গণস্বাস্থ্য এবং জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সফল 'ইউটোপিয়া'!
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ওষুধনীতি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে দেশীয় ওষুধ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করায় এ কোম্পানিগুলো ওষুধনীতি বানচালের চক্রান্তে নেমেছিল। কিন্তু তখন আপসহীন চিত্তে সেসব বাধার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ডা. জাফরুল্লাহ স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনাকে সামনে নিয়ে দরিদ্র মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে। জাফরুল্লাহর স্বাধীনতা সংগ্রাম, তার ব্যক্তিগত দর্শন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নিয়ে তার ভাবনা, সংস্থাটির কর্মযজ্ঞ নিয়ে ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি প্রচ্ছদ রচনা প্রকাশিত হয়েছিল যা এখনো প্রাসঙ্গিক। লেখাটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর পাঠকদের জন্য নতুন শিরোনামে, সংক্ষেপে প্রকাশ করা হলো।
গত বছরের মাঝামাঝি বেশ কিছুদিন ধরে জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের ধর্মঘট, ট্রেড ইউনিয়ন আধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রচুর খবর প্রকাশিত হয়। এক পর্যায়ে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের ঘটনাবলি জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শ্রমিক, সামাজিক সংগঠন এবং বুদ্ধিজীবীরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বিবৃতি দেন। সেসব বিবৃতির ভাষা কখনো ছিল গণস্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ, কখনো ছিল গণস্বাস্থ্যের পক্ষে সাম্রাজ্যবাদী ও বহুজাতিক কোম্পানিসমূহের বিরুদ্ধে।
গোটা ঘটনাই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে জাতীয় পর্যায়ে এক ভিন্নতর বিতর্কিত প্রেক্ষিতে দেখা হয়। এর আগে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিভিন্নভাবে আলোচিত বা সমালোচিত হলেও এত ব্যাপকভাবে আর কখনো বিরুদ্ধ আলোচনার মুখোমুখি হননি। এই ঘটনাবলীর মাধ্যমে একদিকে যেমন তিনি কারো দ্বারা সাম্রাজ্যবাদ বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর দোসর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন; অপরদিকে একইভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও বহুজাতিক কোম্পানী বিরোধী একজন আপোষহীন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। যেমন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক চেয়ারম্যান কর্নেল (অবঃ) কাজী নূর-উজ্জামানসহ বেশ কয়েকজন এক বিবৃতিতে গণস্বাস্থ্য ওষুধ কারখানার ঘটনা সম্পর্কে নেতাদের বিবৃতি ও কাগজের রিপোর্টকে বিভ্রান্তিকর বলে বর্ণনা করে বলেন, এটা দেশীয় শিল্প ধ্বংস করার জন্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলোর পুরাতন খেলা। বিবৃতিতে তারা আরো বলেন, ওষুধনীতি মাল্টিন্যাশনালের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে দেশীয় ওষুধ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো ওষুধনীতি বানচালের চক্রান্তে নেমেছে। কতিপয় রাজনৈতিক নেতা এসব চক্রান্তের শিকার হয়ে না জানা ঘটনা সম্পর্কে বিবৃতি দিয়ে ঘটনার বিকৃত প্রচারে সাহায্য করছে। তারা সরেজমিনে তদন্ত করে ঘটনা সম্পর্কে বক্তব্য রাখার আহ্বান জানান। পরবর্তীকালে পরিস্থিতির বিকৃতরূপের কথা অনুধাবন করে বিএনপির নেতা কর্নেল (অবঃ) জাফর ইমামের নেতৃত্বে দলীয় একটি সাব-কমিটি গঠিত হয় এবং তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে উভয়পক্ষের সঙ্গে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেন। এই তদন্তের আগেই বিচিত্রা সংঘাত সম্পর্কে রিপোর্ট প্রকাশ করে।
