ক্রাইম লেখকেরা কেন নারী চরিত্রদেরই বেশি হত্যা করেন?
অক্টোবরের এক ভীতিকর দিন। আমার অনাগত সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ডাক্তার ওর ভূমিষ্ঠ হওয়ার যে সম্ভাব্য তারিখ দিয়েছিলেন তা ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ যে সময়ে আমার নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে থাকার কথা, সে সময় আমি পোস্ট-টার্ম গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে মৃত সন্তান জন্মের হার এবং সন্তানধারণকারী নারীদের মৃত্যুর হার নিয়ে গুগল করছিলাম। স্বভাবতই অনাগত সন্তানকে নিয়ে আমার মনের মধ্যে ভীষণ ভয় কাজ করছিল। তাই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে আমি ক্রাইম ফিকশনের আশ্রয় নিলাম।
অমীমাংসিত খুনের ঘটনা এবং খুনটা কে করেছে—এরকম গল্পের মধ্যে একের পর এক রহস্য জড়িয়ে থাকার ফলে এগুলো এতটা উত্তেজনাপূর্ণ হয় যে গল্পটির বুনট ভালো হলে সেটি যেকোনো মানুষের উদ্বেগ কমিয়ে আনতে পারে। আর আমি আজীবনই রহস্য ও রোমাঞ্চ ঘরানার উপন্যাসের একনিষ্ঠ পাঠক। তাই নিজের ভয় কাটাতে একটা সুন্দর গল্প পড়ার কথাই ভাবছিলাম, যেখানে কিছু চিরাচরিত উপাদান থাকবে—একটা লাশ, একজন দুঁদে গোয়েন্দা এবং সবশেষে সুনিপুণ এক সমাধান।
কিন্তু এবার আর ক্রাইম ফিকশন আমাকে সান্ত্বনা দিতে পারল না। বইটি আমার সমস্যাগুলো থেকে আমার মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার বদলে আরও বেশি করে সেগুলো মনে করিয়ে দিতে লাগল! এর কারণ, আমি যতগুলো রহস্য ও রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়েছি তার সবগুলোর মধ্যেই অন্তত একটি নারী চরিত্র ছিল যাকে হত্যা করা হয়েছে। ফলে ওইসব দুঁদে গোয়েন্দাদের জন্য—যাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ভিলেনকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে—আমার সহানুভূতি বোধ করত না; বরং বইয়ে যেসব দুর্ভাগা নারী ঘটনাচক্রে ভুক্তভোগী হয়েছেন, তাদের প্রতিই আমার সহানুভূতি কাজ করত এতদিন।
আমেরিকান ক্রাইম ফিকশনে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এই ঘরানারই জন্মের সময় থেকেই দেখানো হচ্ছে। শুরুটা হয়েছে মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো-র ১৮৪১ সালের গল্প 'দ্য মার্ডারস ইন দ্য রু মর্গ' থেকে, যাকে মনে করা হয় আমেরিকার প্রথম আধুনিক গোয়েন্দাগল্প। একজন মা ও মেয়ের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে রচিত এ গল্পে মাকে এতটাই বীভৎসভাবে খুন করা হয় যে তার মাথা শরীর থেকে আলাদা করে ফেলা হয়, আর মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করে চিমনির ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হয়।
এরপরে রেমন্ড চ্যান্ডলার ও ড্যাশিয়েল হ্যামেট থেকে শুরু করে জনাথন ল্যাটিমার, হিলারি ওয়া পর্যন্ত সব লেখকই তাদের গল্প এগিয়ে নেওয়ার জন্য নারীদের ওপর সহিংসতার হুমকি অথবা সরাসরি সহিংসতাকেই বেছে নিয়েছেন। অনেকের কাছেই একে ক্ষণিকের অবসর বিনোদন মনে হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে গল্পগুলো থেকে অতিমাত্রায় পৌরুষত্বের প্রকাশ ও প্রত্যক্ষ বর্ণবাদ কমে এলেও 'মৃত নারী'দের ওপর লেখকদের নির্ভরশীলতা কিন্তু খুব একটা কমেনি।
