বোয়িং ৭৪৭: সমাপ্তির পথে 'আকাশের রানি'র যুগ
'বোয়িং ৭৪৭' অ্যাভিয়েশনের ইতিহাসে অতি পরিচিত একটি নাম। ১৯৬৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনের এভারেটে অবস্থিত অ্যাসেম্বলি প্লান্ট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে প্রথম বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি। একসময় 'আকাশের রানি' খ্যাত বোয়িং ৭৪৭ বিমান সম্পর্কিত সবকিছুই ছিল আলোচিত এবং উত্তেজনাকর।
'বোয়িং ৭৪৭'ই ছিল অ্যাভিয়েশনের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম ওয়াইড-বডি 'জাম্বো জেট'। ষাটের দশকের শেষভাগে প্রায় ৫০ হাজার নির্মাণশ্রমিক, কারিগর, ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্যরা মিলে মাত্র ১৬ মাসে বিমানটি তৈরি করেছিলেন। ২০০৭ সালে 'এয়ারবাস এ৩৮০' বাজারে আসার আগপর্যন্ত এটিই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বেসামরিক বিমান।
এরপর থেকে বোয়িং ৭৪৭ বিমানের নানা সংস্করণ বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। এই যেমন, ১৯৯০ সালে একজোড়া বোয়িং ৭৪৭-২০০ বিমান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী 'এয়ার ফোর্স ওয়ান' এর অংশ হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে।
শুধুমাত্র 'বোয়িং ৭৪৭' উৎপাদনের জন্য বোয়িং কোম্পানিকে এমন একটি কারখানা স্থাপন করতে হয়েছিল যা তৎকালীন এবং এখনও পর্যন্ত ভলিউমের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভবন হিসেবে বিবেচিত; যে ভবন কিনা ৭৫টি ফুটবল মাঠের কিংবা সমগ্র ডিজনিল্যান্ডের সমান!
কিন্তু চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি সর্বশেষ বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি তাদের কারখানা ছেড়ে গেছে। যদিও ইউএস এয়ারলাইনস এখন আর বোয়িং ৭৪৭ বিমান ব্যবহার করে না; কিন্তু এটি ছিল এমন একটি ঐতিহাসিক বিমান যা জনসাধারণের জন্য আন্তর্জাতিক বিমান ভ্রমণকে সাশ্রয়ী করে তুলতে সাহায্য করেছে।
জাম্বো জেট
অন্য আরও অনেক বিমানের মতো 'বোয়িং ৭৪৭' এর যাত্রাটাও শুরু হয়েছিল সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুরোধের মাধ্যমে। ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী এমন একটি বিশালাকারের বিমান তৈরির প্রস্তাব দেয় যা ভারি মালামাল বহন করতে পারবে এবং তখনকার সি-১৪১ এর মতো বিমানের চাইতে আরও বেশি দূরত্বে যাতায়াত করতে পারবে।
যদিও সি৫ গ্যালাক্সির কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বোয়িং টিকে থাকতে পারেনি; তবে বিমান নির্মাণের জন্য নকশা ও গবেষণা পরিকল্পনাগুলো বিফলে যায়নি। কারণ ঐ একই সময়ে প্যান আমেরিকান ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ-এর প্রেসিডেন্ট জুয়ান ট্রাইপে চেয়েছিলেন, বোয়িং যেন প্রথম-প্রজন্মের জেট এয়ারলাইনার বোয়িং ৭০৭ এর দ্বিগুণ আকারের একটি বিমান বানায়।
বড় ঝুঁকি
কিন্তু তৎকালীন সময়ে এই বিমান নির্মাণ করা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ।
বোয়িং কোম্পানিসহ অ্যাভিয়েশন শিল্প সংশ্লিষ্ট অনেকেই তখন মনে করতেন, ভবিষ্যতে বিমানচালনার ক্ষেত্রে সবাই দ্রুতগতির বিমান চাইবে, বড় আকারের নয়। তারা কনকর্ডের মতো সুপারসনিক বিমান তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন যা তখনকার সাবসনিক ফ্লাইট অপ্রচলিত করে তুলবে। ১৯৭৬ সালে যাত্রা শুরু করা কনকর্ড দীর্ঘ পথের দূরত্ব খুব কম সময়েই পাড়ি দিতে পারতো। যেমন- লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক যেতে কনকর্ডের সময় লাগতো প্রায় তিন ঘণ্টা। অন্যদিকে, বোয়িং ৭৪৭ বা অন্য যেকোনো বাণিজ্যিক সাবসনিক বিমানের লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক যেতে সময় লাগতো প্রায় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা।
কিন্তু এই সবকিছু সত্ত্বেও বোয়িং কোম্পানি নতুন প্রকল্পটি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়। ওই গ্রীষ্মেই প্যারিস এয়ার শো'তে হাজারো দর্শকের সামনে বিমানটির অভিষেক হয়। বছরের শেষের দিকে ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন 'বোয়িং ৭৪৭'কে উড্ডয়নের উপযোগী বলে ঘোষণা দেয় এবং ১৯৭০ সালের ১৫ জানুয়ারি প্যান আমেরিকান এয়ারওয়েজ তাদের প্রথম বোয়িং ৭৪৭ বিমান ডেলিভারি নেয়।
যদিও বোয়িং ৭৪৭-১০০ বিমানটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে এটি খরচ সাশ্রয়ী হবে, কিন্তু তবুও ফ্লাইটে যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৪০০। কারণ দুর্ভাগ্যবশত বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি চালু হয়েছিল মন্দা এবং প্রথম তেল সংকটের সময়ে... ফলে বিমানে যাত্রীর সংখ্যা কমে গিয়েছিল।
তার ওপর এ প্রকল্পটি বোয়িং কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল- কারণ এ বিমান তৈরির জন্য বোয়িংকে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে হয়েছিল... যা বর্তমানের হিসাবে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার!