ঘটনার সুদুরপ্রসারী রাজনৈতিক পটভূমি
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঘটনাবলীর পেছনে একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক পটভূমি রয়েছে যা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নীলনকশার ফলশ্রুতি।
ডা. জাফরুল্লাহ বিচিত্রায় এবং বিদেশের পত্রপত্রিকায় অপ্রয়োজনীয় ওষুধের বিরুদ্ধে কলম ধরেন এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফা লুটপাটের স্বরূপ চিহ্নিত করেন। এবং এর পরবর্তী পদক্ষেপ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নতুন প্রকল্প: গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল।
গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস যখন অনেক কম মূল্যে ওষুধ বাজারে ছাড়ে তখন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও দাম কমাতে বাধ্য হয়। এরপরই সরকার ঘোষণা করে জাতীয় ওষুধনীতি। এতে বাদ দেয় মুনাফা লোটার হাতিয়ার অপ্রয়োজনীয় ওষুধ।
বহুজাতিক কোম্পানির পুরো আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন ডা. জাফরুল্লাহ।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ ঘটনার আগাগোড়া ব্যাখ্যা করে বলেন, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, কেবলমাত্র অর্থনৈতিক শোষণই নয়। তারা গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমেও এসব দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আইসিডিডিআরের কথা উল্লেখ করে বলেন, এদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড প্রথম প্রকাশের পর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি আমাদের সম্পর্কে খুব সতর্ক হয়ে ওঠে। এদিকে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল স্থাপনের দ্বারা আমরা প্রমাণ করি যে স্বল্প দামে অত্যন্ত উন্নতমানের ওষুধ বাজারজাত করা সম্ভব। এ কারণেই আমরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলোর ওষুধের লাভের হার এবং অন্যান্য ভেতরের খবরাদি দেশবাসী এবং সরকারকে জানাতে সক্ষম হই। সরকারকে ওষুধনীতি প্রণয়নে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, ওষুধনীতির কারণে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর একচেটিয়া কার্টেল বন্ধ করা সম্ভব হয়। ফাইজার গত দশ বছরে ৫৪ কোটি এন্টিবায়োটিক ডোজ তৈরি করেছে। কিন্তু গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল তার জন্মের প্রথম তিন বছরেই ২০ কোটি ভোজ এন্টিবায়োটিক তৈরি করেছে। বহুজাতি কোম্পানীগুলো অত্যন্ত চতুরতার সাথে কাজ করছে। পত্রিকায় তাদের বিজ্ঞাপন লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তারা বলছে, তারা ওষুধের উন্নতমান রক্ষা করে। কিন্তু বিজ্ঞাপনে যে ল্যাবরেটরির ছবি ছাপিয়েছে, তা মার্কিন কিংবা ইউরোপীয় কোন ল্যাবরেটরী, বাংলাদেশী নয়। এই বিজ্ঞাপন দেখে মনে হবে যে, ইউরোপীয়রাই তাদের ল্যাবরেটরী চালায়। এর ফলে সাধারণ চিকিৎসকদের ধারণা হবে যে, বিদেশীরা কাজ করে এবং স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক মানসিকতা কাজ করবে। এ জাতীয় সুপরিকল্পিত বিভ্রান্তিকর প্রচারের দ্বারা চিকিৎসক ও সরকারকে প্রতারণা করে তারা ওষুধের দাম বেশি রাখছে। যেমন তারা ক্যালভিন (জিনেরিক নাম পাইরোক্সিকম) বাজারজাত করছে, যার দাম রেখেছে সাড়ে ছ'টাকা। সত্যিকারভাবে বিশ্লেষণ করলে এর দাম কোনোক্রমেই এক টাকার বেশি হতে পারে না। এসব তথ্য আমরা প্রকাশ করি বলেই তারা আমাদের ওপর ক্ষুদ্ধ। আমাদের বিকাশ তাদের স্বার্থের পক্ষে হুমকি বলে মনে করে। কিছু সংখ্যক দেশী ব্যবসায়ীরাও নিম্নমানের ওষুধ ভাওতা দিয়ে বাজারজাত করে। লাগামহীন লাভের ব্যবসায় নিয়োজিত বলে তারাও বহুজাতিকের দোসর হিসাবে কাজ করছে। আমাদের অবস্থান তাদের জন্য মঙ্গলকর নয়। উভয়ের চক্রান্তের ফসল গণস্বাস্থ্যের সাম্প্রতিক ঘটনা। কাকে কান নিয়েছে শুনে কাকের পেছনে দৌড়াতে শুরু করার মতো কাজ করেছেন আমাদের কিছুসংখ্যক বামপন্থী নেতা। তাদের বিভ্রান্তির কারণ তারা বহুজাতিকের সুপরিকল্পিত প্রচার ও চক্রান্তের শিকার। গত আগস্টের ঘটনাবলী এরই আলোকে বিচার করা দরকার।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তার রাজনৈতিক দর্শন
