মারা গেলেন খুনি থেকে বেস্টসেলার ক্রাইম ফিকশন লেখক বনে যাওয়া অ্যান পেরি
কৈশোরে বন্ধুর মাকে খুন করতে সাহায্য করা ক্রাইম ফিকশন লেখক অ্যান পেরি মারা গেছেন। খবর বিবিসির।
হনোরাহ মেরি পার্কারকে নির্মমভাবে মারধর করে হত্যা করার অপরাধে ১৫ বছরে কারাগারে গিয়েছিলেন পেরি। ওই সময় তার বয়স ছিল ১৫ বছর।
মৃত্যুর সময় পেরির বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
এই লেখকের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পিটার জ্যাকসন ১৯৯৪ সালে বানিয়েছিলেন 'হেভেনলি ক্রিয়েচারস' নামের চলচ্চিত্রে। সেই সিনেমায় পেরির চরিত্রে অভিনয় করেছেন কেট উইন্সলেট।
'হেভেনলি ক্রিয়েচার'' ১৯৯৪ সালে অ্যাকাডেমি পুরস্কারের জন্যও মনোনয়ন পায়।
বন্ধুর মাকে পিটিয়ে হত্যা করার সময় পেরির নাম ছিল জুলিয়েট হাল্ম। পরে লেখালেখি শুরু করার সময় অ্যান পেরি নাম নেন তিনি।
১৯৫৪ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে বান্ধবী পলিন পার্কারের সঙ্গে মিলে পলিনের মাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন পেরি। পরে পুলিশ ওই বিস্তারিত পরিকল্পনা লেখা জার্নাল আবিষ্কার করে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুসারে, পেরির জন্ম ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে, লন্ডনের ব্ল্যাকহিথে। আট বছর বয়সে তাকে বাহামা পাঠানো হয়, এরপর নিউজিল্যান্ডে। শৈশবে পেরি প্রায়ই শারীরিক অসুস্থতায় ভুগতেন। ৬ বছর বয়সে তার যক্ষ্মা ধরা পড়ে। এরপর তাকে স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার আশায় এক দত্তক পরিবারের সঙ্গে বাহামায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১৩ বছর বয়সে পেরি তার পরিবারে ফিরে আসেন। এরপর তার বাবার চাকরির সুবাদে সপরিবারে নিউজিল্যান্ডে চলে যান। ক্রাইস্টচার্চ গার্লস হাই স্কুলে পলি পার্কার তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়।
কিন্তু কিছুদিন পরই পেরির বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। নিউজিল্যান্ড ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। কিন্তু পলিন ও পেরি বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারছিল না। তাই বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য তারা পরিকল্পনা করে, পলিনের মাকে হত্যা করবে।
পরিকল্পনা অনুসারে, ক্রাইস্টচার্চের ভিক্টোরিয়া পার্কে হনোরাহ পার্কারকে একটি ইট দিয়ে প্রায় বিশবার আঘাত করে পলিন ও পেরি। ওই আঘাতে তার মৃত্যু হয়।
ওই হত্যামামলা নিয়ে নিউজিল্যান্ডে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল। তদন্তে জানা যায়, দুই বান্ধবী এক কল্পনার রাজ্য বানিয়ে নিয়েছিল নিজেদের জন্য। তাদের স্বপ্ন ছিল, বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হবে। ওই সময় পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে দুজনের মধ্যে সমকামী প্রেম থাকার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। যদিও ২০০৬ সালে 'দ্য নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অ্যান পেরি বলেন, তাদের মধ্যে কোনো যৌন সম্পর্ক ছিল না, তারা দুজনেই তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে মোহগ্রস্ত ছিলেন।
