পেঁয়াজ-রসুনের যুগে বিধবাদের রান্নাঘর থেকে আসা সুস্বাদু নিরামিষ খাবার!
'খিড়কির দরজা খুলে নিজে বাড়ির পেছনের বাগান থেকে নিয়ে এলো সবে কচি পাতা আসা কুমড়ো শাক, গাছের পাকা লঙ্কা। শাশুড়ির আমলের পুরনো ভারী শিলটা পাতলো অনেক দিন পরে। যত্ন করে ধুয়ে সেই কবেকার প্রাচীন হিম শীতল পাথরটার ওপর রাখলো সর্ষে দানা। শিল আর নোড়ার আদিম ঘর্ষণে খুলনা থেকে পাঠানো মায়ের শেষ সর্ষেটুকু বেটে ফেললো ইন্দুবালা অল্পক্ষণের মধ্যেই। লোহার কড়াইতে জল মরতে থাকা সবুজ ঘন কুমড়োশাকের ওপর আঁজলা করে ছড়িয়ে দিল সর্ষের মন্ড। কয়লার আঁচে টগবগ আওয়াজে ফুটতে থাকলো কচি শাকগুলো। তার নরম পাতাগুলো', কল্লোল লাহিড়ীর উপন্যাস 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল' এর এই লাইনগুলো পড়তে পড়তেই কচি কুমড়োশাকের সুবাস নাকে ভেসে আসছে, তাই না? কোনোরকম পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া গুটিকয়েক মশলা দিয়ে তৈরি এই খাবার যে কারো মন কাড়তে বাধ্য। শুধু কি কুমড়ো শাক! আজও বাংলার হেঁশেলে হাতছানি দেয় লাবড়া, কলার মোচা, পটলের দোলমা, কাঁচকলার কোফতা কিংবা ফুলকপির ডালনার মতো খাবার।
খাবারের সাথে বাঙালির পরিচয় আজ নতুন নয়; বরং সে বহু শতাব্দী আগের। পছন্দের খাবারের তালিকায় ভাত থাকায় 'ভেতো বাঙালি' পরিচয়ও তাই বাঙালির কোনোদিন ঘুচবার নয়। এ প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তার 'বাঙালির ইতিহাস' গ্রন্থে প্রাচীন বাঙালির খাদ্যাভ্যাস প্রসঙ্গে লিখেছেন যে ধান যেহেতু এদেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, কাজেই সে দেশের প্রধান খাদ্য যে ভাত হবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
তাই আজও ভাতের সাথে নানারকম সবজি খাওয়ার চল রসনাঘরে রয়েছে। তার উপর একঘেয়ে পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া নানান নিরামিষ খাবার তো আদ্যিকাল থেকে রন্ধনশালায় শোভা পাচ্ছেই। এসকল নিরামিষ খাবার একদিকে যেমন নতুন স্বাদের উন্মেষ ঘটায়, আবার দু'দিন পর পর বাজারে পেঁয়াজ-রসুনের দাম বাড়া নিয়ে যে আগুন সৃষ্টি হয় তা থেকেও সাময়িক স্বস্তি দেয়।
আহারে বাহারে নিরামিষ!
