রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দক্ষিণ এশীয়রা কেন অংশ নিচ্ছেন?
লোভনীয় বেতন এবং সুবিধার প্রতিশ্রুতি থেকে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণরা রুশ আর্মিতে যোগ দান করেছেন। কিন্তু এখন তাদেরকে ঠিকভাবে বেতন দেওয়া হচ্ছে না, অনেকেই সম্মুখ যুদ্ধে মারা যাচ্ছেন এবং পালাবার পথে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে পাহাড়সম বাঁধা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিদেশি যোদ্ধারা কোন দেশ থেকে এসেছেন?
ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী লোক অংশ নিচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা থেকে।
২০২২ সালের মার্চ মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রুশ সেনাবাহিনীতে বিদেশিদের অংশগ্রহণের পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানান। পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন, রাশিয়া এখন সিরিয়া থেকে সৈন্য নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। নেপালের একজন ভাড়াটে সৈন্য আল জাজিরাকে বলেছেন, নেপালি, তাজিক এবং আফগান যোদ্ধাদের সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতে পাঠানো হয়।
রাশিয়াতে ঠিক কতজন নেপালি সেনা আছেন তার সঠিক তথ্য নেপাল সরকারের কাছে নেই। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ধারণা করছেন, ২০২৩ সালের শেষের দিকে দুই শতাধিক নেপালি রুশদের হয়ে যুদ্ধ করেছেন।
কিছু বিশ্লেষক ধারণা করছেন, প্রায় ১ হাজার নেপালি সেনা রাশিয়াতে নিয়োগ করা হয়েছে। নেপালের ইন্সটিটিউট ফর পলিসি রিসার্চের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দেওয়া নিয়োগপ্রাপ্ত সৈন্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের দেওয়া অভিযোগের ওপর ভিত্তি করেই এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হচ্ছে।
ভারতের স্থানীয় এক সংবাদপত্র জানিয়েছে, অনানুষ্ঠানিকভাবে উইক্রেনে লড়াই করা ভারতীয়দের সংখ্যা প্রায় ১০০ জনের মতো।
রাশিয়াতে বাস করা বেশ কয়েকজন শ্রীলংকান আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, তাদের শতাধিক স্বদেশী রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে।
কেন দক্ষিণ এশীয়রা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন?
যুদ্ধে অংশ নেওয়া অনেকেই আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, তারা অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন। নেপালের ৩২ বছর বয়সী ভাড়াটে সৈন্য বিমল ভাণ্ডারি বলেন, "আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব বাজে হওয়ায় আমি ভেবেছিলাম এর মাধ্যমে আমাদের অভাব দূর করা সম্ভব হবে।"
শ্রীলংকার লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং কলামিস্ট গামিনী ভিয়ানগোদা বলেন, রুশদের প্রতি সমর্থন থেকে শ্রীলংকানরা যুদ্ধে যাচ্ছে না। বরং তারা এটিকে অর্থনৈতিক মুক্তি ও অর্থ উপার্জনের পন্থা হিসেবে দেখছে।
২০২২ সালের অর্থনৈতিক মন্দা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য ২০২৩ সালে শ্রীলংকাতে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ এবং ক্রমবর্ধমান মন্দার জন্য জ্বালানি, ওষুধ এবং খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল।
শ্রীলংকার অবসরপ্রাপ্ত সেনা এবং বর্তমানে রুশ বাহিনীতে নিয়োজিত একজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে আল জাজিরাকে বলেছেন, দেশের অর্থনৈতিক কষ্ট সহ্য করার থেকে রুশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া তার কাছে আরো সহজ মনে হয়েছে।
শ্রীলংকার সেনাবাহিনীতে কাজ করা সেনারা এখন অধীর হয়ে আছেন রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য। একজন সৈন্য আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, তিনি কর বাদ দিয়ে মাসে মাত্র ৬৫ মার্কিন ডলার উপার্জন করতে পারে।
পোড়েল বলেছেন, নেপালিদের মধ্যে লোভনীয় উপার্জনের আশায় মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ যাওয়ার চল আছে কারণ "নেপালের গড় মাথাপিছু আয় বছরে মাত্র ১ হাজার মার্কিন ডলার। তার বিপরীতে রুশ বাহিনীতে যোগ দিলে তাদের আয় দাঁড়ায় (বিজ্ঞাপনে যেটি বলা হয়) মাসে ৪ হাজার মার্কিন ডলার যেটি অনেক।"
তিনি আরো বলেন, "তাদের প্রত্যেকেই বিজ্ঞাপনে দেখানো বেতন না পেলেও তারা যতটুকু অর্থ পাচ্ছে সেটি তারা যা পেত তার থেকে বেশী।"
তারা কোন পক্ষের হয়ে যুদ্ধ করছেন?
