ছিপ-বড়শি-মাছের নেশায় তারা সবাই একত্রে, বাংলাদেশের শৌখিন মৎস্য শিকারিরা
"সুন্দর একটা সকাল শুরু হয়েছে। আমি সহ আরো কিছু একনিষ্ঠ মৎস্য শিকারি প্রয়োজনীয় ছিপ, হুইল ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি নিয়ে আমাদের আবাসিক এলাকার লেকের পাড়ে উপস্থিত হয়েছি। মাছ ধরবো। মাছ ধরা আমার কাছে একটা উত্তম স্পোর্টস। এটা যথেষ্ট এক্সাইটিং। অতএব এর পিছে কিছু সময় ব্যয় করা যায়।
"আমাদের লেকটা মোটামুটি বড় ও গভীর। কিছু পুরাতন ও বড় মাছ আছে। বড় একটা মাছ যদি বড়শীতে কোনভাবে বাঁধাতে পারি তাহলে ওটার সাথে দারুণ একটা প্রতিযোগিতা হবে। মাছটা একদিকে টানতে থাকবে আর আমিও অন্য দিকে টানব। এ টানাটানি শেষে মাছটাকে যদি কুলে ভিড়িয়ে নেটবন্দি করতে পারি তাহলে আমি জয়ী হলাম। জয় লাভের দুর্নিবার এ নেশাতেই বারে বারে লেক পাড়ে ছুটে যাওয়া।
"...একজন শিকারি কিছুদিন আগে একটা বুদ্ধিমান চিতলকে পাকড়াও করেছিল। তবে চিতলটা পানি থেকে উঠার আগে শিকারীকে এমন একটা শিক্ষা দিয়ে দিল যা ওই শিকারী কোনদিন ভুলবে না।
"ওইদিন ওই শিকারি বাড়ি থেকে কিছু জীবিত তেলাপোকা একটা বয়ামে ভরে নিয়ে এসেছিলেন (নিবেদিত প্রাণ শিকারি বটে!)। জ্যান্ত তেলাপোকা নাকি চিতল মাছের খুব প্রিয় খাবার! ...তেলাপোকাগুলোকে জ্যান্ত অবস্থাতেই বড়শীতে গেঁথে পানিতে ফেলছিলেন। তার ধৈর্য্য ও সহনশীলতার তারিফ করি। তিনি সকাল হতে নিরলসভাবে এ প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলেন এবং ঠিক ঠিকই শেষ দুপুরের দিকে সফলকাম হলেন। বিরাট একটা চিতল মাছ তার বড়শীতে লেগে গেল। অনেক্ষণ টানাটানির পর মাছটাকে তিনি লেকের কিনারায় আনতে সক্ষম হলেন।
"মাছটাকে পানি থেকে উঠানোর জন্য সহায়তাকারী ব্যক্তি হাতে ধরা লম্বা হ্যান্ডেলের নেটের মধ্যে কোনভাবেই চিতলটাকে নিতে পারছিলেন না। এতে শিকারির ধৈর্যচ্যুতি ঘটে ও এক পর্যায়ে নিজেই এক হাতে ছিপ অন্য হাতে নেট নিয়ে মাছ উঠাতে গিয়ে অভাবনীয় কান্ড করে ফেললেন। সবকিছু সহ তিনি হুপ্পুস করে পানিতেই পড়ে গেলেন।
"লেকের কিনারেই পানির গভীরতা প্রায় ১০ ফুট। যাহোক, ভদ্রলোক সাঁতার জানতেন, কোন দুর্ঘটনা ঘটলো না। পাশের লোকজন তাকে পানি থেকে টেনে তুললো। কপাল ভাল, মাছটা তখনো বড়শিতে লেগে আছে, ছুটে যেতে পারেনি। তেলাপোকাটা হয়তো মাছটার প্রিয় খাবারই ছিল। উত্তমরুপে খাওয়ায় বড়শিটা তার মুখে বেকায়দায় বেঁধে গিয়েছে, ছুটতে পারেনি! ওটার ওজন ছিল ৭ কেজি।..."