নিরামিষ খাবারের নাম শুনলেই অনেকে নাক সিটকান। অনেকে তো এককথায় 'ঘাস লতা পাতা' বলে বসেন। অথচ অল্প মশলায় এসব খাবারের স্বাদ যে অনেক দামী খাবারকেও হারিয়ে দিতে পারে তা অনেকের কাছেই অজানা।
ধরা হয়, হিন্দু বিধবাদের হাত ধরেই এ বঙ্গে নিরামিষ প্রীতি তুঙ্গে উঠেছে। অবশ্য এর প্রমাণ আমরা বঙ্গীয় সাহিত্যেও পাই। সৈয়দ মুজতবা আলী 'শ্রেষ্ঠ রম্যরচনা' বইয়ের আহারাদি অধ্যায়ে বলেছেন, 'আপনার মনে আঁকুবাঁকু প্রশ্ন, রান্না-জগতে বাঙালির অবদান কী? আছে আছে। মাছ, ছানা এবং বাঙালী বিধবার নিরামিষ রান্না।'
আবার, ষোড়শ শতকে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা 'চণ্ডীমঙ্গল' এ উঠে আসে শিব-পার্বতীর সাংসারিক জীবনের আলাপ এবং আহারে নিরামিষ খাবার ব্যবহারের কথা। 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যের দেবখণ্ড অংশে বলা হয়েছে-
আজি গণেশের মাতা রান্ধ মোর মত।
নিমে সিমে বেগুনে রান্ধিয়া দিবে তিত।
সুকুতা শীতের কালে বড়ই মধুর।
কুমুড়া বার্তুকা দিয়া রান্ধিবে প্রচুর।
অর্থাৎ, গনেশ জননী দেবী পার্বতীর কাছে শিব নিম, শিম, কুমড়া ও বেগুন সমেত সুকুতা অর্থাৎ শুক্তো খেতে চেয়েছেন। শুক্তো হলো এক ধরণের তেতো খাবার যা খাবারের শুরুতে মুখশুদ্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাঙালি বিধবার হেঁশেলেও শুক্তোর জয়জয়কার কোনো অংশে কম নয়। যদিও খাবারের শুরুতে শুক্তোর মতো তেতো খাওয়ার বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি রয়েছে। রেওয়াজটি অতি প্রাচীন হলেও খাবারের শুরুতে তেতো খেলে খাবার দ্রুত হজম হয়। ফলে শরীর থাকে নিরোগ।
দেশভাগের পর এপার বাংলা ও ওপার বাংলার খাবারের ধরনে কিছু পরিবর্তন এসেছে। ওপার বাংলায় শুক্তো খাওয়ার ব্যাপক চল থাকলেও এপারে তা অনেকাংশেই কম। বরং শুক্তোর পরিবর্তে এপার বাংলায় করলা বা নিম-বেগুনের মতো খাবারকে তেতো হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে শুধু শুক্তোই নয়- পোস্ত, ধোকার ডালনারও আবেদন এপার বাংলায় কম।
খাবারের তালিকায় প্রথম পাতে শুক্তোর কথা অন্যান্য গ্রন্থেও পাওয়া যায়। কবি বিজয়গুপ্ত 'পদ্মপুরাণ' এ বেহুলার বিয়ের ভোজ হিসেবে অন্যান্য খাবারের সাথে শুক্তোর কথাও উল্লেখ করেছেন।
রান্নার আলাপ করতে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির রান্নার কথা উল্লেখ না করা অন্যায়সম। ঠাকুরবাড়ি মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি। যেমন আমিষ তেমন নিরামিষ- দু'ধরণের রান্নাতেই ঠাকুর বাড়ির মেয়ে-বউদের জুড়ি মেলা ভার। ঠাকুরবাড়ির ঘরোয়া রান্নাকে জনসমক্ষে ছড়িয়ে দেয়ার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর। তার 'আমিষ ও নিরামিষ রান্না'র বই থেকে জানা যায় নিরামিষ রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার না করে কীভাবে পেঁয়াজের স্বাদ আনা যায় সে সম্পর্কে। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর টোটকা অনুসারে আদার রসে হিং ভিজিয়ে রাখলে এবং সেটি রান্নায় ব্যবহার করলে নিরামিষ খাবারেও পেঁয়াজের গন্ধ আসে। কচুর বাহারি পদ রান্নায় মৃণালিনী দেবীও তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবদারে মৃণালিনী দেবী দিব্যি রেঁধেছিলেন কচুর জিলিপি।
বিধবাদের হাত ধরে আসা নিরামিষ খাবার!
