ফুটবলবিশ্বকে মাত করেছিলেন এই উত্তর কোরিয়ান খেলোয়াড় – তারপর কেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন!
২০১৭ সালে হান কং সং প্রথম উত্তর কোরিয়ান হিসেবে ইউরোপের পাঁচটি প্রধান ফুটবল লিগের একটিতে গোল করেন এবং ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্টাসে যোগদানের মাধ্যমে সবাইকে চমকে দেন। পরবর্তীকালে জুভেন্টাস ছেড়ে কাতারের আল-দুহাইল ক্লাবে যোগ দেন হান।
কিন্তু ২০২০ সালে বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চ থেকে অপ্রত্যাশিত এবং রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যাওয়ায় তার ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে। হানের মতো একজন উদীয়মান প্রতিভা এভাবে হারিয়ে যাওয়ায় একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়: এই তরুণ উত্তর কোরিয়ান ফুটবলার এখন কোথায়?
একজন ইতালিয়ান ধারাভাষ্যকার হান কংকে বলেছিলেন 'দ্য লিটল নর্থ কোরিয়ান', যেহেতু কং খুব একটা লম্বা ছিলেন না; কিন্তু তার গতি, ট্যাকল করার দক্ষতা এবং গোলবারের সামনে চমৎকার হেডার ইউরোপের সেরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার যোগ্য ছিল। পিয়ংইয়ংয়ের এই তরুণ স্ট্রাইকার খুব শীঘ্রই সকার পণ্ডিত এবং ভক্তদের নজর কাড়েন — কেবল তার ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য নয়, বরং খেলার মাঠে তার পরাক্রমশীলতার জন্যও।
"শারীরিক গঠনে সে অতটা লম্বা-চওড়া ছিল না, কিন্তু খুব দ্রুত পজিশন নিতে পারত এবং খুব ভালো হেডার দিতে পারত", সিএনএন স্পোর্টসকে বলেন দক্ষিণ কোরিয়ান ফুটবল ধারাভাষ্যকার হান জুন-হিয়া।
উত্তর কোরিয়ার প্রোপাগান্ডা মিডিয়া সগওয়াং এর ভাষ্যমতে হানকে তার দেশের জনগণ বলতো 'একজন তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড় যে কিনা ইউরোপিয়ান ফুটবল জগতের নজরে আসতে সক্ষম হয়েছে।'
কিন্তু হানের এই সুদিন দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়া ষষ্ঠবারের মতো পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোয় ইউনাইটেড নেশনস সিকিউরিটি কাউন্সিল (ইউএনএসসি) উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এসব নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে, কিম জং উনের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা কার্যক্রমকে সহায়তা করার জন্য বিদেশি অর্থ স্থানান্তর করা হচ্ছে — এমন উদ্বেগের মধ্যেই সদস্য দেশগুলোকে তাদের নিজ নিজ এখতিয়ারে কর্মরত সকল উত্তর কোরিয়ান নাগরিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেয় ইউএনএসসি। উত্তর কোরিয়ানদের স্বদেশে প্রেরণের জন্য ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময় বেধে দেয় ইউএনএসসি।
কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ায় উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এবং হানসহ আরও অনেক উত্তর কোরিয়ান নাগরিকের দেশে ফেরা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, ২০২১ সালে হানের কাতার ছাড়ার কথা, কিন্তু তখন থেকেই তিনি গায়েব! সিএনএন-এর অনুসন্ধানে এই ফুটবলারের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন করে প্রকাশ্যে এসেছে।
পিয়ংইয়ং
উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে ১৯৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন হান কং সং। কিম জং উনের খেলাধুলাপ্রীতি থেকে গড়ে তোলা, স্বনামধন্য পিয়ংইয়ং ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল স্কুলে সুযোগ পেয়েছিলেন হান, এর বাইরে তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে বেশি কিছু তথ্য পাওয়া যায় না।