'বাংলাদেশের শৌখিন মৎস্য শিকারী' ফেসবুক গ্রুপে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন প্রবীণ মৎস্য শিকারি বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো: জাকির হাসান (অব:)। ছিপ-বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যাদের শখ, সারাদিন তাদের আড্ডা চলে এই গ্রুপে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশের শৌখিন মৎস্য শিকারি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা এখন ৮৮ হাজারের উপর।
মাছ শিকারের অম্ল-মধুর স্মৃতিচারণ ছাড়াও গ্রুপে পাওয়া যায় এই শখের কাজটার যাবতীয় সব তথ্য। মাছ ধরা নিয়ে যেকোনো জিজ্ঞাসার উত্তর থাকে গ্রুপের অভিজ্ঞ মাছ শিকারিদের কাছে।
শিকারের আনন্দ ভাগাভাগির উদ্দেশ্যে
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান সুমনের মাছ শিকারের শখটা শুরু হয়েছিল হঠাৎ করেই। আগ্রাবাদে তার দোকানের এক ক্রেতা নিমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বড়শি দিয়ে মাছ শিকারে। প্রথমদিন যে বড়শিটা ফেলেছিলেন তিনি, সেটাতেই প্রায় সাড়ে ছয় কেজির এক মৃগেল আটকালো। শুভারম্ভেই এই ফল পেয়ে নতুন উদ্দীপনা খুঁজে পেয়েছিলেন সুমন। এরপর থেকে শৌখিন মাছ শিকারিদের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেন নিজ উদ্যমেই। তাদের কাছ থেকে মাছ ধরার খুঁটিনাটি শিখে নিয়ে প্রায়ই চট্টগ্রামের নানান প্রান্তে যেতেন শিকারের জন্য।
তার মতে, মাছ বড়শিতে দেওয়া টোপ নেওয়ার পর সুতায় টান পরে রিলের যে শব্দ হতে থাকে- সে শব্দটাই মাছ শিকারিদের কাছে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। এরপর কৌশলে মাছকে দুর্বল করে পাড়ে টেনে এনে জালে ঢুকানোই শিকারীর বড় প্রাপ্তি।
এই প্রাপ্তিকে সমমনা মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতেই ২০১৮ সালের জুন মাসে ফেসবুকে খুলেছিলেন বাংলাদেশের শৌখিন মৎস্য শিকারি গ্রুপ। আব্দুর রহমান সুমনের ভাষ্যে, "সাধারণভাবে ফেসবুকে মাছ শিকার নিয়ে উচ্ছ্বাস, আনন্দ প্রকাশ করলে সবাই এর মর্ম বুঝতো না। অনেকেই পছন্দও করে না এসব। তাই প্রকৃতপক্ষে যারা মাছ শিকারে আনন্দ পায়, মাছ ধরা যাদের শখ তেমন মানুষের সাথে মুহূর্তগুলো ভাগ করে নিতেই গ্রুপটা খুলেছিলাম। ততদিনে মাছ শিকার সংক্রান্ত অনেক ইউটিউব চ্যানেলও ছিল জনপ্রিয়। কিন্তু সেগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল অর্থ উপার্জন। ব্যবসায়িক লাভের চিন্তার বাইরে শৌখিন মাছ শিকারিদের মিলনমেলা হিসেবেই একটা প্ল্যাটফর্ম করতে চেয়েছিলাম আমি।"
ব্যস্ত জীবনে শিকারিদের সজীবতা এনে দেয় বড়শি ফেলে মাছ ধরার সময়টুকু। খোলা হাওয়ার আমেজ, জলাশয়ের পাশে পাখির কিচিরমিচির, আর নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় থাকে বাড়তি পাওনা হিসেবে। সুমন বলেন, "আপনার অফিসের চিন্তা, বাচ্চার স্কুলের চিন্তা, বাজারের চিন্তা, রান্না করার চিন্তাসহ দৈনন্দিন সব চিন্তা দূরে থাকে এই মাছ ধরার সময়টাতে। তখন সবার একটাই চিন্তা, নিজের বড়শিতে একটা মনমতো মাছ ধরা পড়লো কি না। মাছ শিকারের নেশায় আর্থিকভাবে লুজার হলেও শারিরীকভাবে অনেক উপকৃত হওয়া যায়। সবচেয়ে বড় উপকারটা হলো সারাদিন মাছ ধরার পর রাতের ভালো ঘুম!"
