মার্সেনারি নাগা সাধু; যিনি ব্রিটিশদের ভারত দখলে সাহায্য করেন
তাকে উপস্থাপন করা হয় ভয়ানক সেনাপতি হিসেবে। নেতৃত্ব দিতেন একটি মাথায় জটাধারী সৈন্যদের একটি ব্যক্তিগত বাহিনী। তারা ছিলেন অশ্বারোহী ও পদাতিক নগ্ন যোদ্ধা। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে থাকত কামান।
তবে এর সঙ্গে অনুপগিরি গোঁসাই সন্ন্যাসী বা নাগা সাধুও ছিলেন। তিনি ছিলেন হিন্দু দেবতা শিবের ভক্ত। এই জটাধারী সাধুরা ভারতে অত্যন্ত সম্মানিত। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় উতসব কুম্ভ মেলায় প্রায়ই দেখা যায় তাদেরকে।
'ওয়ারিয়র অ্যাসেটিকস অ্যান্ড ইন্ডিয়ান এম্পায়ারস'-এর লেখক উইলিয়াম আর পিঞ্চের তথ্যমতে, অনুপগিরি গোঁসাই ছিলেন 'যোদ্ধা সন্ন্যাসী'। 'ভয়ানক ও দুর্দমনীয়' স্বভাবের জন্য নাগারা বিশেষভাবে পরিচিত। কানেকটিকাটের ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ পিঞ্চ বলেন, নাগারা 'অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত', পাশাপাশি 'দুর্দান্ত অশ্বারোহী ও পদাতিক সেনা'।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা জেমস স্কিনার ১৯ শতকের গোড়ার দিকে একজন নাগা সৈনিকের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। ওই ছবিতে একজন পুরুষকে চিত্রিত করা হয়েছে। তার পা খালি, পরনে কেবল একটি চামড়ার বেল্ট। ওই বেল্টে বাঁকানো তলোয়ার, বারুদ, গোলাবারুদ ও চকমকি পাথর রাখা। তার চুল ঘন, এলোমেলো চুল খোঁপার মতো করে জটাবাঁধা—দেখে মনে হয় হেলমেট যেন। বাম হাতে একটি দীর্ঘ ব্যারেলযুক্ত মাস্কেট আঁকড়ে ধরে রেখেন, কপালে একটি সিঁদুরের তিলক।
পিঞ্চ বিবিসিকে বলেন, হঠাৎ চমকে দেওয়া সৈন্য হিসেবে এবং খুব কাছ থেকে হাতাহাতি যুদ্ধে নাগাদের বেশ সুনাম ছিল। অনুপগিরির অধীনে তারা একটি পূর্ণাঙ্গ পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীতে পরিণত হয়েছিলেন। সেরা সৈন্যদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সক্ষমতা ছিল তাদের।
১৭০০-র দশকের শেষের দিকে অনুপগিরি ও তার ভাই উমরাওগিরি ২০ হাজারের বেশি পুরুষ নাগা সৈন্যের নেতৃত্ব দিতেন। ১৮ শতকের শেষের দিকে কামান ও রকেট বহনকারী সাধু সৈন্যদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।
লেখক ও ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ড্যালরিম্পল অনুপগিরিকে একজন 'ভয়ঙ্কর নাগা সেনাপতি' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মোগলরা তাকে হিম্মত বাহাদুর উপাধি দিয়েছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতে এর আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস নিয়ে লেখা বই 'দি অ্যানার্কি'তে ড্যালরিম্পল মোগল সেনাপতি মির্জা নাজাফ খানের সৈন্যদের সঙ্গে 'অনুপগিরি গোঁসাইয়ের জটাধারী নাগাদের' যোগ দেওয়ার কথা লিখেছেন। ৬ হাজার নগ্ন সৈন্য ও ৪০টি কামান নিয়ে তিনি মোগল সেনাদলে যোগ দেন।
এ বইয়ে অনুপগিরির সম্পর্কে আরও লেখা হয়েছে, তার অধীনে ছিল ১০ হাজার পদাতিক ও অশ্বারোহী গোঁসাই (সাধুদের এ নামে ডাকা হয়)। সেইসঙ্গে তার ছিল পাঁচটি কামান; রসদ, তাঁবু ও ১২ লাখ রুপিভর্তি (২০১৯ সালের হিসাবে প্রায় ১৬ মিলিয়ন ডলার) অগুনতি গরুর গাড়ি।
রহস্যময় চরিত্রের অধিকারী অনুপগিরিকে ১৮ শতকের শেষের দিকে সম্ভাব্য সফলতম 'সামরিক উদ্যোক্তা' বা মার্সেনারি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কথায় ভুল নেই। ওই সময় রাজাদের অধীনে কাজ করা সেনাদলগুলোর অধিকাংশই ভাড়াটে ছিল।