২০১১ সালে কিম জং উনের বাবার মৃত্যুর পর তিনিই উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার নির্বাচিত হন এবং খেলাধুলাকে জনপ্রিয় করে তুলতে উদ্যোগী হন। কিম খেলাধুলাকে 'সফট পাওয়ার' চর্চার উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের দেশকে পরিচিত করে তোলার জন্য এলিট স্পোর্টে বিনিয়োগ করেন এবং ডিফেন্স ও লেবার পাওয়ার বৃদ্ধির জন্য পাবলিক স্পোর্টে বিনিয়োগ করেন বলে বলা হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ইউনিফিকেশন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে।
এরপর থেকেই উত্তর কোরিয়া বড় বড় আন্তর্জাতিক স্পোর্টিং ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে, যার মধ্যে রয়েছে ২০১২ সালে লন্ডনে সামার অলিম্পিক এবং ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত উইন্টার অলিম্পিক।
দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে কার্যত যুদ্ধে জড়িয়ে থাকলেও, ২০১৮ সালের পিয়ংচ্যাং উইন্টার অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে 'কোরিয়ান ইউনিফিকেশন ফ্ল্যাগ'-এর অধীনেই মার্চ করেছিল দুই জাতি এবং নারীদের আইস হকি প্রতিযোগিতায়ও দুই দল এক হয়েই অংশগ্রহণ করেছিল। ক্রীড়াজগতে উত্তর কোরিয়ার জন্য যে দরজা খুলে গিয়েছিল তা সহসা বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
উত্তর কোরিয়ার পুরুষদের সকার টিমের সাবেক কোচ ইয়র্ন অ্যান্ডারসেন উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টিভি চ্যানেল কেসিটিভিতে খেলাধুলার ইভেন্ট সম্প্রচারের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সিএনএন স্পোর্টকে বলেন, "কিছু কিছু স্থানীয় টিভি চ্যানেল আছে যারা কখনোই খেলা লাইভ দেখায় না, মাঝেমধ্যে ইউরোপিয়ান সকার দেখায়। হয়তো বুন্দেসলিগা থেকে একটা ম্যাচ, লা লিগার একটা, ইতালিয়ান লিগের একটা এবং ইংল্যান্ডের একটা ম্যাচ দেখায়।"
২০১৩ সালে কিম জং উন পিয়ংইয়ং ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ফুটবল প্রতিভা অন্বেষণ, তরুণ শিক্ষার্থীদের বিদেশে পাঠানো এবং বিশেষজ্ঞদের এখানে রাখার জন্য। দেশটির সরকারি সংবাদ সংস্থা কেসিএনএ'র দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ফিফার প্রতিনিধিদেরও ২০১৪ সালে পিয়ংইয়ংয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয় স্থানীয় টিমগুলোকে এবং ইনস্ট্রাক্টরদের শেখাতে সাহায্য করার জন্য; এছাড়া উত্তর কোরিয়ার ফুটবলকে 'বিশ্বমানসম্পন্ন' করে তুলতে বিদেশি খেলোয়াড়দের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এছাড়াও, এই সকার স্কুলে তরুণ প্রতিভাদের যথাযথভাবে গড়ে তোলা ও বিকাশের জন্য অত্যাধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়।
প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পরেই এই স্কুল থেকে ১৪ জন শিক্ষারথীকে স্পেনে এবং ১৫ জনকে সরকারি খরচে ইতালিতে পাঠানো হয় এই দুটি দেশের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাবগুলো থেকে ফুটবল শেখার জন্য। এই এলিট প্রোগ্রাম থেকে যারা গ্র্যাজুয়েট হয়েছে, হান কং সং ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত একজন।