বর্তমান সময়ের অপরাধকাহিনির ক্ষেত্রে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়াই কঠিন যে ঠিক কতগুলো উপন্যাসে মৃত নারীদের কাহিনি উপজীব্য করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত এ ধরনের শত শত ক্রাইম থ্রিলার বই প্রকাশিত হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমাজনের শীর্ষ ৫০টি বেস্টসেলিং ক্রাইম উপন্যাসের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছি এই উপন্যাসগুলোতে নারী ও পুরুষ ভুক্তভোগীর অনুপাত ৩:১।
গল্প-উপন্যাসে নারী ও পুরুষ ভুক্তভোগীদের মধ্যে এই অসামঞ্জস্য হয়তো মেনে নেওয়া যেত, যদি বাস্তবে সত্যিই নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হতেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত প্রায় ৮০ শতাংশ হত্যাকাণ্ডের শিকার প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা। বেশিরভাগ সময় ঘরোয়া সহিংসতা এবং পরিবারে নির্যাতনের ফলে নারীদের মৃত্যু ঘটে; এ সমস্যাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে বিপরীতে দেখা যাবে পুরুষদের মৃত্যুর হার আরও বেড়ে গেছে।
তাহলে পুরো বিষয়টাই কি খানিকটা প্রহেলিকা নয়? রহস্য বা গোয়েন্দা উপন্যাসে সত্য উন্মোচন করাই যেখানে মূল লক্ষ্য—যেখানে লেখকেরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে দিন-সপ্তাহ বা বছরের পর বছর কাটানোর অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেন যাতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তথ্যও ছেঁকে বের করা যায়—সেই ঘরানার গল্প-উপন্যাসেই খুন করার জন্য 'ভুক্তভোগী' বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে লেখকেরা কেন প্রকৃত সত্য থেকে দূরে সরে যান?
এমনটা হতে পারে যে, লেখকরা একেবারেই নিরীহ কারণে গল্পে পুরুষদের চেয়ে নারীদের হত্যাকাণ্ড বেশি দেখান। যেমন, ব্যাপারটা হয়তো স্রেফ মৌলিক জীববিজ্ঞানের। অর্থাৎ পুরুষদের তুলনায় নারীদের পেশিশক্তি কম, তাই তাদেরকে শারীরিকভাবে আঘাত করা সহজ। এভাবে নারীদের মৃত্যুর ফলে সন্দেহভাজনদের তালিকা লম্বা হয়, এতে গল্পটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
আরেকটা কারণ হতে পারে, সহজাতভাবেই নারীদের সহানুভূতিসম্পন্ন ও কোমল স্বভাবের মনে করা হয়; অন্যদিকে পুরুষদের মৃত্যু নিয়ে আমরা কিছুটা উদাসীনই থাকে। এ কারণেই 'সিলেক্টিভ সার্ভিসে' রেজিস্ট্রেশনে বা সামরিক বাহিনীতে নারীদের যোগদানের বাধ্যবাধকতা রাখা হয় না, যদিও আধুনিক সমরকৌশলে নারীরা পুরুষদের সমকক্ষ।
ঔপন্যাসিক গিলি ম্যাকমিলান এবং রেনে ডেনফেল্ড তৃতীয় আরেকটি মতামত ব্যক্ত করেছেন। ম্যাকমিলান বলেন, 'আমি মনে করি, নারীরা যেসব [অপ্রীতিকর] পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বা হতে পারে বলা আশঙ্কা করে সেগুলোর বিরুদ্ধে তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে এবং বিষয়গুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করতে পারে উপন্যাসে (নারীদের বিরুদ্ধে) সুচিন্তিত সহিংসতার উপস্থাপন।'
অর্থাৎ নারীদের আঘাত করার মাধ্যমেই লেখকেরা তাদের কাহিনী পুনর্লিখন করছেন, নারীদের ক্ষমতা দিচ্ছেন তাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার চাইতে।