আজকের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মূল্যায়ন করতে হলে তার পেছনে ফেলে আসা অতীত ও বর্তমানের আলোকেই করতে হবে। বর্তমানে তিনি তাঁর কর্মকাণ্ড দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল ছাড়াই সম্ভবত দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। ৬০-এর দশকে আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তারপর '৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার নির্দিষ্ট চিন্তা ও দর্শন বিকশিত হয়। '৭১ সালে তিনি ছিলেন লন্ডনে, সেখানে এফআরসিএস করছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধ তার একাডেমিক ক্যারিয়ার সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়। '৭১ সালে মে মাসে তাঁর এফআরসিএস ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। এর আগে প্রাথমিক এফআরসিএস পাস করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা- যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়েই তিনি এবং তাঁর কয়েকজন বিশিষ্ট চিকিৎসক বন্ধু লন্ডন থেকে ভারত হয়ে সেক্টর টু-তে যোগ দেন। তারা সবাই সার্জন ছিলেন। তারাই যুদ্ধক্ষেত্রে মেডিকাল কোর এর দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা এবং নার্সিং ও অন্যান্য চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য তারা বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করেন। যুদ্ধের সময় ফিল্ড হাসপাতালের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এই ফিল্ড হাসপাতাল এবং দরিদ্র জনগণের স্বাস্থ্যসেবার ধারণা থেকে জন্ম হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ, যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তী ঘটনাবলী সম্পর্কে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নিজস্ব একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে এবং সে দৃষ্টিভঙ্গিকে দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করে তিনি বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছেন। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে: ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ আর্মি ক্র্যাকডাউন হলে লন্ডনে আমরা সক্রিয় হয়ে উঠি। আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম যে, আন্দোলনটা এখন স্বাধীনতাযুদ্ধের দিকে মোড় নিচ্ছে। তাই আমরা লন্ডনে আবু সঈদ চৌধুরীকে নিয়ে স্বাধীনতার জন্য কাজ শুরু করে নেই। আমরা যারা চিকিৎসক ছিলাম, তার অনুভব করলাম যে, যুদ্ধ শুরু হলে আহতদের চিকিৎসা করতে হবে। তাই আমরা লন্ডনে প্রবাসী বাঙালীদের সংগঠিত করতে শুরু করি। ইতিমধ্যে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এবং আমরা বেশ কয়েকজন সার্জন লন্ডন থেকে ভারতে চলে আসি। ভারতে এসে আমরা সীমান্ত অঞ্চলে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করি।
লন্ডন থেকে যখন আসি, তখন মনে হচ্ছিল ভয়ানক যুদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু পৌঁছে দেখি নেতারা নিস্তেজ, নিশ্চুপ, যেন ঘুমাচ্ছেন। নেতাদের দেখে যুদ্ধের কোনো আলামতই টের পেলাম না। কিন্তু যখন ফ্রন্টে গেলাম, তখন দেখলাম সত্যি ভয়াবহ যুদ্ধ হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন, জীবন দিচ্ছেন, আহত হয়ে ছটফট করছেন। অনেক নেতারা তা জানেন না। দেখলাম যোদ্ধা ও নেতাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।