ইউমি নামক এক ইউটিউবারের চ্যানেলে প্রকাশিত একটি ভিডিও থেকে নিজ দেশে হানের খ্যাতি সম্পর্কে বোঝা যায়। এই ভ্লগারের চ্যানেলে যা বলা হচ্ছে, তা-তে ধারণা করা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তর কোরিয়ার ইমেজ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইনের অংশ। ভিডিওতে পিয়ংইয়ংয়ের এক বাসিন্দাকে বলতে শোনা যায়, "আমি হানকে পছন্দ করি। তার দক্ষতা একদম নিখাদ এবং সে ড্রিবলিংয়ে ভালো।"
কিম জং উনের নিজের দেশকে স্পোর্টস পাওয়ারহাউজ বানানোর প্রচেষ্টার সবচেয়ে সফল ফলাফল ছিলেন হান কং সং, যখন ইতালিয়ান ইয়ুথ স্কাউটিং সেন্টার আইএসএম অ্যাকাডেমি তাদের ট্যালেন্ট আইডেন্টিফিকেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে হানকে বেছে নেয়।
২০১৫ সালে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী টিনেজার নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে আসেন ইতালির উমব্রিয়া অঞ্চলের রাজধানী পেরুজাতে এই অ্যাকাডেমির ঘাঁটিতে। তার সঙ্গে আসেন উত্তর কোরিয়ার আরেক প্রতিভা চেই সং হিওক।
ইউরোপে যাত্রা
আইএসএম অ্যাকাডেমিতে এই দুই উত্তর কোরিয়ান বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত তরুণ ফুটবলারদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পান এবং এদের সবারই স্বপ্ন ছিল ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোর কোনো একটিতে জায়গা করে নেওয়া।
অ্যাকাডেমি তাদের ওয়েবসাইটে গর্বভরে হানের একটি ছবিও প্রকাশ করেছিল, তারা তাকে এমন একজন খেলোয়াড় হিসেবে উল্লেখ করেছিল যে 'তাদের লক্ষ্যে পৌঁছেছে এবং পেশাদার ফুটবলের জগতে প্রবেশ করেছে'। হানের বন্ধু চোইর ছবিও প্রকাশিত হয়েছিল, চোই ইতালির লোয়ার লিগের দল এসি পেরুগিয়া কালচো'তে খেলার সুযোগ পেয়েছিল।
হান অ্যাকাডেমিতে প্রায় এক বছরের মতো ছিলেন এবং এরপরে তিনি ইয়ুথ টিম কাইগারি এফসিতে যোগদান করেন। এই দলে চলে আসায় তিনি প্রথম আঞ্চলিক স্বীকৃতি পান।
তবে হানের কাইগারি এফসিতে যোগ দেওয়ার সময়ও তৈরি হয়েছিল জটিলতা, যার ফলে আসল চুক্তি সই করতে অনেক দেরি হয়ে যায়। কাইগারির তখনকার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ ম্যাক্স কানজির ভাষ্যে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে হানের এই দলে যোগ দিতে দেরি হয়।
তিনি বলেন, "এমনকি ইতালিয়ান সংসদে কেউ একজন প্রশ্নও তুলেছিল হানকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে, কারণ আমাদের উত্তর কোরিয়ান খেলোয়াড়দের সঙ্গে চুক্তি করার ব্যাপারে আমাদের নিষেধাজ্ঞা ছিল।"
কিন্তু শেষ পর্যন্ত হানের খেলোয়াড়ি দক্ষতার কাছে বাকি সব হার মানে এবং তাকে দলে নেওয়া আসলেই লাভজনক হয় কাইগারির জন্য। ২০১৭ সালের মার্চে কানজির অধীনে হান এই ক্লাবের যুবদলে যোগদান করেন এবং নিজের প্রথম ম্যাচেই গোল করার মাধ্যমে নিজের প্রতিভার জানান দেন। ফলে তাকে তাৎক্ষণিক প্রমোশন দিয়ে সিরি এ-তে ফার্স্ট টিমে নিয়ে নেওয়া হয় বলে জানান কানজি।
এভাবেই হান প্রথম উত্তর কোরিয়ান ফুটবলার হিসেবে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচটি লিগের একটিতে জায়গা করে নেন; তাও আবার পেশাদার অভিষেকের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই।
ইংরেজি বা ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলতে না শিখেই ইতালিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন হান। কিন্তু 'পশ্চিমা সংস্কৃতি'র সাথে মানিয়ে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি তার; তবে এটা ছিল এমন একটা বিষয় যা উত্তর কোরিয়ার নিষিদ্ধ।
"শুরুর দিকে এটা খুব একটা সহজ ছিল না কারণ সে ইংরেজি বা ইতালিয়ান ভাষা বলতে পারতো না। কিন্তু সে খুব দ্রুত ইতালিয়ান শিখে নিয়েছিল", বলেন কানজি।
