গোল্ডম্যান স্যাকসের প্রথম বাংলাদেশি অংশীদার
১৯৮০-র দশকের শেষের দিকের কথা। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তখনও ক্ষমতায়। ক্যাম্পাসভিত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক অন্তর্কোন্দল থেকে শুরু করে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন—সব মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস তখন বেশ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় পার করছে। রিয়াদ তখন ঢাবির হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের পাশে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র। ওই সময় ছোট্ট রিয়াদ প্রায়ই আক্ষরিক অর্থেই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের গোলাগুলির (ক্রসফায়ার) সাক্ষী হতো।
স্কুল জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে রিয়াদ হাসতে হাসতে বললেন, 'জানালা দিয়ে আমাদের ক্লাসরুমে বুলেট ঢুকে পড়ত, এজন্য আমাদের প্রায়ই ডেস্কের নিচে লুকিয়ে পড়তে হতো। সে এক রঙিন (!) অভিজ্ঞতা।'
রিয়াদের শুরুটা তুলনামূলক সাদামাটা। তার বেড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শিক্ষাবিদ পরিবারে। পড়াশোনা করেছেন সাধারণ বাংলা মাধ্যম স্কুলে। ১৬ বছর বয়সের আগে কখনও ইংরেজিতেও কথা বলেননি।
রিয়াদ বলেন, 'আমি যাকে বলে একটা খাঁটি মধ্যবিত্ত একাডেমিক পরিবারে বড় হয়েছি। আমার স্কুলের মাসিক ফি ছিল ১৪ টাকা। আমার স্কুলটা কোনো দিক থেকেই বিখ্যাত ছিল না। এছাড়া আমি পড়াশোনাও করেছি বাংলা মিডিয়ামে, এবং বয়স ১৬ হওয়ার আগপর্যন্ত ইংরেজিতে কথা বলতে শিখিনি।'
তবে সময় সবকিছু বদলে দেয়। কদিন পরই এরশাদের শাসনের ইতি ঘটে। বাংলাদেশে ফিরে আসে গণতন্ত্র। আর ছোট্ট রিয়াদও বড় হয়ে যায়। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রে। এবং সবশেষে সেই ছোট্ট রিয়াদ বনে যান গোল্ডম্যান স্যাকস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, তারপর অংশীদার।
যারা এখনও জানেন না, তাদের জানিয়ে রাখছি—এই গত বছরই বিশ্বের অন্যতম অভিজাত বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের অংশীদার হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লন্ডনভিত্তিক ব্যাংকার রিয়াদ ইউসুফ। রিয়াদ প্রথম ২০১১ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে গোল্ডম্যানে যোগ দেন। ডয়েচে ব্যাংকে পরিচালক হিসেবে সফলভাবে সাত বছর দায়িত্ব পালনের পর এ দায়িত্ব নেন তিনি। রিয়াদ এখন ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার উদীয়মান বাজারের সেলস-এর সহপ্রধান।
রিয়াদ জানালেন, 'বাংলাদেশ, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের মতো উদীয়মান বাজারগুলো সারা বিশ্বেই প্রবৃদ্ধির একটি বড় চালক। গোল্ডম্যান স্যাকস এই বাজারগুলোকে পরবর্তী ১১টি [নেক্সট ইলেভেন] দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আমি এই দেশগুলোতে অর্থায়ন, ডেরিভেটিভ হেজিং এবং অন্যান্য আর্থিক বাজারের ব্যবসার দেখাশোনা করি।'
গোল্ডম্যান স্যাকস বুঝতে পেরেছে যে নিজেদের বাজার উন্নত অর্থনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখলে তারা নেক্সট ইলেভেনের মতো উদীয়মান বাজারগুলোর মতো বড় একটি জনসংখ্যার বাজার ধরতে পারবে না। তবে উদীয়মান বাজারগুলো এখনও অনুন্নত। অনেক উদীয়মান বাজারের কাছেই হেজিং বা ডেরিভেটিভ আর্থিক পণ্যগুলো এখনও অভিনব ধারণা। গোল্ডম্যানের অংশীদার হিসেবে রিয়াদ এই উদীয়মান দেশগুলোর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করেন, যাতে দেশগুলো নতুন এসব পণ্য সহজে ব্যবহার করতে পারে।
১৯৯৩ সালে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এসএসসি সম্পন্ন করেন রিয়াদ। তবে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আগেই তিনি বেটস কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা ও গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন।
রিয়াদের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষাবিদ। তার বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক। আর মা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অর্থনীতিবিদ।
রিয়াদ বলেন, 'একাডেমিক পরিবারে বেড়ে ওঠায় শিক্ষাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেত। বড় ছেলে হিসেবে আমি কিছু সুযোগ-সুবিধা পেতাম। পড়াশোনার সময় কেউ আমাকে বিরক্ত করত না। তবে এর অর্থ কিন্তু ছিল, আমার ওপর বিশাল প্রত্যাশা রয়েছে। গণিতে ১০০ নম্বর পেতে হবে। ৯৯ পেলেই ঘটত মহাবিপদ। এমনটা ঘটলে "বেতের বাড়ি" ছিল অবধারিত।'
একাডেমিক দক্ষতা থাকলেও রিয়াদের যাত্রা সবসময় সহজ ছিল না। বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। সেজন্য ২২টি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। কিন্তু তার দরকার ছিল সম্পূর্ণ অর্থায়নের স্কলারশিপ। কারণ স্কলারশিপ ছাড়া মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারের পক্ষে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করানোর সামর্থ্য ছিল না।