বেনারসের (বর্তমান বারানসি) বিচারক টমাস ব্রুক লিখেছিলেন, 'অনুপগিরির স্বদেশী এক লোক বলেছিলেন, তিনি এমন এক মানুষ, যিনি দুই নৌকায় পা রেখে নদী পাড়ি দিচ্ছেন। যে নৌকা ডুবে যাবে, সেটি ত্যাগ করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতেন অনুপগিরি।'
স্বাভাবিকভাবেই এই ক্যারিশম্যাটিক সন্ন্যাসী যোদ্ধার উপস্থিতি ছিল সর্বত্র। পিঞ্চ লিখেছেন, সবারই অনুপগিরিকে দরকার ছিল। তাই তার উপস্থিতি ছিল সর্বত্র। সৈন্যের দরকার পড়লে কিংবা কারও সঙ্গে দরকষাকষির প্রয়োজন পড়লেই ডাক পড়ত তার। দরকষাকষিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ।
অনুপগিরি সবার হয়েই যুদ্ধ করতেন। ১৭৬১ সালে পানিপাতের যুদ্ধে তিনি মোগল সম্রাট এবং আফগানদের পক্ষে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এর তিন বছর পর তিনি বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মোগল বাহিনীর সঙ্গে হাজির ছিলেন। দিল্লিতে পারস্য অভিযাত্রী নাজাফ খানের উত্থানেও অনুপগিরি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
পরে অনুপগিরি ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগ দেন। ১৮০৩ সালে, জীবনের শেষ দিকে, মারাঠাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয়ে এবং ব্রিটিশদের দিল্লি দখলে সাহায্য করেন তিনি। এ বিজয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী শাসকে পরিণত করে।
পিঞ্চ বলেন, ১৮ শতকের শেষের দিকে মোগল ও মারাঠার পতন এবং সেইসঙ্গে ব্রিটিশ শক্তির উত্থানের ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতাগুলো খুঁটিয়ে দেখা হলে, এসবের পেছনে অনুপগিরির একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা চোখে পড়বে
অনুপগিরি গোঁসাইয়ের জন্ম ১৭৩৪ সালে, উত্তর ভারতের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ বুন্দেলখণ্ডে। পিতার মৃত্যুর পর তার দরিদ্র বিধবা মা অনুপগিরি ও তার বড় ভাইকে একজন সেনাপতির হাতে তুলে দেন।
মুখে মুখে প্রচলিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, অনুপগিরির মতো পুরুষদেরকে ১৬ শতকে মুসলমানদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অস্ত্রধারণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মোগল সম্রাট শাহ আলমসহ আরও বেশ কয়েকজন মুসলিম শাসককে সেবা দিয়েছেন। এমনকি আফগান রাজা আহমেদ শাহ আবদালির পক্ষে ১৭৬১ সালে পানিপাতে মারাঠাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেন। অনুপগিরিকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন কবিতায় তার দলের মুসলিম সৈন্যদের কথা উঠে এসেছে।
পিঞ্চ বলেন, অনুপগিরি বনেদি বংশের সন্তান ছিলেন না। তবে তিনি জানতেন কখন কীভাবে লড়াই করতে হয় আর কখন রণক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে হয়। তিনি জানতেন শত্রু ও মিত্র উভয়পক্ষকে কী করে বোঝাতে হয় যে তার হারানোর কিছু নেই। লোকের ধারণা ছিল, তার মতো নাগা সাধুরা মৃত্যুকে জয় করে ফেলেছেন। তাই সাধারণ মানুষ তাদের ভয় পেত।
বক্সারের যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে বাংলা ও বিহারে ব্রিটিশ শক্তির দখল নিশ্চিত হয়। ড্যালরিম্পল লিখেছেন, বক্সারের যুদ্ধে অনুপগিরির উরুতে মারাত্মক জখম হয়। তিনি ওই যুদ্ধে অবধের গভর্নর সুজা-উদ-দৌলাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে প্ররোচিত করেন। তিনি বলেন, 'এখন অলাভজনক মৃত্যুর সময় নয়। অন্য একদিন আমরা জিতে প্রতিশোধ নেব।'
নৌকা দিয়ে বানানো সেতুর ওপর দিয়ে নদী পার হন তারা। নদী পেরোনোর পর অনুপগিরি নৌকা-সেতু ধ্বংস করে ফেলতে নির্দেশ দেন। এতে অনেক সন্ন্যাসী যোদ্ধার প্রাণ বেঁচে যায়।
- সূত্র: বিবিসি