কাইগারির ইয়ুথ টিমে হানের সতীর্থ ছিলেন নিকোলাস পেনিংটন। তিনি বলেন, "হান খুবই ভালো একজন খেলোয়াড় ছিল। সে একটু লাজুক স্বভাবের ছিল, কিন্তু খুবই চমৎকার মানুষ ছিল।"
"হান এখানে আসার পর যারা প্রথম ওর সাথে কথা বলতে এগিয়ে গিয়েছিল, আমি ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। আমি মাঝেমধ্যে তাকে গাড়িতে তুলে নিতাম এবং সে আমার সাথে প্রশিক্ষণে আসত", যোগ করেন তিনি।
পেনিংটন জানান, তিনি একাধিকবার হান ও চোয়িকে উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন। "কিন্তু ওরা তেমন কিছু বলতে চাইতো না। আমার মনে হয় ওরা এ বিষয়ে কথা বলতে ভয় পেত। ওরা বলত, 'আমি জানি না', ওরা আসলে তেমন কিছু প্রকাশ করতেই চাইতো না।"
পিয়ংইয়ংয়ে নিজের পরিবার সম্পর্কেও তেমন কিছু বলতে চাইত না হান, বলেন পেনিংটন। "আমার মনে আছে, হান বলতো যে সে তার পরিবারকে মিস করে, তারা পিয়ংইয়ংয়ে ছিল। সে জানে না যে সে কখন বাড়ি ফিরে যেতে পারবে এবং পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারবে। কিন্তু সেসময় হানের জন্য উত্তর কোরিয়া ফিরে গিয়ে দেখা করা খুব একটা সহজ ছিল না। আমার মনে আছে, আমি এটা ভেবে খুব অবাক হতাম যে হান তার পরিবার সম্পর্কে এত কম বলে, আর আমি কত বেশি বলি!"
ছোটবেলায় সিউলে বছর তিনেক কাটিয়েছিলেন সাবেক কোচ কানজি। তিনি বলেন, হান 'খুবই লাজুক ও খুবই ভদ্র' স্বভাবের ছেলে ছিল।
"ফুটবল খুবই অদ্ভুত, কারণ যখন আপনি একটা দলে ভালো খেলেন তখন সবাই আপনাকে পছন্দ করে। হান যখন এখানে এলো, তার পরপরই সবাই বুঝতে পারল যে সে ভালো খেলোয়াড়", বলেন কানজি।
২০১৮ সালে কাইগারির পোস্ট করা একটি ভিডিওতে অনর্গল ইতালিয়ান ভাষায় হান বলেন, "এখানে কাইগারিতে সবাই আমাকে পছন্দ করে। এই জায়গাটাকে আমার নিজের বাড়ির মতো মনে হয়।"
ট্রান্সফারমার্কেট-এর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, কাইগারিতে খেলার সময়ই হান এসি পেরুজাতে ধারে খেলতে যান এবং ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জুভেন্টাস ৩.৭৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে হানকে তাদের অনূর্ধ্ব-২৩ দলে নেয়। কানজি বলেন, "এটা একটা দারুণ দর ছিল কাইগারির জন্য, কারণ হান কোনো বিনিময়মূল্য ছাড়াই এখানে এসেছিল।"
কানজি আরও বলেন, "জুভেন্টাস হানকে কিনতে আগ্রহী দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, সে একজন ভাল খেলোয়াড় ঠিকই, কিন্তু বয়স কম হওয়ায় ভাবতে পারিনি যে এই পর্যায়ে যাবে। তার মতো আরও কিছু খেলোয়াড় আমাদের ছিল, যদিও হানের মতো তাদেরকে নিয়ে এত মাতামাতি হয়নি, কারণ হানের উত্তর কোরিয়ান হওয়া একটা বড় ইস্যু ছিল।"
সিরি এ'তে খেলতে পারা হানের ক্যারিয়ারের বড় মাইলস্টোন ছিল। কিন্তু 'বিয়াংকোনেরি'দের (ভক্তরা জুভেন্টাসকে যে নামে ডাকে) হয়ে খেলতে পারা আরও বড় অর্জন ছিল তাদের জন্য।
সেসময় আইএসএম ইন্টারন্যাশনাল স্কাউটিং সেন্টার-এর মাধ্যমে এক লিখিত বক্তব্যে হান বলেছিল, "আমি অনেকটা পথ এসেছি এবং অবশেষে সিরি এ'তে প্রথম গোল করার মাধ্যমে এবং জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে দেওয়া প্রথম উত্তর কোরিয়ান হিসেবে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে আমার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে।"
কিন্তু জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে মাত্র এক সপ্তাহই খেলতে পেরেছিলেন হান। ওই একই মাসে জুভেন্টাস তাকে ৭.৭ মিলিয়ন ডলার ট্রান্সফার ফিতে কাতারের আল-দুহাইল ক্লাবের কাছে বিক্রি করে দেয় বলে ইউএনএসসির রিপোর্ট থেকে জানা যায়।