মাছ ধরায় যাবতীয় সহায়তা
গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুর রহমান সুমন জানান ছিপ-বড়শি দিয়ে মাছ ধরার নেশা আছে এমন যে কেউ যুক্ত হতে পারেন বাংলাদেশের শৌখিন মৎস্য শিকারি গ্রুপে। বহুবছর ধরে মাছ শিকারে অভিজ্ঞ ব্যক্তি থেকে শুরু করে নতুন করে মাছ ধরার আগ্রহ জন্মাচ্ছে এমন সব ধরনের সদস্যই আছেন এখানে। তবে ৩৫ থেকে ৭০ বছর বয়সী মানুষেরাই শখ হিসেবে মাছ ধরার নেশায় নিয়মিত হন বেশি। কারণ এই শখে আর্থিক-শারীরিক দুই ধরনের সক্ষমতাই জরুরী। মাছ ধরার সরঞ্জাম যেমন ব্যয়বহুল তেমনি মাছ ধরার প্রক্রিয়ায় শারীরিক শ্রমের ব্যয়ও কম নয়।
গ্রুপে অভিজ্ঞ ও প্রবীণ শিকারি হিসেবে সদস্যদের সবার পরিচিত মুখ মিরপুরের বাসিন্দা কাজী জহির। গ্রুপের অন্যতম একজন এডমিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। শৈশব থেকেই তার মাছ ধরার শখ। ফেসবুকে মাছ শিকারিদের এই গ্রুপের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন শুরুর দিকেই। গ্রুপের সদস্যরা যেকোনো প্রয়োজনে অভিজ্ঞ উপদেশের জন্য তার শরণাপন্ন হন নিয়মিতই। এমনকি কখনো কখনো রাত ১২টার দিকেও মাছ শিকার বিষয়ক উপদেশের জন্য জহিরের মোবাইল ফোনে রিং বেজে ওঠে বলে জানান তিনি।
গ্রুপের আরেক অভিজ্ঞ শিকারী ও এডমিন ডা. আশরাফুল আলম। এক ঈদের ছুটিতে ঢাকার ধানমন্ডি লেকে শিকারিদের মাছ ধরতে দেখে প্রথম উৎসাহী হয়েছিলেন তিনি। এরপর মাছ ধরার সরঞ্জাম কিনে পুরোদস্তর শিকারি হয়ে ওঠেন নিজেই। মাছ শিকারের নতুন নতুন কৌশল, মাছের খাবার, শিকারের উপযুক্ত জায়গা ইত্যাদি নানান সহযোগিতা পাওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রুপে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি।
আশরাফুল বলেন, "অনেকে হয়তো সামনাসামনি আপনাকে কোনো একটা তথ্য দিতে চাইবে না, কিন্তু গ্রুপে সবার উৎসাহ পেতে সেই তথ্যটা নিজ থেকেই শেয়ার করে দেয়। তাছাড়া দেশের নানান প্রান্তের মানুষের কাছ থেকে প্রতিনিয়তই এখানে নতুন নতুন তথ্য জানা যায়।"
দেশ-বিদেশের নানা স্থানে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো: জাকির হাসানের। সেসব রঙিন দিনের স্মৃতি ভাগ করে নিতেই গ্রুপে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। বেশিরভাগ সময় স্মৃতিচারণমূলক লেখাই গ্রুপে পোস্ট করেন। ঢাকার বড়শির দোকানের খোঁজ, পূর্ণিমা-অমাবস্যায় নদীতে মাছের অবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয়ের খুঁটিনাটি জানতে গ্রুপের উপর নির্ভর করেন জাকির হোসেন। ঢাকায় তার মাছ ধরার প্রিয় জায়গা মিরপুর ডিওএইচএস-এর লেক।
বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙালিরাও তাদের মাছ ধরার অভিজ্ঞতা জানান শৌখিন মৎস্য শিকারি গ্রুপে। ডা. আশরাফুল আলম বলেন, "গ্রুপের পোস্ট দেখে প্রতিনিয়তই অনেক নতুন নতুন মানুষ মাছ শিকারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। প্রায়ই তারা গ্রুপে পোস্ট করেন কীভাবে মাছ ধরা শুরু করা যায়, কোথায় পাওয়া যাবে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ।"