'ভোজনশিল্পী বাঙালি' গ্রন্থে বুদ্ধদেব বসু নিরামিষ রন্ধনশৈলীর ভীষণ সুনাম করেছেন। তার মতে, বাঙালি নিরামিষ রান্নার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বাঙালি হিন্দু বিধবার অশেষ কল্পনাশক্তি ও নৈপুণ্যতা। বুদ্ধদেব বসু তাদের এই নিরামিষ রান্নার গুণকে বৈধব্যপ্রথার 'উপজাতক' বলেছেন। তিনি লিখেছেন, 'শুনতে অদ্ভুত কিন্তু কথাটা সত্য যে, এই উপবাসকারিণী একাহারিণী ভগিনীদের হাতেই বাঙালি রান্না পেয়েছে তার সুক্ষ্মতম, সুকুমারতম বাঞ্ছনা – যদিও ভক্ষ্য বিষয়ে শত শাসনে তারা আবদ্ধ, অথবা হয়তো সেইজন্যেই।'
আঠারো ও উনিশ শতকের দিকে এ বঙ্গে বিধবাদের আমিষ খাবারের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো। পাশাপাশি তাদেরকে নানা রকম রীতিনীতি মানতে বাধ্য করা হয়েছিলো। কঠোর উপবাস থেকে শুরু করে স্বল্পাহারে বেঁচে থাকা- সবই তাদের উপর এক ধরণের অত্যাচারেরই শামিল ছিল।
খাবারদাবারের উপর সেসময় এসেছিলো সবচেয়ে বড় বারণ। বিধবা হওয়ার পর আমিষ খাবার খাওয়া তাদের জন্য মহাপাপের সমান ছিল। মাছ, মাংস, ডিমের স্থান তাদের আহারের তালিকায় থাকতো না। এসব খাবারে উচ্চ প্রোটিন থাকায় মনে করা হতো যে এগুলো খেলে কামোত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে। এমনকি সমাজের নিষ্ঠুর প্ররোচনায় মসুর ডালের মতো নিরীহ শস্যও ঠাঁই পেয়েছিলো আমিষ অঙ্গনে- নিষিদ্ধ হয়েছিলো মসুর ডালের মতো পুষ্টিকর ডাল খাওয়া।
এছাড়া পেঁয়াজ, রসুনও তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিলো। সে সময়কার বিশ্বাস ছিল- পেঁয়াজ, রসুন খেলে বিধবা নারীরা নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। অর্থাৎ প্রোটিনযুক্ত পুষ্টিকর খাবার থেকে বিধবাদের দূরে রাখা সেসময় অবশ্যম্ভাবী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই নিষেধাজ্ঞাই বঙ্গীয় সমাজে শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়। হাতের কাছে যা কিছু থাকতো, তা দিয়েই বিধবারা তৈরি করে নিতেন সুস্বাদু সব খাবার। নানাবিধ শাকসবজি তো রাঁধতেনই- ছাড় পেতো না তরকারির খোসাও। বিভিন্ন সবজি, সবজির বীজ, শাকপাতা, ডাঁটা দিয়ে তৈরি জিভে জল আনা সব খাবার স্বাদের দুনিয়ায় এক নতুন দিক উন্মোচন করে। বিধবাদের রান্নাঘর থেকেই কল্পনাতীত সব খাবার যেমন- খোসা চচ্চরি, ডাঁটা চচ্চরি, কুমড়ো ফুল বা শাপলা ফুলের বড়া সহ অন্যান্য খাবারের স্থান হয় এই বঙ্গে।
বিধবাদের এই অভিনবত্ব, রান্নার দুনিয়ায় যোগ করে নতুন মাত্রা। সীমিত উপাদান দিয়ে তৈরি করা এসব খাবার স্বাদে যেমন অতুলনীয় ছিলো, তেমনি গন্ধেও ছিলো সেরার সেরা।
এই যেমন ধরা যাক- খোসা চচ্চড়ির কথা। বিভিন্ন তরকারির খোসা আমরা সাধারণত ফেলে দেই। কিন্তু এই খোসাতেই আছে চমৎকার সব পুষ্টিগুণ। লাউয়ের খোসার কথাই ধরুন না, প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক আছে লাউয়ের খোসায়। একইভাবে আলুর খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, পটাশিয়াম ও আয়রন। তৎকালীন বিধবাদের পক্ষে নিশ্চয়ই খোসার পুষ্টিগুণের কথা জানা সম্ভব ছিল না। তারা সমাজের বেড়াজালে থেকে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য উদ্ভব করেছিলেন এ ধরণের খাবার। সরিষার তেলে আলু কিংবা লাউয়ের খোসার সহযোগে কালো সরিষা, মরিচ, হলুদ, লবণ দিয়ে তারা প্রস্তুত করতেন খোসা চচ্চড়ি।
সুস্বাদু যত নিরামিষ খাবার!