হান যখন তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে নানা অর্জন করে চলেছেন, তার দেশ উত্তর কোরিয়ায় তখন দারুণ উত্তেজনা। প্রথম ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল পরীক্ষা চালিয়েছে দাবি করার মাধ্যমে রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে।
এরপর ২০১৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া তাদের ষষ্ঠ পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় এবং এর ফলে ইউএনএসসির একাধিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে। নিষেধাজ্ঞার ফলে ইউএনএসসি'র সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তাদের এখতিয়ারে থাকা উত্তর কোরিয়ানদের কাজের অনুমতি দেওয়া বন্ধ করতে হয়। তিন মাস পরেই ইউএনএসসি ঘোষণা দেয়, 'যেসব উত্তর কোরিয়ান নাগরিক বিদেশে কাজ করে নিজ দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার নিউক্লিয়ার ব্যালিস্টিক প্রোগ্রামকে সহায়তা করা হচ্ছে, সেই সকল উত্তর কোরিয়ানদের ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে হবে।"
আর উত্তর কোরিয়ার পাসপোর্টধারী হওয়ায় হানও এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে ছিলেন না। ব্যতিক্রমী ফুটবল প্রতিভা হওয়া সত্ত্বেও ছাড় পাননি হান। কিন্তু ইউএনএসসি'র ডেডলাইন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও জুভেন্টাস এবং আল-দুহাইল কীভাবে ২০২০ সালে হানকে নিয়ে চুক্তিতে গেল তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য সিএনএন হানের সাবেক এজেন্ট সান্দ্রো স্টেমপেরিনি এবং আল-দুহাইলের সাথে যোগাযোগ করলেও সাড়া মেলেনি। জুভেন্টাসও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
কানজি বলেন, "আমি জানিনা সে জুভেন্টাসের খেলার সাথে তাল মিলিয়ে খেলার মতো যোগ্য ছিল কি না তখন। এরপরে কি হয়েছে তা আমি জানিনা। শুনেছি সে কাতারের কোনো একটা দলে খেলতে গিয়েছে।"
কাতারে যাওয়া
ইতালিতে হানের ক্যারিয়ারের ইতি টানা হয়ে গেলেও, কাতার ঠিকই তাকে গ্রহণ করে। ২০১৯-২০ মৌসুমের মাঝামাঝিতে আল-দুহাইল ক্লাবে এসে তিনি ১০টি লিগ গেমে অংশ নেন এবং তিনটি গোল করেন। তিনি এই ক্লাবের লিগ টাইটেল জেতার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেন। কাতারের এই ক্লাব হানকে ৫ বছরের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করিয়েছিল।
যদিও হান মাঠে ভালোই পারফর্ম করছিলেন, কিন্তু নিজ দেশে তার টাকা পাঠানোর ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। ইউএন ডকুমেন্টে দেখানো হয় যে, হান কাতারি ব্যাংকের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন যে তিনি 'কোনোভাবেই উত্তর কোরিয়ায় কোনো টাকা পাঠাবেন না।"
যদিও হান কিম জং উনের শাসনব্যবস্থায় টাকা পাঠাচ্ছিলেন কি না তা স্পষ্ট নয়, কিন্তু একথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত যে, উত্তর কোরিয়া প্রায়ই তাদের প্রবাসী কর্মীদের বাধ্য উপর চাপ দেয় সরকারকে টাকা পাঠাতে। ইউএনএসসি প্যানেল অব এক্সপার্টস-এর ২০২০ সালের মার্চে প্রকাশিত আরেকটি রিপোর্টে বলা হয় যে, তারা বিদেশে বসবাসরত উত্তর কোরিয়ানদের আয়ের উৎস নিয়ে তদন্ত করছে, যার মধ্যে খেলোয়াড়রাও রয়েছেন।
আল-দুহাইলের হয়ে হান কং সং শেষ ম্যাচ খেলেছিলেন ২০২০ সালের ২১ আগস্ট। সেদিন আল-আহলি'র বিপরীতে খেলতে বেঞ্চ থেকে তাকে নামানো হয়। সেসময় ২১ বছর বয়সী হান আল-দুহাইলের হয়ে কাতার স্টারস লিগ ট্রফি জিতেন।