যুদ্ধের সময় অধিকাংশ নেতা এমনকি আওয়ামী লীগের ছেলেদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে শুরু হয়। অবশ্য গোড়া থেকে ভারতের একটা সচেতন প্রচেষ্টা ছিল যে, যাতে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী না হয়। এ কারণে নেতাদের তাঁরা অনেকটা আটকে রাখে। এমনকি প্রথমদিকে আমাকেও আগরতলায় যেতে দেয়নি এবং নিরস্ত্র করারও চেষ্টা করেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম যুদ্ধটা তো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তরুণদের এই আবেগ জাতি গঠনমূলক কাজে লাগাতে না পারলে এই আবেগের আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটবে, যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। সেজন্য আমি বলেছিলাম, সব শেষ হওয়ার পর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক বছর বন্ধ রাখতে হবে। যে মুক্তিযোদ্ধা মেঘনা ব্রিজ উড়িয়েছে, তাকেই বলতে হবে এই ব্রিজ পুনর্নির্মাণ কর। তখন সে তার সহযোগীদের নিয়ে এসব কাজ করবে এবং রাতে পড়াশোনা করবে এবং অন্যদের করাবে। তখন সে বুঝবে ভাঙাটা অনেক সহজ। কিন্তু গড়াটা খুবই কঠিন। তারপর শুরু হবে বৃহত্তর সংগ্রাম- অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। আমার এসব কথার উত্তর সেদিন তাজউদ্দিন সাহেব বলেছিলেন, ছেলেদের বয়স বেড়ে গেছে, তাদের তাড়াতাড়ি লেখাপড়া শেষ করতে হবে। কিন্তু শেষতক তাড়াতাড়ি লেখাপড়া শেষ করার ফল এই হলো যে, পুলিশ দিয়েও নকল ঠেকানো যায় না। নেতারা আরো বলেছিলেন, ছাত্রদের তো ন'মাস সময় নষ্ট হয়ে গেছে। আর সময় নষ্ট করা বাঞ্ছনীয় নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধকে তিনি সময় নষ্ট বলেছিলেন। এদিকে দ্রুত লেখাপড়া শেষ করার পরিণতি হলো যে, যে কোনদিন স্কুলে যায়নি, সেও পাশ করে গেল।
যুদ্ধ ফেরত
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার মতো করে নির্দিষ্ট একটি পথ বেছে নিয়েছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনাকে সামনে নিয়ে দরিদ্র মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের মৌলিক আকাঙ্ক্ষাকে তিনি ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামান্য হলেও সাধ্যমতো অনুধাবন করার অবকাশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বললেন: আমি এবং আমার যুদ্ধকালীন ফিল্ড হাসপাতালের বন্ধুরা মিলে আমাদের চিন্তা, উপলব্ধিকে বিকাশ ঘটানোর জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করি। এটা ছিল যুদ্ধকালীন ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট বাংলাদেশ হাসপাতালের অপর রূপ। আমাদের তখন লক্ষ্য ছিল, যুদ্ধ পরবর্তী জনসাধারণের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো। আমি যুদ্ধের পর আর্মির সার্জন ছিলাম। অনেক যুদ্ধাহত আর্মিকে অস্ত্রপচার করেছি।
সত্যি কথা বলতে কি আমরা প্রথমে দৈহিক স্বাস্থ্যের উন্নতির কথাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা দেখলাম দৈহিক স্বাস্থ্য জাতীয় বৃহত্তর স্বাস্থ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই আমরা পরবর্তিতে অন্যান্য কর্মসূচী হাতে নেই। জিএনপি দিয়ে জাতির স্বাস্থ্য বুঝা যাবে না। জনগণের স্বাস্থ্যের অবস্থাই নিরুপণ করে জাতির স্বাস্থ্যের অবস্থা। এ লক্ষ্যেই আমরা কাজ শুরু করি। এখনও এটা পাইলট প্রজেক্ট।
