আলেকজান্ডারের বিশ্বব্যাপী নারীপ্রেম যেভাবে ফুটে উঠেছে পারস্যের সাহিত্যকর্মে
পারসিক কবিতা ও গদ্যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কিংবদন্তি গত এক সহস্রাব্দের বেশি সময়ে অনেক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গেছে। পারস্যবাসীর কাছে ইস্কান্দার বা সিকান্দার নামে পরিচিত আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়ের বিভিন্ন গল্পে পারসিক লেখকদের কল্পনার বিস্তর ছাপ দেখা যায়। আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয়ের এ যাত্রাপথে তিনি যেসব নারীর সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথাও উঠে এসেছে এসব সাহিত্যিক বিবরণে।
ফার্সিভাষার সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে ফেরদৌসীর শাহনামাতে আলেকজান্ডারের কথা প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রিক রোমান্সে আলেকজান্ডারের জীবনে যেসব নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়, শাহনামাতেও সেই প্রধান নারীচরিত্রগুলোরই উপস্থিতি রয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়তি কয়েকজন নারীর কথাও জানা যায় শাহনামাতে।
আন্দালুসিয়ার রানি কায়দাফা'র গল্পের সঙ্গে গ্রিক রোমান্সের মিরো'র রানি ক্যান্ডেসের গল্পের মিল রয়েছে। কায়দাফা প্রথমে ইস্কান্দারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে প্রত্যাখ্যান করেন। পরে নিজের পাঠানো দূত সেজে ইস্কান্দার খোদ কায়দাফার দরবারে উপস্থিত হন। কিন্তু ইস্কান্দারের চিত্রকর্ম আগেই দেখে থাকা কায়দাফা অনায়াসে তাকে চিনে ফেলেন।
শেষ পর্যন্ত কায়দাফা ইস্কান্দারের সঙ্গে সন্ধি করেন। এ বিবরণে কায়দাফাকে কোনো আমাজন নারী হিসেবে পরিচিত করানো হয়নি, তার নগরীতেও পুরুষ আর নারী উভয়েরই বসবাস ছিল।
আনুমানিক ১০১০ সালে শাহনামা শেষ করেছিলেন ফেরদৌসী। নিজামী ইস্কান্দারনামা লিখেছিলেন ১২০২ সালে। এপিক ও রোমাঞ্চের মিশ্রণ এ সাহিত্যকর্মের নুশাবা চরিত্রটি পুরুষ সংস্রববর্জিত একজন আমাজন নারীর।
ফেরদৌসীর শাহনামায় আমাজন নারীদের দেশের নাম ছিল হারুম। তার গ্রন্থে আমাজনদের কথা অল্পই উল্লেখ আছে। এই হারুমের নারীরাও ইস্কান্দারের আগমনের পরে তাকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে নিজামের লেখায় হারুমের সঙ্গে সম্পর্কিত বারদা অঞ্চলের কথা জানা যায়। এ বারদা ছিল পৃথিবীর বুকে মোটামুটি একটি স্বর্গের মতো।
বারদার নারীদের প্রফুল্ল জীবনযাপনের কথা ইস্কান্দারের কানে আসে। নগরের সন্নিকটে তাঁবু স্থাপন করেন তিনি। আর সেখানে তার জন্য নিয়মিত উপহার পাঠাতে শুরু করে নুশাবা।
এতে ইস্কান্দারের কৌতুহল আরও তীব্র হয়। এ নগর ও তার সংযমী নারীদের রহস্য জানতে তিনি উন্মুখ হয়ে পড়েন। নিজের পাঠানো দূত সেজে নুশাবার দরবারে প্রবেশ করেন ইস্কান্দার।
কিন্তু সম্রাট হওয়ার দরুন দূতের অভিনয় ভালো হয় না তার। নুশাবারও তাকে চিনতে ভ্রম হয় না; স্রেফ তার আচরণের কারণেই নয় — এর আগে তার শিল্পীরা তার জন্য ইস্কান্দারের একটি চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন বলেও।
ইস্কান্দার নিজেকে দূত দাবি করতেই থাকেন, সম্রাট হওয়ার কথা তিনি তীব্রভাবে অস্বীকার করেন। তখন নুশাবা ইস্কান্দারকে তার ছবি দেখিয়ে বলেন: 'তুমি যদি সিংহ হও, আমি তবে সিংহী। / লড়াইরত সিংহের আবার স্ত্রী-পুরুষ কী?'