বিচারে দুই তরুণীই দোষী সাব্যস্ত হয়। কিন্তু হত্যার সময় দুজনের বয়সই ১৮-র নিচে হওয়ায়—পলিনের ১৬ ও জুলিয়েটের ১৫—তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। কারাদণ্ড ভোগ করেই পার পেয়ে যায় দুজনে।
হত্যার সময় দুজনের বয়সই ১৮-র নিচে হওয়ায় তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। কারাদণ্ড ভোগ করেই পার পেয়ে যান দুজনে।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পেরি নিউজিল্যান্ড ছেড়ে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসেন।
ছোটবেলা থেকেই পেরির ইচ্ছা ছিল লেখক হবেন। তবে যুক্তরাজ্যে ফিরে প্রথম বিশ বছরের অধিকাংশ সময়ই অ-সৃজনশীল কাজ করেন। এ সময় তিনি সেলস পারসন থেকে শুরু করে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট, ইনস্যুরেন্স আন্ডাররাইটার হিসেবেও কাজ করেন।
পেরির প্রথম উপন্যাস 'দ্য ক্যাটার স্ট্রিট হ্যাংম্যান' প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। ১৮৮১ সালের প্রেক্ষাপটে রচিত এ বইয়ের প্রধান চরিত্র ভিক্টোরিয়ান লন্ডনের পুলিশ কর্মকর্তা উইলিয়াম পিট। তার স্ত্রী শার্লট এলিসন। উইলিয়াম ও শার্লট পিট সিরিজে ৩০টির বেশি বই আছে। এ সিরিজের সর্বশেষ বই 'মার্ডার অন দ্য সার্পেন্টাইন'। এ সিরিজ শেষ হওয়ার পর পেরি পিট দম্পতির ছেলে ড্যানিয়েল পিটকে নিয়ে লিখতে শুরু করেন। ওই সিরিজের শেষ বই 'দ্য ফোর্থ এনিমি' গত বছর প্রকাশিত হয়।
১৯৯০ সালে পেরি উইলিয়াম মঙ্ক নামের আরেক গোয়েন্দা চরিত্রকে নিয়ে সিরিজ লিখতে শুরু করেন। ওই সিরিজটিও বেশ পাঠকপ্রিয়তা পায়।
সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে তার বই ২৫ মিলিয়ন কপির বেশি বিক্রি হয়েছে।
পেরি কখনও বিয়ে করেননি। ২০০৯ সালে পেরিকে নিয়ে নির্মিত এক ডকুমেন্টারিতে তার বন্ধুরা বলেন, অতীত জীবন গোপন করা নিয়ে টানাপড়েনের কারণে তার সম্পর্ক টিকত না।
২০১২ সালে পেরির জীবনী লেখেন জোয়ান ড্রেটন—নাম 'দ্য সার্চ ফর অ্যান পেরি'। সেই বইটি বেস্টসেলার হয়।
পরবর্তীতে তিনি মরমন ধর্ম গ্রহণ করে স্কটল্যান্ডের পোর্টম্যাহোমাক গ্রামে স্থায়ী হন। তবে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির কাছাকাছি থাকার আশায় ২০১৭ সালে তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসের ওয়েস্ট হলিউডে চলে আসেন।
পেরির অতীত প্রকাশ্যে আসে ১৯৯৪ সালে সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর। তার অনেক আগেই অবশ্য তিনি লেখক হিসেবে সাফল্য অর্জন করেন।
নিজের খুনি পরিচয় প্রকাশ্যে আসার পর পেরি অবশ্য লজ্জায় অন্তরালে চলে যাননি। তিনি দাবি করেন, পলিনের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে যোগ না দিলে পলিন আত্মহত্যা করতে পারতেন বলে ভয় হচ্ছিল তার।
১৯৯৮ সালে 'দ্য টাইমস অভ লন্ডন' তাদের গত শতাব্দীর '১০০ মাস্টারস অভ ক্রাইম' তালিকায় আগাথা ক্রিস্টি, রেমন্ড শ্যান্ডলার, ড্যাশিয়েল হ্যামেট, আর্থার কোনান ডয়েলের মতো লেখকদের সঙ্গে অ্যান পেরির নামও অন্তর্ভুক্ত করে।