অধিকাংশ দক্ষিণ এশীয় সৈন্য রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করছেন।
কিন্তু কিছু শ্রীলংকান সেনা ইউক্রেনের হয়েও যুদ্ধ করেছেন। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা তিনজন শ্রীলংকানের মৃত্যুর পর ইন্টারন্যাশনাল লিজিওন অব টেরিটোরিয়াল ডিফেন্স অব ইউক্রেনের সাথে যুক্ত থাকা ২০ জন শ্রীলংকান ইউনিট ত্যাগ করেছেন। বর্তমানে ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধ করা একমাত্র শ্রীলংকান লাহিরু হাতুরুসিংহে এ তথ্য জানিয়েছেন।
কীভাবে দক্ষিণ এশীয়দের যুদ্ধে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে?
ইউরোপে চাকরি খোঁজা দক্ষিণ এশীয়দের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নিয়োগ দেওয়া হয়। টিকটকে ভারত, ভারতীয় এবং শ্রীলংকানদের নিয়োগ সংক্রান্ত ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে।
নেপালিরা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, টিকটকের একাউন্টটির সাথে যোগাযোগ করার পরে তাদেরকে নেপালে একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালানো একজন দালালের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়। দুবাইয়ে থাকা ভারতীয় নাগরিক ফয়সাল খানের একটি ইউটিউব ভিডিও দেখে সুরাটের ২৩ বছর বয়সী হেমিল মাঙ্গুকিয়া রুশ বাহিনীতে সহায়তাকারী হিসেবে চাকরি পান।
রাশিয়ায় যেতে আগ্রহীদের কাছ থেকে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে নিয়োগ পাওয়া একজন নেপালির কাছ থেকে ৯ হাজার মার্কিন ডলার নেওয়া হয়েছে। বিনিময়ে তাকে বিভিন্ন সুবিধাসহ মাসে ৩ হাজার মার্কিন ডলারের চাকরি এবং রাশিয়াতে তিনি এবং তার পরিবারকে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
শ্রীলঙ্কানদেরও মাসে ৩ হাজার মার্কিন ডলারের চাকরি এবং রাশিয়ার নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
নয় বছর শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনীতে থাকা নিপুনা সিলভা যিনি ইতোমধ্যেই ঋণগ্রস্ত ছিলেন তিনি একটি এজেন্সিকে ধার করে ৪ হাজার মার্কিন ডলার দিয়ে রাশিয়ায় চাকরি পেয়েছিলেন। পরে তিনি রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
সুরাটের মাঙ্গুকিয়া দালালদের ৩ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার এবং তাকে সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য মাসে ১ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার দেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল।
ভান্ডারী রাশিয়ায় যাওয়ার পর তাকে একটি রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তিনি সৈনিক হিসাবে লড়াই করার জন্য এক বছরের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।
যখন অনেক নেপালি রাজধানী শহর কাঠমান্ডু থেকে সরাসরি রাশিয়া যাচ্ছিলেন তখন কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ার নিয়োগপ্রাপ্তদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হয়?