যুগের বদল এলেও নিরামিষ খাবারের প্রতি মানুষের আসক্তি এতটুকুও কমেনি। এখনো অনেকের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় নিরামিষ খাবার শোভা পায়। বাহারি স্বাদের নিরামিষ খাবারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে খাবারটি বাঙালির পাতে পড়ে সেটি হলো লাবড়া। এই লাবড়া পদটি এসেছে পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু সমাজ থেকে। সেখানকার অত্যন্ত জনপ্রিয় নিরামিষ ব্যঞ্জনের মধ্যে একটি হচ্ছে লাবড়া।
আলু, মূলা, শিম, বেগুন, ফুলকপি প্রভৃতি সবজির সহযোগে তৈরি হয় লাবড়া। সুস্বাদু এই পদটি রান্নার জন্য প্রথমে গোটা গোটা করে কাটা সবজি গরম জলে কিছুটা ভাপিয়ে নিতে হবে। এরপর কড়াইতে তেল গরম করে তাতে আদা বাটা, ধনে গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, মরিচের গুঁড়ো, কাঁচামরিচ ও লবণ দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে। কষতে কষতে তেল ছেড়ে এলে পূর্বের ভাপিয়ে রাখা সবজিগুলো দিয়ে মাঝারি আঁচে কষিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে। সবজিগুলো সিদ্ধ হয়ে গেলে আবার কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে ঢেকে রাখতে হবে।
এবার অন্য একটি পাত্রে ঘি গরম করে তাতে পাঁচফোড়ন দিয়ে নাড়তে হবে। ভাজা ভাজা হয়ে এলে কড়াইয়ের পূর্বের সবজির সাথে মশলা ভালো করে মাখিয়ে নিয়ে আরো কিছুক্ষণ নাড়তে হবে। মশলা ভালো করে মিশে এলে নামিয়ে গরম ভাত কিংবা খিচুড়ির সাথে পরিবেশন করা যেতে পারে জিভে জল আনা এই পদ।
বিধবাদের রান্নাঘর থেকে আসা আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হলো কলার মোচা। কলার মোচা মূলত কলার ফুল। কলার কাঁদির শেষ ভাগে থাকা, না ফোঁটা ফুলের কুঁড়িই হলো কলার মোচা। প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন কী নেই কলার মোচায়! রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া দূর করতেও মোচা দারুণ কার্যকরী।
কলার মোচার ঘণ্ট প্রস্তুতের জন্য মোচার কোয়াকে ভালোভাবে ধুয়ে কষ বের করে কুচি কুচি করে কেটে নিতে হবে। এরপর সামান্য হলুদ দিয়ে গরম পানিতে ভাপিয়ে নিতে হবে। হালকা ভাপিয়ে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে এক পাশে রেখে দিয়ে যেতে হবে আলু ও নারকেলের কাছে। মোচায় আলু ও নারকেল ব্যবহার করতে চাইলে চুলায় হালকা আঁচে আলু ও নারকেলের কুঁচি ভেজে রাখতে হবে। এরপর কড়াইতে তেল গরম করে তাতে জিরা, শুকনা মরিচ ও তেজপাতার ফোড়ন দিতে হবে। এরপর আদা বাটা, হলুদ গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, জিরা গুঁড়ো, মরিচ গুঁড়ো দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিয়ে ভাপানো মোচা দিয়ে দিতে হবে। একটু কষিয়ে তাতে পরিমাণমত লবণ-মরিচ দিয়ে আগের ভেজে রাখা আলু ও নারকেল কুচি দিতে হবে। সবশেষে গরম মশলা দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে।
নিরামিষ খাবারের নাম নেয়া শুরু করলে এর তালিকা শেষ হওয়ার নয়। নানান রকমের শাকসবজি আমাদের দেশে সহজলভ্য হওয়ায় শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় চাইলেই নিরামিষ খাবার দিয়ে রান্নাঘর আমোদিত করে রাখা যায়। এসব খাবার যেমন শরীরের পক্ষে ভালো, তেমনি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে পকেটেও দেবে খানিক আরাম।