কিন্তু গল্পে নারীদের হত্যা-নির্যাতনের পেছনে লেখকের উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, এসব কাল্পনিক সহিংসতার চরম নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। নিয়মিত নিজেদের গল্পে নারীদের খুন দেখানোর মাধ্যমে নারী পাঠকদের মধ্যে এমন একটি অনুভূতি তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তাদের মনে হয় ভুক্তভোগীদের আসলে একজন পুরুষের সুরক্ষা দরকার। এছাড়া নারীদের যতটা ক্ষমতা আছে, তাদেরকে তার চেয়েও দুর্বল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
তারচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, গল্প-উপন্যাসে বারবার নারীদের ওপর সহিংসতা দেখানোর মাধ্যমে সেই দীর্ঘ ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে যে নারীরা শারীরিকভাবে দুর্বল, নারী মানেই তাকে পুরুষেরা কবজায় রাখার চেষ্টা করবে, তার ওপর জোরজবরদস্তি করার চেষ্টা করবে...এবং এর পাশাপাশি কেউ না কেউ ওই নারীর পোশাকে দোষ খুঁজবে।
আবার নারী হয়ে আপনি বাড়ির বাইরে কোথাও বাধাহীন উচ্ছ্বাসে পান করতে পারবেন না। আর যদি করেন এবং সেসময় যদি কোনো পুরুষ আপনাকে হেনস্তা করে, তাহলে প্রথমেই বলা হবে পান করার সময় আপনি কেন সংযত ছিলেন না।
আবার যুক্তরাষ্ট্রে একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ হয়ে রাতের বেলা আপনি একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন না এই ভয়ে, যদি সেই নারী পুলিশকে কল দিয়ে বসে যে আপনি তার জন্য 'হুমকিস্বরূপ'! কারণ তাকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়েছে নারী মানেই সে দুর্বল এবং কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের পক্ষে তার ক্ষতি করার সম্ভাবনা আরও বেশি।
আমরা এমন একটা পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে নারীদের 'আরও শালীন' পোশাক পরাতে, আরও সহনীয় আচরণ করতে এবং 'সুরক্ষা'র মুখোশে ঘৃণাকে ন্যায্যতা প্রদান করতে সহিংসতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এ প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখতে লেখকেরা নিজেরাই ভূমিকা রাখছেন নাকি সেটি ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন, তা একটি বড় প্রশ্ন।
লেখকদের এসব গল্প কীভাবে পাঠকদের আত্মসম্মানবোধকে এবং অন্যদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে, তা জানার প্রয়োজন আছে। লেখকেরা গল্পে এত এত নারীদের হত্যা করলে ঠিক কারা উপকৃত হয়, তা জানার প্রয়োজন আছে।
আমার কাছে তো এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। কিন্তু একটা কথা নিশ্চয়ই জানি যে, কল্পকাহিনিতে নারীদের শিরশ্ছেদের কথা, তাদের ওপর নির্যাতনের কথা, নারীদের ধর্ষণ ও খুনের কথা পড়লে আমি কোনোভাবেই নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করি না। বরং এটি আমার ভেতরের ভয়কে আরো জাগ্রত করে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে ভীতিকর বার্তা আমাদের দেওয়া হয়েছে, সেটাই আবার মনে পড়ে যায়—'নারী হিসেবে আমি কোথাও নিরাপদ নই। আমি যতই নারীসুলভ আচরণ করব—নারীর যৌন আবেদন প্রকাশ বা মায়ের ভূমিকা পালন করতে গেলেও—আমার জীবনের গুরুত্ব ততই কমতে থাকবে এবং আমার মৃত্যুর সম্ভাবনাও আরও বেড়ে যাবে।'
- সূত্র: ক্রাইমরিডস ডটকম থেকে ঈষৎ সংক্ষেপে অনূদিত