মাছ শিকারের খুঁটিনাটি
ছিপ-বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে একজন শৌখিন শিকারিকে কী কী বিষয় মাথায় রাখতে হয় জানতে চেয়েছিলাম গ্রুপের অভিজ্ঞ শিকারিদের কাছে। কাজী জহিরের মতে শুরুতেই শিকারের স্থানটি সম্পর্ক ভালো ধারণা রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিকারের জায়গার উপরই নির্ভর করে পুরো প্রস্তুতি। যদি পুকুর বা লেকে টিকিট কেটে মাছ ধরতে হয় তবে সেখানকার পারিপার্শ্বিক অবস্থান, মাছের ধরন ও আকার, টিকিটের আসন সংখ্যা, সময়কাল, কতগুলো ছিপ ফেলা যাবে, টোপের ধরনে কোন বাধ্যবাধকতা আছে কিনা-ইত্যাদি বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তাছাড়া ঋতু অনুযায়ী বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার কথাও বলেন জহির।
বড়শি আর শিকারের ধরন অনুযায়ীও সরঞ্জামে ভিন্নতা থাকে। একেক ধরনের মাছের জন্য ব্যবহৃত হয় একেকরকমের বড়শি ও টোপ। মাছের ক্ষতি হয় এমন কোনো পদ্ধতিতে শিকার করাকে উৎসাহিত করেন না গ্রুপের সদস্যরা। জহির বলেন, "এক ধরনের তিন কাঁটার বড়শি আছে যাকে আমরা এংকর বলি, সেই এংকর দিয়ে ঢিল ছুঁড়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে অনেকেই মাছ শিকারের চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে মাছের গায়ে আঘাত লেগে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। শিকারে ব্যর্থ হলে জলাশয়ে থেকে যাওয়া আহত মাছ গুলো যন্ত্রণা ভোগ করে মারা যায়। এসব কারণে এংকর দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হিসেবে প্রচার করি আমরা।"
পুকুর-লেকের মতো বদ্ধ জলাশয় আর নদী-সমুদ্রের মতো মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরার পদ্ধতিও ভিন্ন। বদ্ধ জলাশয়ের মাছ সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা থাকে শিকারিদের কিন্তু মুক্ত জলাশয়ে যেকোনোসময় যেকোনো আকৃতির মাছ ধরা পড়তে পারে। তাই সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও রাখতে হয় আগে থেকে।
মাছের আকৃতির উপর নির্ভর করে মাছ ধরার রড (ছিপ), রিল ও সুতা বাছতে হয়। নদী বা সমুদ্রে গেলে শিকারিরা সাধারণত বেশি শক্ত ও মজবুত সরঞ্জাম নিয়ে যেতে পছন্দ করেন। জহিরের ভাষ্যে, "নদীর মাছের সাইজ হয় ধারনারও বাইরে। হয়তো একজন শিকারির সারা জীবনে এতো বড় মাছের সাক্ষাৎ পাবে না। তাই প্রাপ্ত সুযোগকে যথার্থ কাজে লাগাতে শক্ত ও মজবুত সরঞ্জাম ব্যবহার জরুরি।"
বড়শিতে মাছ আটকানোর পরের সময়টাই মূলত শিকারের আসল মজা। শিকারি কতটা কৌশলের সাথে মাছকে পাড়ে তুলতে পারে তা-ই হলো দক্ষতা। মাছের সাথে কৌশল খাটানোর এই সময়টাকেই খেলা মনে করেন তারা। ছিপের সাহায্যে মাছ জালে তুলে সাবধানে মাছের মুখ থেকে সরিয়ে নিতে হয় বড়শি। অসাবধানতায় বড়শি লেগে শিকারির হাতও কেটে যেতে পারে। তাই মাথায় রাখতে হয় প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়টি।