ওই সময় রিয়াদের বাবা-মায়ের সীমিত আয়েই চলত তাদের ২০ সদস্যের যৌথ পরিবার। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রিয়াদ বলেন, 'বেশিরভাগ সময়ই আমাদের বাড়িতে মাংস থাকত না, আর প্রোটিনের জন্য মাছই [যা ওই সময় তুলনামূলক সস্তা ছিল] ছিল ভরসা। তাই আমার ফুললি-ফান্ডেড স্কলারশিপ দরকার ছিল।
'আমি যে ২২টি স্কুলে আবেদন করি, তার মধ্যে ২১টাই প্রত্যাখ্যানপত্র পাঠায়। কেবল একটি স্কুল আমার আবেদন গ্রহণ করে, তা-ও বৈচিত্র্যের মানদণ্ডের আওতায়।'
বেটসে সুযোগ পাওয়ার পরও রিয়াদকে অনেক কষ্ট করতে হয়। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিদেশে বসবাসের খরচ জোগাতে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ করতেন তিনি।
কঠিন সেই সময় নিয়ে রিয়াদ বলেন, 'জীবনের সেই সময়টা আমাকে সুসংগঠিত হতে শিখিয়েছে। আমি যেখানে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম, সেই পথে চলতে শিখিয়েছে। বিমান ভাড়া অনেক বেশি বলে বহু বছর আমি বাংলাদেশে যেতে পারিনি। প্রত্যেক ফোনকলের জন্য খরচ হতো ১০০ ডলারের মতো। ওই টাকা আয় করতে আমাকে ১৫ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। এ কারণে বাবা-মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে পারিনি। ওই সময়টায় আমি বাবা-মার সাথে দেখা করিনি, তাদের সাথে নিয়মিত কথাও বলিনি।'
তবে রিয়াদ এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। নিজের পুরোটা দিয়ে লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যেতে থাকেন। তার ফলও পান। সফলভাবে কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন রিয়াদ। এমনকি কলেজ রোয়িং দলের অধিনায়কও ছিলেন।
কিন্তু পদার্থবিদ্যা ও গণিতে মেজর হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে তিনি আর্থিক খাতের নির্বাহী হয়ে উঠলেন?
রিয়াদ জানান, শুরুর দিকে তিনি বেশি বেতনের চাকরি খুঁজছিলেন। তখনই নিউইয়র্কের মেরিল লিঞ্চে একটা চাকরির খবর পান। সেই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাটে প্রবেশ করেন তিনি। ওই চাকরিই তাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
রিয়াদ তার সাফল্যের অনেকটা কৃতিত্ব বাংলাদেশে কাটানো সময়কে দেন। তার বিশ্বাস, ছোটবেলা থেকেই কঠিন পরিবেশে বড় হওয়ার ছাপ পড়েছে তার ব্যক্তিত্বে। তিনি এ-ও বিশ্বাস করতেন যে, যৌথ পরিবারে বড় হওয়া দক্ষিণ এশিয়ারর অনন্য অভিজ্ঞতা—এবং এই অভিজ্ঞতা তাকে বিভিন্ন সংস্কৃতির ক্লায়েন্টদের সঙ্গে সহজভাবে মিশতে সাহায্য করে।
রিয়াদ বলেন, 'বিভিন্ন ব্যাংকে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, গোল্ডম্যানের সংস্কৃতি আশ্চর্যজনকভাবে অনন্য। গোল্ডম্যানে আমরা সত্যিই ভাগাভাগি করে নতুন নতুন আইডিয়া তৈরি করতে ও সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করি। যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, উপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার কাছ থেকে আইডিয়া নিই।
'আমার মতে, বাংলাদেশে [এবং আরও অনেক উদীয়মান দেশে] বেসরকারি ও সরকারি উভয় খাতেই কাজ এত ধীর গতিতে হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। এখানে ব্যাংকের সিইও/এমডি বা সরকারি খাতে মন্ত্রী পর্যায়ে পরামর্শ না করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।'
রিয়াদ আরও বলেন, প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই ভবিষ্যৎ নেতাদের শক্ত পাইপলাইন তৈরি রাখার জন্য গোল্ডম্যান প্রশিক্ষণ ও পরামর্শদানকে অগ্রাধিকার দেয়।
'পরবর্তী প্রজন্মকে কীভাবে গড়ে তুলব, তা আমার আমার দিনের বড় একটা সময় ও চিন্তার বড় একটা অংশজুড়ে থাকে। আমার প্ল্যানারের বড় একটা অংশ বরাদ্দ থাকে পরবর্তী প্রজন্মকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য, যাদের মধ্যে কেবল তরুণ বিশ্লেষকই নয়—এমডি, ভিপিসহ অন্যান্য মধ্যম-পর্যায়ের কর্মচারীরাও রয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত মেন্টরশিপ ও কোচিংয়ের এই সংস্কৃতি বাংলাদেশে খুব একটা নেই।'
আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্যও রিয়াদ কিছু সুপারিশ করেছেন।
তিনি বলেন, 'একটা কোম্পানিতে যদি বিনিয়োগ করেন, তাহলে আপনাকে জানতে হবে যে শেয়ারহোল্ডার হিসাবে আপনার স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমে যখন স্বাধীন পরিচালকদের ধারণা চালু হয়, তখন পুরো দৃশ্যপটই বদলে যায়, বিশেষ করে সিইওকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে। কাজেই কর্পোরেট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
রিয়াদ আরও বলেন, 'আরেকটি সমস্যা হলো বিদেশি পুঁজি আকৃষ্ট করা। বাংলাদেশ যে কাজটা করতে পারে, তা হলো সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করা এবং মূলত, অবারিত বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া। এটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশকে অবধারিতভাবেই অন্যান্য দ্রুত বর্ধনশীল দেশের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা করতে হবে।'