিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরে বন্ধ হয়ে যায় আরেকটি মঙ্গলাভিযান। নাসার পরিচালিত ইনসাইট মঙ্গলাভিযানে অনেক বেশি ধূলাবালি জমায় এটি অকার্যকর হয়ে যায়।
সফল গ্রহ প্রতিরক্ষা পরীক্ষা
২০২১ সালে নাসা ডাবল অ্যাস্টেরয়েড রিডাইরেকশন টেস্ট বা ডার্ট মিশন শুরু করে। কোনো গ্রহাণু বা উল্কাপিণ্ড যদি পৃথিবীর দিকে আসতে থাকে তাহলে কীভাবে তাকে এড়ানো যায়, তার সমাধান খুঁজতে নাসা ডার্ট মিশন শুরু করে।
আমাদের মহাকাশে শত শত উল্কাপিণ্ড বেপরোয়া ছুটতে থাকে। এগুলো লাখ লাখ কিলোগ্রাম ওজনের বড় পাথরের টুকরো, যার গতি ঘণ্টায় কয়েক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। বিশালাকার এই পাথরের টুকরো পৃথিবীতে পড়লে বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমন বিপদ সম্পর্কে বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা মহাকাশ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০২২-এর সেপ্টেম্বরে ডার্ট মিশনকে সফল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উদ্দেশ্যমাফিক উল্কাপিণ্ডে আছড়ে পড়েছে এই আত্মঘাতী মহাকাশযান। এর দরুন আগামী ১০০ বছরের মধ্যে মানবসভ্যতার কোনো ভয়ংকর ক্ষতিসাধন হবে না বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
ছায়াপথের কেন্দ্রে কৃষ্ণগহ্ববর
মহাবিশ্বের এক অপার রহস্যের নাম কৃষ্ণগহ্বর। ব্ল্যাকহোল হলো এমন একটি জায়গা, যেখানে কোনোকিছু প্রবেশ করলে আর ফিরে আসে না। এর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এতই বেশি যে আলো পর্যন্ত সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।
দীর্ঘদিন ধরে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে আসছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। অবশেষে ২০২২ সালে এসে এই অনুসন্ধানে আরেকটি সাফল্য অর্জন করেছেন তারা।
২০২২ সালের মে মাসে, প্রথমবারের মতো ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত এক অতি বিশাল কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) ছবি তোলা হয়েছে। স্যাজিটারিয়াস এ* নাম দেওয়া বস্তুটির ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে ৪০ লাখ গুণ বেশি। কয়েকটি দেশের একাধিক ইন্সটিটিউটের পাঁচ বছরের কঠোর সাধনার ফল এটি।
আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে যে বিশাল কৃষ্ণগহ্বর আছে, তা নিয়ে জ্যোর্তিবিদদের এতদিনের ধারণা এই ছবির মধ্য দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব
চলতি বছর ইউক্রেনে হামলা করায় কতিপয় দেশ রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর প্রভাব পড়ে রাশিয়ার মহাকাশ কর্মকাণ্ডে। একাধিক মহাকাশ-সংক্রান্ত কাজ স্থগিত হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে অনেক সয়ুয অভিযান বন্ধ করা হয়। সয়ুজ রকেটের নকশা থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পতাকা তুলে নেয় রুশ মহাকাশ সংস্থা রোসকসমস।
ইউরোপ ও রাশিয়ার যৌথ মঙ্গলাভিযান দ্য রোসালিন্ড ফ্র্যাংক্লিন রোভার টু মার্স চলতি বছরের মার্চে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এটি স্থগিত করে দেওয়া হয়।
এছাড়াও স্থগিত করা হয় জার্মানি ও রাশিয়ার যৌথ মহাকাশ টেলিস্কোপ মিশন স্পেক্টার-আরজি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে আর রকেট ইঞ্জিন সরবরাহ করবে না বলে জানিয়ে দেয় পুতিন সরকার।
- সূত্র: দ্য প্রিন্ট