ছিপ, রিল, নেট, বড়শি, সুতা ছাড়াও মাছ ধরার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের মধ্যে আছে মাছের খাবার হিসেবে পিঁপড়ার ডিম, পাউরুটি, ছাতু, চার ও নানা ধরনের মশলা। সারাদিনের মাছ ধরার প্রস্তুতি হিসেবে এই সরঞ্জামের পেছনেই একজন শিকারির খরচ হয় প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। পাশাপাশি যাতায়াত, নাস্তা আর সারাদিনের খাবার খরচ তো আছেই। বদ্ধ জলাশয়ে টিকিট কেটে মাছ ধরায় বসতে চাইলে টিকিট প্রতি দাম হয় ২ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। বেশি দামের টিকিটে কখনো কখনো থাকে পুরষ্কারের ব্যবস্থা। সবচেয়ে বেশি ওজনের মাছ ধরতে পারলে নগদ অর্থসহ নানা ধরনের পুরষ্কার দেওয়া হয় সেরা শিকারিদের।
তবে উচ্চমূল্যে টিকিট কিনলেই যে ভাগ্যে মাছ জুটবে এমন নিশ্চয়তা নেই কোনো। কখনো কখনো সারাদিনে একটাও মাছ ধরা পড়ে না শিকারির বড়শিতে। কোনো কোনো জলাশয়ের মালিক মাছ শিকারিদের ঠকানোর চেষ্টাও করেন। শিকারে বসার আগেই পুকুরে কেমিক্যাল সার দিয়ে দেওয়া বা পুকুরে মজুদ মাছের তুলনায় অতিরিক্ত টিকিট বিক্রির কারণে প্রায়ই ক্ষোভ জাগে শিকারিদের মাঝে। তাই টিকিট কেনার আগে দেখেশুনে নেওয়ার পরামর্শ দেন অভিজ্ঞরা। তবে দিন শেষে মাছের প্রাপ্তি মূলত ভাগ্য আর নিজস্ব কৌশলের উপরই নির্ভর করে বলে জানান তারা।
কোনো কোনো পুকুর বা লেকে টিকিটের বদলে শিকার করা মাছ ওজন হিসেবে বিক্রি করা হয় শিকারিদের কাছে। এই ব্যবস্থাকে মাছ শিকারের জন্য তুলনামূলক সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক বলে মনে করেন শিকারিরা।
দিনদিন বাজারের অন্য সবকিছুর মতো মাছ ধরার সরঞ্জামের খরচেও ঊর্ধ্বগতি থাকায় বিপাকে পড়ছেন শৌখিন মাছ শিকারিরা। জহিরের ভাষ্যে, "কিছুদিন আগেও ছাতু ২০০-২৫০ টাকা কেজিতে পাওয়া যেত এখন ৩০০-৬০০ টাকা কেজি মূল্যে ছাতু কিনতে হচ্ছে। আগে পিঁপড়ার ডিম পাওয়া যেত ৫০০ টাকা কেজি দরে। এখন ঋতুভেদে ১০০০ থেকে ২০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠা-নামা করছে। চার মশলার ঊর্ধ্বগতির কারণে অধিকাংশ শিকারি এখন আর আগের মত সুগন্ধি মশলা ক্রয় করতে পারছেন না। শখ ও সাধ্যের মাঝে বিশাল ব্যবধান স্পষ্ট। বাস্তবতা এমন যে, মৎস্য শিকারের শখটা এখন ধনীদের পক্ষেই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে, গরীব শিকারিদের জন্য আফসোস করা ছাড়া উপায় থাকে না।"
শিকারিদের মাছ ধরার প্রিয় স্থান
ঢাকার ভেতর অধিকাংশ শিকারির প্রিয় কয়েকটি মাছ ধরার পয়েন্ট হলো মিরপুর চিড়িয়াখানার লেক, ধানমন্ডি লেক, রমনা পার্ক লেক, মিরপুর ডিওএইচএস লেক, উত্তরা দিয়াবাড়ি, আব্দুল্লাহপুর ও ৩০০ ফিটের দিকে কিছু লেক। নদীতে মাছ শিকারের জন্য ঢাকার কাছাকাছি আছে ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার বেশ কিছু পয়েন্ট শিকারিদের বেশ পছন্দের।
প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবারে মিরপুর চিড়িয়াখানার দুটি লেকে মাছ ধরার টিকিট দেওয়া হয়। দাম ২ হাজার টাকা, ২ ছিপ। ঢাকার ভেতর প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য চিড়িয়াখানার উত্তর-দক্ষিণের লেক দুটি কাজী জহিরের প্রিয় জায়গা। তবে এখানে সবসময় যে খুব একটা মাছ ধরা পড়ে এমন নয়। অনির্দিষ্ট সংখ্যায় টিকিট বিক্রি হয় বলে বিশৃঙ্খলাও থাকে অনেক। চিড়িয়ানার স্টাফদের দুর্নীতি ও বেআইনিভাবে জাল দিয়ে মাছ ধরা নিয়েও অভিযোগ থাকে শিকারিদের।