এর মাধ্যমে নুশাবা ইস্কান্দারকে নিজের পদ ও ক্ষমতার বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেন। একইসঙ্গে ইস্কান্দার যেন তাকে স্রেফ একজন সুন্দরী নারী হিসেবে বিবেচনা না করেন, তা নিয়েও সতর্ক করে দেন।
নুশাবা এরপর ইস্কান্দারের সম্মানে এক ভোজের আয়োজন করেন। সেই ভোজে ইস্কান্দারের পাতে খাবারের বদলে মহার্ঘ সব মণিমুক্তা তুলে দেওয়া হয়।
এমন আচরণে হতবাক ইস্কান্দার এর কারণ জানতে চাইলে রানি নুশাবা হেসে তাকে জিজ্ঞেস করেন, যে জিনিসের পেছনে তিনি আজীবন ছুটছেন — তা কেন তিনি খেতে পারছেন না! এ কথা শুনে বড় ধরনের বোধোদয় হয় ইস্কান্দারের। তিনি নুশাবার প্রশংসা করেন, 'বিদুষী এ নারীর ওপর হাজার আশিস হোক / যিনি পুরুষতুল্য গুণে হলেন আমার প্রদর্শক।'
পরেরদিন নিজের জাঁকালো পারিষদবর্গ নিয়ে ইস্কান্দারের সঙ্গে দেখা করেন নুশাবা। সমস্ত দিন আর রাত তারা আনন্দোৎসবে মত্ত থাকেন। তবে এরকম উৎসবমুখরতার পরও নুশাবাকে বশীভূত করতে পারেন না ইস্কান্দার।
এ গল্পে আরও একবার নুশাবার দেখা পান পাঠক। রাসরা অপহরণ করে নুশাবাকে। ইস্কান্দার শপথ করেন, তাকে ছাড়িয়ে আনবেন। এ অভিযানের যাত্রাপথে তুর্কি উপজাতি কিপচাকদের সঙ্গে তার বাহিনীর সাক্ষাৎ হয়।
ইস্কান্দারের সেনাবাহিনী তখন ক্লান্ত যুদ্ধ করতে করতে, দীর্ঘদিন নারীসঙ্গ থেকেও বঞ্চিত তারা। কিপচাক নারীরা খোলামেলা পোশাক পরতেন। তবে তাদের সেই প্রকাশিত রূপ দেখেও ইস্কান্দারের সৈন্যরা তার ভয়ে বাড়াবাড়ি করেননি।
ইস্কান্দার উপজাতিটির প্রবীণদের কাছে তাদের নারীদের অপাবৃত উপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ করেন: 'নারী হয়ে অপরিচিতকে যে করে মুখ প্রদর্শন / নিজের গৌরব, স্বামীর মর্যাদার করে সে ভূলুণ্ঠন।'
তখন কিপচাক প্রবীণেরা জানান, এটাই তাদের রীতি এবং বলেন: 'অবগুণ্ঠনের আড়ালেতে লুকায় যে তার আঁখি / না দেখে সে সূর্য, না পায় দেখতে শশী।'
ইস্কান্দার তখন তার একজন বিজ্ঞ মন্ত্রণাদাতার সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং অবশেষে সুকৌশলে তারা কিপচাক নারীদের অবগুণ্ঠনাবৃত করতে সক্ষম হন।
এরপর ইস্কান্দার রাসদের বিরুদ্ধে বড়সড় একটি আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং শেষে নুশাবাকে মুক্ত করেন। নুশাবার রাজ্য উদ্ধার করে তার কাছে ফিরিয়ে দেন। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইস্কান্দার আবখাজের বাদশাহ দাভালির সঙ্গে নুশাবার বিয়ে দিয়ে দেন। এভাবে নুশাবা একজন আমাজন নারী থেকে বিবাহিত সম্ভ্রান্ত নারীতে রূপান্তরিত হন।