কিন্তু সৌভাগ্যবশত, বোয়িং তাদের বিমানকে যাত্রীবাহী এবং মালবাহী বিমান, দুই হিসেবেই ব্যবহারের উপযোগী করে নকশা করতে সক্ষম হয়েছিল। এ বিমানের সামনের নাকের অংশটি খোলা যেত, যেখানে মালামাল রাখার জায়গা ছিল।
সোনালি সময়
বোয়িং ৭৪৭ ছিল অ্যাভিয়েশনের ইতিহাসে সবচেয়ে পরিচিত বা সহজের চেনার মতো একটি বিমান। বেশিরভাগ মানুষই যখন বোয়িং ৭০৭ এবং ডিসি-৮ এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে সমস্যায় পড়তেন, তখন বোয়িং ৭৪৭ এর বিশাল আকার এবং সামনের দিকের উঁচু হয়ে থাকা 'কুজ' এটির স্বতন্ত্রতা প্রমাণ করে।
বিমান পরিবহন খাতের তথাকথিত 'সোনালি সময়ে' আত্মপ্রকাশ করেছিল বোয়িং ৭৪৭। ওই সময়ে বিমান ভ্রমণকে খুবই আকর্ষণীয় কিছু হিসেবে বিবেচনা কর হতো এবং বেশিরভাগ এয়ারলাইনসের গ্রাহকরা ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর। উদাহরণস্বরূপ, বিমানের ধারণক্ষমতার সমান যাত্রী না নিয়ে, সেসময় বিমানের উপরের ডেক প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে যাত্রীদের প্রলুব্ধ করার উদ্দেশ্যে আমেরিকান এয়ারলাইন্স আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সেই লাউঞ্জকে 'পিয়ানো বার'-এ রূপ দেয়। সেখানে একটি ওয়ারলিৎজার অর্গান বসিয়ে একজন একজন পেশাদার শিল্পীও রাখা হয়, যিনি যাত্রীদের সাথে গানে সুর মেলাতেন।
কিন্তু খুব শীঘ্রই এ ধরনের চটকদার বিনোদনের উপকরণের চল উঠে যায়, কারণ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ তখন উচ্চমানের সেবা দেওয়ার চাইতে খরচ কমিয়ে আনার দিকে মনোযোগ দেয়। সময়ের সাথে সাথে বোয়িং ৭৭৭ এর মতো আকারে ছোট কিন্তু অধিক কর্মক্ষম, লং-রেঞ্জের দুই ইঞ্জিনযুক্ত বিমান জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। আর বোয়িং ৭৮৭ আসার পরে বিশালাকার জাম্বো জেটের প্রয়োজনই ফুরিয়ে যায়।
অ্যাভিয়েশনের ইতিহাসে উজ্জ্বল এক নাম
বোয়িং ৭৪৭ বিমানের নানা রকম সমস্যা থাকা সত্ত্বেও, বিমানচালনার ইতিহাসে অন্যতম এক আইকন হয়ে আছে এটি। আমেরিকান পপ সংস্কৃতিতেও বোয়িং ৭৪৭ এর বিশেষ অবস্থান রয়েছে।
"এয়ারপোর্ট ১৯৭৫" এবং "এয়ারপোর্ট '৭৭" নামক দুটি চলচ্চিত্রে বোয়িং ৭৪৭ বিমান ব্যবহৃত হয়েছে, সেই সাথে বিমান হাইজ্যাকের ঘটনার ওপর নির্মিত অসংখ্য চলচ্চিত্রেও এ বিমান ব্যবহৃত হয়েছে।
তাছাড়া, কিছু বিশেষ মিশন পরিচালনার জন্যও বোয়িং ৭৪৭ বিমানের আলাদা খ্যাতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নাসা তাদের স্পেস শাটলকে ল্যান্ডিং ও লঞ্চিং সাইটের মধ্যে আনা-নেওয়া করার জন্য একটি বিশেষভাবে নির্মিত বোয়িং ৭৪৭ বিমান ব্যবহার করেছে।
আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও তার পারিষদবর্গকে নিয়ে উড়ে চলার জন্য এখনও একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমানের কার্যক্রম অব্যহত আছে। ২০২৪ সালে আরেকটি বোয়িং ৭৪৭-৮ বিমান এ দায়িত্ব নেবে, যা আগেরটির চাইতে আরও বেশি দূরত্বে ও বেশি গতিতে ভ্রমণে সক্ষম।
জানুয়ারির ৩১ তারিখে সর্বশেষ বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি কারখানা ছেড়ে গেলেও, মালবাহী বিমান হিসেবে আরও অনেক বছর এ বিমান ব্যবহার করা যেতে পারে। আর যেহেতু মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ভ্রমণ করবেই, তার মানে একবিংশ শতাব্দীতেও বিখ্যাত এই বিমানটির আবেদন সম্পূর্ণ মলিন হবে না!
(লেখক জ্যানেট বেডনারেক ডেটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অধ্যাপক)