স্মৃতির পাতায়
মাছ ধরা নিয়ে শত-শত প্রিয় স্মৃতি প্রত্যেক শৌখিন শিকারির। জীবনের দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝেও তাদের প্রিয় শখের জন্য সময় বের করতে কার্পণ্য করেন না। বহু বছরের শিকারের অভিজ্ঞতার মাঝে কাজী জহিরের প্রিয় স্মৃতি জুড়ে আছে মিরপুরের চিড়িয়াখানার লেকের এক ঘটনা।
গতবছর এপ্রিলের প্রথম শুক্রবার বসেছিলেন চিড়িয়াখানার দক্ষিণ লেকে। সারাদিন অপেক্ষা করেও বড়শিতে মাছ ধরা পড়ছিল না কোনো। সন্ধ্যা নাগাদ আরো কয়েকজন সঙ্গীদের নিয়ে কয়েকটি তেলাপিয়া ছাড়া আর কিছু জোটেনি ভাগ্যে। অন্ধকার ঘনিয়ে এলে ফাৎনায় রেডিয়াম লাগিয়ে লক্ষ্য রাখছিলেন মাছের দিকে। অনেকক্ষণ পর মশার কামড় আর হতাশার কবলে পড়ে নিরাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। দুজন সঙ্গীকে বসিয়ে রেখে মাছ ধরার সরঞ্জাম গুছিয়ে রেখে আসতে গেলেন কাছেই তার অফিসে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মোবাইলে বেজে ওঠে রিং। সঙ্গী দুজন ছিপ ফেলে বসে ছিলেন তখনো। জানালেন বড়শিতে মাছ গেঁথেছে। যেতে হবে জলদি। তাড়াহুড়া করে পয়েন্টে পৌঁছে দেখেন মাছের টানে সঙ্গীর হাতে থাকা ১০ ফিটের রডটি চন্দ্রাকারে বেঁকে গেছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেল মাছটিকে খেলিয়ে পাড়ে তুলতে। প্রায় ২০ কেজি ওজনের পাংগাস মাছ ধরা পড়েছিল বড়শিতে। এ পর্যন্ত কাজী জহিরের ধরা সবচেয়ে বেশি ওজনের মাছ ছিল এটি। এখনো সেদিনের স্মৃতি মনে করে রোমাঞ্চিত হন তিনি।
তরুণ বয়সের মাছ শিকারের স্মরণীয় ঘটনা শৌখিন মৎস্য শিকারিদের গ্রুপে পোস্ট করেছিলেন জাকির হাসান। সময়টা ১৯৮৫ সাল, বাংলাদেশ আর্মিতে ক্যাপ্টেন হিসেবে যশোরে কর্মরত ছিলেন তিনি তখন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে মাছ শিকারের দাওয়াত পেয়ে এক শুক্রবারে গিয়েছিলেন এক পুকুরে। সঙ্গে ছিলেন সেই কর্মকর্তার স্ত্রী ও শালিকা। মাথায় হ্যাট, চোখে কালো চশমা, হাতে ঘড়ি, পরনে রঙিন টি-শার্ট, জিন্স ও পায়ে ওয়াকিং শু লাগিয়ে ফিটফাট হয়ে মাছ ধরার আয়োজনে গিয়েছিলেন জাকির হাসান। পুকুরে বড়শি ফেলে ঘণ্টাখানেক বসে থেকেও মাছের দেখা পাচ্ছিলেন না তিনি। অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ততোক্ষণে দুইটি বড় সাইজের রুই মাছ ধরে ফেলেছেন।
কিছুটা হতাশ হয়ে আবারো নতুন করে বড়শিতে টোপ লাগিয়ে পানিতে ফেললেন তিনি। কিছুক্ষণ পর ফাৎনা যেন খানিকটা নড়ে উঠতে দেখলেন। সতর্ক হয়ে বড়শিতে বড় কোনো মাছের টান পড়ার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। ফাৎনার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে হঠাৎ করে কাত হয়ে চেয়ার, হুইল, ছিপসহ নিজেই গড়িয়ে পড়লেন ঘাটের সিঁড়ি থেকে সোজা পুকুরে!