দরিদ্র জনগণের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে জাতির ভাগ্য। এ জাতির বেঁচে থাকার সব মৌলিক উপাদানই এদেশে আছে। সুষ্ঠু বণ্টন হলে জাতির প্রতিটি লোকের মৌলিক চাহিদা মিটবে। যদিও বিলাস জীবন-যাপন হবে না। তবে গৌরব নিয়ে বাঁচা যাবে। অনেকে বলে বাঙালী কর্মবিমুখ। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের জনগণ কর্মবিমুখ নয়, বরং বলা যেতে পারে তাদের কজের অভাব রয়েছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সম্পর্কে অনেকে বলেন, বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগেই সাভারে ১শ' ২০ বিঘা জমির ওপর একটি সমাজতান্ত্রিক কাঠামো কায়েম হয়েছে। যেখানে প্রতিষ্ঠানের সবাই একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন, একসঙ্গে এক টেবিলে একই ধরনের খাওয়া-দাওয়া করেন, কোনো ভেদাভেদ নেই, সেখনে সবাই কর্মী। অফিসার কিংবা বস বস ভাবের কোনো অবকাশ সেখানে নেই। শত শত কর্মী কাজ করছেন একই পরিবারের সদস্য হিসেবে। যারা সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, তাদের অনেকেই সেখানে থাকতে গেলে অসুবিধায় পড়বেন। কারণ আরামে শহরে ভদ্রজীবন করে সমাজতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করা, আর একটি নির্দিষ্ট কাঠামোয় সমাজতন্ত্রের মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন-যাপন করা কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে মন-মানসিকতার শ্রেণীচ্যুত না হলে।
দূরে থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সম্পর্কে অনেক সন্দেহ ও বিতর্কের অবকাশ আছে। ভেতরে না গিয়ে সবকিছু চোখে না দেখলে গণস্বাস্থ্যের সঠিক অবস্থান বা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তত্ত্বজ্ঞতভাবে এর অনেক বিরূপ সমালোচনা করা বা উল্লেখ করা যায় অনেক সীমাবদ্ধতার- কিন্তু যে কর্মকান্ড সেখানে হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে পর্যবেক্ষণ করার মত। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২২ মাইল দূরে সাভারের লাল মাটির উঁচু-নিচু প্রান্তরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয় মাত্র ৫ বিঘা জমি নিয়ে। এই জমিও দান করেন ডা. লুৎফর রহমান ও তৎকালীন পে-কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুর রব। তখন কাঁঠাল গাছের নিচে বসতো ক্লিনিক। সপ্তাহে একদিন ঢাকা থেকে ডাক্তারসহ কর্মীরা আসতেন। গ্রামের লোকজন চিকিৎসা এবং ওষুধ পেতেন। কিন্তু এখন সে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিস্তার ঘটেছে ১২০ বিঘা জমি নিয়ে। নির্মিত হয়েছে অফিস ও আবাসিক ভবন, সৃষ্টি হয়েছে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিসহ বহু ইনকাম জেনেরেটিং প্রকল্প, কাজ করছেন শত শত কর্মী।
বর্তমানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আওতায় মোট প্রকল্পের সংখ্যা ২২টি। সাভারস্থ কেন্দ্রে হয়েছে ১৪টির মতো প্রকল্প। এর মধ্যে রয়েছে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, মাসিক গণস্বাস্থ্য, গণপ্রকাশনী, গণমুদ্রণ, গণপাঠশালা, গণকৃষি খামার, নারী কেন্দ্র, গণস্বাস্থ্য বেকারী, গণস্বাস্থ্য জুট প্লাস্টিক, গণপাদুকা, গণকাঠ কারখানা, গণপ্রচারণা ও গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সাধারণ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রকল্পের প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়। এ সম্পর্কে গণস্বাস্থ্যের পরিচালক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রযুক্তির উন্নয়ন ছাড়া দেশের লোকজনের ভাগ্যের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি বিদ্যা অর্থাৎ বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এখানে ভূমিহীনদের ছেলেমেয়েই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার সাথে তারা যদি বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, তাহলে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে এবং অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে সক্ষম হবে। তাই আমরা স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও সাধারণ শিক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।