যদিও নিয়োগপ্রাপ্তদের তিন মাসের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এক মাসের মধ্যেই তাদের ইউক্রেন সীমান্তবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিম রাশিয়ার রোস্তভ অঞ্চলে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়।
পোড়েল বলেন, 'আমি মনে করি তারা খুব অল্প দিনের জন্য প্রশিক্ষণ পেয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে যেটি এক সপ্তাহও নয়। এবং তারপরে তাদের সম্মুখযুদ্ধে পাঠানো হয়েছে অগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে।"
প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে নেপালিদের ধারণা ছিল তাদেরকে বিকল্প সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
ভাণ্ডারি যখন পালানোর চেষ্টা করেন তখন তাকে ধরা হয় এবং আটক করা হয়। অন্য অনেকের মতো তিনি রাশিয়ার কঠোর নজরদারির জন্য ধরা পড়ে যান।
যখন মাঙ্গুকিয়ার মা-বাবাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে তাদের ছেলে যে কোনো লড়াই থেকে নিরাপদ থাকবে, তাকে সম্মুখযুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল।
শ্রীলঙ্কার সিলভা জানুয়ারিতে এক বছরের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখে তার স্ত্রীর কাছে রাশিয়া থেকে ১ হাজার ৬৪০ মার্কিন ডলার পাঠানো হয়। কয়েকদিন পরে তিনি জানতে পারেন, সিলভা একটি ড্রোন হামলায় মারা গেছে।
যুদ্ধে শ্রীলঙ্কার অন্তত পাঁচজন মারা গেছেন। কমপক্ষে ১২ জন নেপালি নিহত হয়েছেন এবং অন্য পাঁচজন ইউক্রেনের সৈন্যদের কাছে বন্দী হয়েছেন। যুদ্ধে অন্তত দুজন ভারতীয় নিহত হয়েছেন।
এর সমাধান কী?
নেপালি পুলিশ ইতোমধ্যেই গোপন তথ্যের ভিত্তিতে রাশিয়ায় মানবপাচারের সাথে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করেছে।
নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রুশ সরকারের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছে কারণ মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রত্যাবাসন এবং মৃতদেহ উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি মন্ত্রণালয় নিহতদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সাংবাদিকদের বলেছেন, ৮ মার্চ দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো "বিভিন্ন শহরে অনুসন্ধান পরিচালনা করে এবং অপরাধমূলক সামগ্রী সংগ্রহ করার মাধ্যমে একটি বড় মানবপাচার চক্রকে ধরেছে। একাধিক দালালের বিরুদ্ধে মানবপাচারের মামলা দায়ের করা হয়েছে।"
নয়াদিল্লি-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক আইনজীবী এবং গবেষক আকাশ চন্দ্রন আল জাজিরাকে বলেছেন, স্বেচ্ছায় রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া ভারতীয় নাগরিকদের প্রত্যাবাসন করার পাশাপাশি যাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল তাদেরকে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালানো উচিত ভারত সরকারের।
তিনি বলেছেন, যারা অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রতারিত হয়ে বা বাধ্য হয়ে বা সশস্ত্র পরিষেবা দিচ্ছেন তাদের জন্য স্বাক্ষরিত কোনো চুক্তি কার্যকর হয় না।
কিন্তু যারা স্বেচ্ছায় এক বছরের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন তাদের জন্য বিষয়টি একটু বেশি জটিল।
প্রশ্নটি আইনি থেকে বেশি কূটনৈতিক হয়ে ওঠে এবং নির্ভর করে রাষ্ট্র প্রত্যাবাসনের জন্য কতটা চেষ্টা করতে ইচ্ছুক তার উপর।
পোড়েল বলেছিলেন, প্রতিটি নেপালিকে ফিরিয়ে আনাও কঠিন কারণ তাদের মধ্যে কেউ কেউ "অবৈধ পথে রাশিয়া গেছে।"
তিনি যোগ করেন, নেপালি কর্তৃপক্ষের দ্বারা গৃহীত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ইউক্রেনের যুদ্ধে যোগদানকারী নেপালিদের সংখ্যা কমালেও এটি পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি।
পোড়েল বলেন, "আমি মনে করি যতদিন দেশে অর্থনৈতিক সুযোগ কম আছে ততদিন লোকেরা বিদেশে যেতে চাইবে, ভাল বেতন, ভাল চাকরি এবং একটি উন্নত জীবন চাইবে। এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। অতএব আমি মনে করি, দেশে দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ তৈরি করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়