জাকির হাসানের লেখায়, "আসলে আমি যখন বড় একটা মাছ ধরার নেশায় বুঁদ হয়ে আছি ও একটু একটু নড়ে-চড়ে বসছি, আমার চেয়ারের বাম পাশের পায়া দু'টোও সিঁড়ির হাতলের কিনার থেকে কিনারে সরে যেতে যেতে এক সময় সিঁড়ির বাইরে চলে যায় ও আমি ভারসাম্যহীন হয়ে পুকুরে পড়ে যাই। চেয়ার যখন একেবারে কিনারায় চলে যায় তখন চেয়ার একটু কাত হওয়াতে আমিও কাত হয়ে পড়েছিলাম।"
হারিয়ে যাচ্ছে শিকারের সুযোগ
প্রাকৃতিক জলাশয় কমে যাওয়া, কৃষি জমিতে বিষাক্ত সারের ব্যবহার, লোভী ব্যবসায়ীদের নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার, অবৈধভাবে নদীতে ফাঁদ পেতে মাছ ধরা প্রভৃতি নানা কারণে প্রতিনিয়ত দেশে কমে যাচ্ছে ছিপ-বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের সুযোগ। এতে হতাশা প্রকাশ করছেন অনেক শৌখিন শিকারি।
কাজী জহির বলেন, "ছোট-বড় নদীগুলো আজ সন্ত্রাসীদের দখলে। বাংলাদেশের প্রতিটি ছোট বড় নদীতে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় অবৈধভাবে দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে এই গোষ্ঠী। তারা নদীর বিভিন্ন অংশে হাজার হাজার বাঁশ কুপে ঘের দিয়ে তারমধ্যে বড় বড় গাছের ডাল পালা ফেলে, নিয়মিত খাবার দিয়ে মাছের কৃত্রিম অভ্যয়ারণ্য সৃষ্টি করে। নিরাপদ বাসস্থান ভেবে বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছ এই সমস্ত ঘেরে আশ্রয় নিয়ে থাকে। তারপর মোক্ষম সময় ও সুযোগ বুঝে রাতের আধারে জাল দিয়ে ঘের দিয়ে বন্দী মাছগুলোকে ধরে বাজারে তুলে। কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ এক শ্রেণির লুটেরাদের পকেট ভারী করছে প্রতি বছর।
এই অবৈধ আয়ের টাকার কোন অংশই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয় না। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কিছু লোক টাকার ভাগ নিয়ে লুটেরাদের দোসর হচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছর কোটি কোটি পোনা মাছ অবমুক্ত হচ্ছে অথচ এর পুরোটা সুফল ভোগী এই লুটেরা শ্রেণি, সাধারণ মানুষ বা শৌখিন মৎস্য শিকারিগণ সরকারি এই সুবিধাভোগ থেকে বলা যায় পুরোপুররি বঞ্চিত। নদীতে স্থাপিত এই সমস্ত ঘের দেওয়া বন্ধ করা গেলে উন্মুক্ত জলাশয়ের মা মাছের ডিম দিয়ে এদেশের নদী নালা খাল বিল মাছে পরিপূর্ণ থাকত।"
তবু যতটুকু সুযোগ আছে তার মধ্যেই মাছ শিকার করে নিজেদের মনের খোরাক মেটান শৌখিন শিকারিরা। 'বাংলাদেশের শৌখিন মৎস্য শিকারী' গ্রুপ থেকে প্রায়ই শিকারিদের উৎসাহ প্রদানের জন্য নানা রকম পুরষ্কারের আয়োজন করা হয়। জেলা ভিত্তিক দল করে গ্রুপ থেকে পরিচিত সঙ্গীদের নিয়ে অবসরে মাছ শিকারেও যান সদস্যরা।