গণস্বাস্থ্য একটি পাবলিক ট্রাস্ট। কোনো ব্যক্তি এর মালিক নন। সাধারণ গরীব মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য ও সচেতনতা বৃদ্ধি করাই এর লক্ষ্য। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পের সমন্বয়কারী এবং আর দশজনের মত তিনিও এখানে একজন কর্মী হিসেবে দাবি করেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এখানে সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
গণস্বাস্থ্যের মহিলা কর্মী
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের শতকরা ৭৫ ভাগই হচ্ছে মহিলা কর্মী এবং বিভিন্ন প্রকল্পে যারা কাজ করছেন, তাদের অধিকাংশই স্থানীয় ভূমিহীনদের ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী। দেশে লাখ লাখ বেকার ছেলে থাকতে কেন বেশি করে মহিলাদের কর্মসংস্থান করা হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে ডা. জাফরুল্লাহর বক্তব্য হচ্ছে: আমাদের দেশে মহিলারাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। যেহেতু প্রতিবাদ করার মত শিক্ষা নেই, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত কর্মসংস্থানের সন্ধান জানা নেই; তাই তাদের মুখ বুজে নির্যাতন সইতে হয়। আমরা এ কারণেই মহিলাদের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। মহিলারা শিক্ষিত হলে, কাজ করে নিজের ভাগ্যকে গড়ে তুলতে সক্ষম হলে আর নির্যাতনের সম্মুখীন হবেন না। কারণ তারা প্রতিবাদ করতে শিখবে এবং স্বামী ইচ্ছা করলেই স্ত্রীকে যেন-তেনভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। এছাড়া মেয়েরা শিক্ষিত হলে শিশুরা শিক্ষিত হবে এবং পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টি গুরুত্বের সহকারে বিবেচনা করতে শিখবে এবং কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করবেন। আমরা এ ব্যাপারে প্রচুর সুফল পেয়েছি।
প্রশিক্ষণ প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা
বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রকল্প যেমন, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী তৈরি, কাঠের আসবাবপত্র তৈরি, লোহা, রড ও কাঠ দিয়ে চেয়ার টেবিল তৈরি ইত্যাদি। এসব প্রকল্পে ভূমিহীনদের স্ত্রী-ছেলেমেয়ে কাজ করে। এদের মধ্যে অনেকে মাসিক বেতনে কাজ করে এবং অনেক মেয়ে আছে যারা স্কুলে পড়ে; কিন্তু ছুটির দিনে কাজ করে। স্কুলে পড়া যে মেয়েটি ছুটির দিনে কাজ করে, সে একদিনের কাজের জন্য ১০ টাকা পায়—যা তার ব্যক্তিগত একাউন্টে জমা হয়। ঐ অর্থ দিয়ে মেয়েটি তার স্কুলের যাবতীয় খরচ বহন করে। এক্ষেত্রে তার ভূমিহীন পিতার কোনো অসুবিধারই সম্মুখীন হতে হয় না। এছাড়া গণস্বাস্থ্য পাঠশালার ছোট ছোট ছেলেরাও সপ্তাহে দুদিন দুই ঘণ্টা করে কাজ করে এবং এ থেকে তারা দু'টাকা উপার্জন করে। এ টাকাও তাদের ব্যক্তিগত একাউন্টে জমা হয় এবং কোনো উৎসব বা পার্বণে তাদের পিতা-মাতা জমানো টাকা তুলে ভালো কিছু একটা করেন।
মহিলা কর্মীদের দক্ষতা
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পে যেসব মহিলা কাজ করেন, তাদের কাজের দক্ষতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাদের শক্তিকে নিষ্ক্রিয় রেখে কোনো উন্নয়নই সম্ভব নয়। সেদিকে দৃষ্টি রেখে এবং গণস্বাস্থ্যে মহিলাদের কাজের দক্ষতা দেখে এটাই মনে হয়েছে, এই নারী শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। গণস্বাস্থ্যে মহিলারা রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছেন, কাঠ দিয়ে চমৎকার আসবাবপত্র তৈরি করছেন, কঠোর শ্রমসাধ্য ওয়েল্ডিং-এর কাজ করছেন, গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের জন্য কৌটা তৈরি করছেন। ফাইবার গ্লাসের চেয়ার টেবিল টুপি তৈরি করছেন। আর এসব তারা করছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। এ সমস্ত কাজের একজন মহিলা কর্মী মাসে চারশো টাকা আয় করেন। অবশ্য এর থেকে খাওয়া বাবদ ২৬ টাকা কেটে রাখা হয়। প্রতিটি কর্মীকে দুপুরের খাবার সরবরাহ করা হয়।