আমির খসরুর লেখা আইন-ই ইস্কান্দারি (১২৯৯) গ্রন্থে কানিফুকে প্রথমে দেখা যায় একজন পুরুষ যোদ্ধা হিসেবে। ইস্কান্দারের বাহিনীর বিরুদ্ধে চীনাদের হয়ে লড়াই করছিলেন তিনি।
এক পর্যায়ে ইস্কান্দার ও তার মধ্যে একক যুদ্ধ শুরু হয় এবং কানিফু ধরা পড়েন। ইস্কান্দার দেখেন, কানিফু আদতে একজন সুন্দরী নারী।
এ কানিফু কোনো আমাজন নারী তো ছিলেনই না, বরং তার ও ইস্কান্দারের মধ্যে প্রণয়লীলার সম্পর্ক ছিল। চীন থেকে ফেরত আসার সময় লুণ্ঠিত দ্রব্যের অংশ হিসেবে কানিফুকে সঙ্গে নিয়ে আসেন ইস্কান্দার।
তারসুসি'র ১২ শতকের গদ্যাকারে লিখিত মহাকাব্য দারাবনামায় ইস্কান্দারের বেশকিছু কর্মকাণ্ডের আখ্যান রয়েছে। সেখানে তার সঙ্গে বুরানদুখতের (রওশনাক) সম্পর্কের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়।
ইস্কান্দারনামা শীর্ষক আরেকটি সাহিত্যকর্মে জনৈক বেনামি লেখকের বর্ণনায় ইস্কান্দারের বৃদ্ধ চাচী ও অন্যান্য নারীরা তাকে সিংহাসনচ্যুত বা খুন করার চেষ্টার কথা জানা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এদের বেশিরভাগ মারা পড়েন অথবা সম্রাটকে বিয়ে করতে বাধ্য হন।
ইস্কান্দার কাশ্মীরে জনৈক বিধর্মী রাজার কন্যাকে বিয়ে করেন। এরপর সেখান থেকে সিলন, মক্কা, ইয়েমেন, মিশর, আন্দালুসিয়া, ও চীন ভ্রমণ করেন। ইস্কান্দারনামায় তাকে একজন পবিত্র যোদ্ধা হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। এ গ্রন্থে ভালোবাসার সঙ্গে ধর্মপরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে।
এর পরের গদ্যগ্রন্থটি নবম শতকের কিন্তু ধারণা করা হয় এর উৎপত্তি ঘটেছিল সাফাভিদের আমলে। ইস্কান্দারনামা-ই হাফত-জিলদি শীর্ষক সপ্তকাণ্ড এ গ্রন্থটির লেখক হিসেবে মানুচির খান হাকিমের নাম পাওয়া যায়।
এ গ্রন্থটির বর্ণনা ও ভূগোল অনেক বেশি কল্পনাপ্রসূত। এতে যেমন পারসিক ও ইসলামিক চরিত্র রয়েছে, তেমনি আছে দৈত্যদানব ও পরীর কথা।
গ্রন্থটির বর্ণনা অনুসারে, ইস্কান্দার ও তার সঙ্গীরা যেখানেই গেছেন, সেখানেই তারা সুন্দরী নারীদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। তাদের সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরই শত্রুর হাতে বন্দী হতেন ইস্কান্দার।
সূত্র: স্ক্রল ডটইন থেকে সংক্ষেপে অনূদিত