শ্রেণী বৈষম্যহীন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মচারী, কর্মকর্তা, শ্রমিক-এ শব্দগুলো অপরিচিত। এখানে সবাই কর্মী। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডা. জাফরুল্লাহ থেকে শুরু করে সবাই একই ডাইনিং টেবিলে একই খাবার খান। কেউ ইচ্ছা করলেই সেখানে ভালো কিছু খেতে পারেন না। মেস কমিটি প্রতিদিনকার খাবারের মেন্যু তৈরি করেন এবং তার ব্যতিক্রম কেউ করতে পারেন না। এখানে যারা আবাসিক, তাদের কক্ষ নির্ধারণ হয় প্রয়োজন অনুপাতে। একজন হয়তো গাড়ি চালান—তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা যদি বেশি হয় তাহলে তার জন্য বরাদ্দ হবে তিনটি কক্ষ এবং অপরদিকে একজন সমন্বয়কারী তার পরিবার ছোট হলে, তাকে দুটি কক্ষই বরাদ্দ করা হবে। কোনরকম পক্ষপাতিত্ব বা শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টি করার কোন অবকাশ নেই। এর ফলে কোনো কর্মীই এখানে হীনমন্যতায় ভোগেন না।
স্বাস্থ্য বীমা ও স্বাস্থ্য কর্মী
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আছে ২২ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল। স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা করা হয়। এজন্য স্বাস্থ্য বীমার প্রবর্তন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বীমার ব্যাপারে গ্রামবাসীদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যে পরিবার বছরের কোনো না কোনো সময়ে দু'বেলা পুরো খেতে পায় না তারা 'ক' দলভুক্ত। তারা ৫০ পয়সার বিনিময়ে সব ধরনের চিকিৎসা পেয়ে থাকেন। এ সঙ্গে পান উপদেশ, ওষুধ, রক্ত-কফ পরীক্ষা, এক্স-রে সবকিছুই। এদের কাছ থেকে একদম পয়সা না নেয়া সম্পর্কে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্য হচ্ছে: 'ক' দলের লোকেরা ভূমিহীন। তারা যাতে কোনোক্রমেই বুঝতে না পারে যে তারা করুণার বস্তু, তাই কিছু না কিছু পয়সা নেয়া হয়। পয়সা না নিলে তা করুণার ব্যাপার হতে পারে এবং ভূমিহীনদের জন্য এটা অসম্মানজনক হবে।
যাদের জীবনে অনাহারের জ্বালা নেই, অথচ উদ্বৃত্তও নেই, তারা 'খ' দলভুক্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। স্বাস্থ্য বীমার জন্য তাদেরকে বছরে একবার দশ টাকা দিতে হয় এবং তারা প্রতিবার চিকিৎসার জন্য জনপ্রতি দু'টাকা দিয়ে উপদেশ ও ওষুধ পাবেন। রক্ত, পায়খানা-প্রস্রাব ইত্যাদি পরীক্ষার জন্যও আলাদা টাকা দিতে হবে।
সারা বছর খেয়েদেয়ে যাদের উদ্বৃত্ত থাকে তারা ধনী এবং 'গ' দলভুক্ত। ধনী জোতদার, ব্যবসায়ী, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পরিবার 'গ' এর আওতায় পড়ে। 'গ' ভুক্তদের স্বাস্থ্য বীমার জন্য বছরে এককালীন চাঁদা ২০ টাকা এবং প্রতিবার পরামর্শ ও চিকিৎসার জন্য পাঁচ টাকা দিতে হয়। অন্যান্য ধরনের পরীক্ষার জন্য 'খ' গ্রুপের চেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়। বর্তমানে ব্যাপকভাবে জীবন বীমা করানোর চেষ্টা চলছে।
এখানে স্বাস্থ্য কর্মীদের ভূমিকা খুব ব্যাপক। তারা গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে পরিবার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিষয়ক সব ধরনের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। অধিকাংশ স্বাস্থ্য কর্মীই মহিলা। তাদের সাইকেল চালনা শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সাইকেলে করেই তারা গ্রামে ঘরে ঘুরে কাজ করেন। প্রথমদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামী ও কুসংস্কারের মুখোমুখি হয়ে তাদের অপ্রীতিকর ঘটনায় পড়তে হয়েছে। কখনো কখনো মহিলা কর্মীদের গ্রামবাসীর ধর্মের দোহাই দিয়ে আটকেও রেখেছে। কিন্তু এখন আর সে পরিস্থিতি নেই। গ্রামবাসীরা উপকৃত হচ্ছেন। সময়ে অসময়ে তারা কর্মীদের ডেকে সমস্যার কথা বলছেন।
গণস্বাস্থ্যের সকল কর্মীদের প্রতিদিন এক থেকে দেড় ঘন্টা কৃষি কাজ করতে হয়। ভোরে কৃষি কাজ সমাপনের পর নাস্তা সেরে সকাল ৯টার সময় যে যার নির্ধারিত কাজে চলে যান। কেউ গ্রামে, কেউ অফিসে, কেউবা অন্য কোনো কাজে যান। এখানে সবসময় কর্মতৎপরতা চলছে। দুপুরে অফিস শেষে রুটিন অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষিতা মেয়েকেই বিকালে গ্রামে যেতে হয় গ্রামের মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য।
কৃষি প্রকল্প
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কৃষি প্রকল্পটির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। এই কৃষি প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের ঋণদান করা হয়। তবে সব কৃষকই ঋণ পান না। যাদের দেড় একরের চেয়ে বেশি জমি নেই তাদের ঋণ দেয়া হয়। ভূমিহীনদের অগ্রাধিকার। কম জমি হলেও ঋণ দেয়া হয়। ঋণের পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা, সুদের হার মাসিক শতকরা চার টাকা। এই চার টাকার মধ্যে দুই টাকা গণস্বাস্থ্যের নিজস্ব এবং বাকি দুই টাকা কৃষকদের জন্যই তাদের নামে জমা রাখা হয়। গণস্বাস্থ্যের দুই টাকা সমবায়ীদের নিজ তহবিলে পরবর্তীতে জমা করা হয়। অপরদিকে ভূমিহীনদেরও ঋণ দেয়া হয়। কাঁচামালের এবং অন্যান্য ছোট ছোট ব্যবসা যারা করেন তারাই এ ঋণ পান। ঋণ দেয়ার ব্যাপারে কোনো গ্যারান্টি নেয়া হয় না। অথচ ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এখনো কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। ঋণগ্রহিতারা ঠিক মতোই ঋণ পরিশোধ করছেন।
গণস্বাস্থ্যের কর্মী ও বেতন কাঠামো
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় ছ'শ কর্মী কজ করেন। প্রশিক্ষণ কর্মীরা মাসিক ৪শ টাকা ভাতা পান। কাজের দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বেতনের তারতম্য কমিয়ে আনা হচ্ছে বলে প্রশাসনের একজন জানিয়েছেন। বর্তমানে তিন ধরনের বেতনের হার প্রচলিত (ক) মাসিক ছ'শ' টাকা থেকে দুই হাজার টাকা (খ) ১৫শ' টাকা থেকে ২৫শ' টাকা (গ) ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা।
গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অন্যতম প্রকল্প হচ্ছে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল। বর্তমানে এই ফার্মাসিউটিক্যাল বাংলাদেশের মোট ওষুধ চাহিদার শতকরা ৭ ভাগ পূরণ করে। তবে কতক এন্টিবায়োটিকসের ক্ষেত্রে মোট চাহিদার ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ওষুধ সরবরাহ করে। বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্যই প্রথম ডায়রিয়ার লবণ জলের প্রচলন করে। বর্তমানে বাজারে লবণজলের মোট সরবরাহের শতকরা ৭০ ভাগ চাহিদা তারা মেটাচ্ছে তারা। তবে চাহিদা অনুসারে এ পরিমাণ অত্যন্ত অপ্রতুল। নতুন মেশিন এসে গেছে। উৎপাদন শুরু হলে তা বেড়ে চার গুণ বৃদ্ধি পাবে।
গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল বর্তমানে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখানে ওষুধের গুণগতমান রক্ষা করা হয় যত্নের সাথে। 'বাংলাদেশে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ' শীর্ষক ড্যানিশ একটি মিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্থানীয় কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানির কোনো মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নেই। একমাত্র গ্লাক্সো ও গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি রয়েছে এবং গণস্বাস্থ্য পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সুসজ্জিত।