সেবারই ভক্তরা হানকে আল-দুহাইলের জার্সিতে শেষবার দেখেন। নতুন মৌসুম আসতে আসতেই তিনি হারিয়ে যান। স্টার্টিং লাইন-আপ বা বেঞ্চ, কোনো জায়গায়ই তাকে দেখা যায়নি আর, হানের দলবদলের বিষয়েও কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
এরপরে কেটে গেছে মাসের পর মাস। অবশেষে ইউএনএসসির প্যানেল অব এক্সপার্ট-এর একটি চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের মার্চে। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে আগের বছর হানের সাথে আল-দুহাইলের চুক্তির সমাপ্তি ঘটেছে এবং হান কাতার ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু এ বিষয়েও আল-দুহাইল ও কাতারি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে ২০২১ সালে কোভিডের দ্বিতীয় বছরে পা রাখে বিশ্ব। উত্তর কোরিয়া তখনও তাদের সীমান্ত বন্ধ রাখে। ভাইরাস দেশে প্রবেশের ভয়ে কোনো মানুষ বা মালামাল কিছুই উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি কঠোর কোভিড-১৯ প্রতিরোধী নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করেন কিম জং উন। এই কঠোর শাটডাউন নীতির ফলে আটকা পড়েন নিরূপায় হান।
হান ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দোহা থেকে কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিমানে উঠেছিলেন। কিন্তু যেহেতু ঘরে ফেরার উপায় তার ছিল না, তাই হান আবার রোমে ফিরে যান বলে সিএনএনকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
হানের সাবেক কোচ অ্যান্ডারসনের ভাষ্যে, "আমি জানি হানকে ইতালিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার ফুটবল খেলার উপায় ছিল না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে সে আর খেলতে পারেনি।"
এ বিষয়ে জানতে ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ফিফার সাথে যোগাযোগ করেছে সিএনএন, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে জবাব মেলেনি।
এ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত এক ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, হান সর্বশেষ ২০২১ সালে এক উত্তর কোরিয়ান দূতাবাসে বাস করছিলেন এবং পিয়ংইয়ং এর ফ্লাইট পুনরায় চালু হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন।
ঐ কর্মকর্তা জানান, কিছু উত্তর কোরিয়ান দূতাবাসে স্বদেশে ফিরে যেতে অপারগ নাগরিকদের থাকার জায়গা দেওয়া হয়েছিল।
দক্ষিণ কোরিয়ার এক কর্মকর্তা সিএনএন স্পোর্টকে বলেন, ইউএন-এর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এক লাখেরও বেশি উত্তর কোরিয়ান কর্মী ৪০টি দেশে অবস্থান করছিলেন, মূলত রাশিয়া এবং চীনে; এবং তারা বছরে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার আয় করতেন।"
হান কং সং কোথায়, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা তো চলছেই, কিন্তু কানজি ও অ্যান্ডারসেনের কাছে এটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার যে, শুধুমাত্র নিজের জন্মস্থান ও জাতীয়তার কারণে হানের একটা ভালো ফুটবল ক্লাবে খেলার স্বপ্ন নষ্ট হয়ে গেল, যা সবচেয়ে বড় লজ্জার বিষয়।
"ওই পর্যায়ে ফিরে আসা সহজ হবে না, তবে সম্ভব", বলেন কানজি।
"প্রায় দুই বছর ধরে সে ফুটবল খেলেনি, আমার মনে হয় সে শুধু প্রশিক্ষণই দিচ্ছিল একটা ছোট দলের সাথে। সে আসলে ফুটবল খেলছিল না। তাই তার গুণাবলি এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে। আমার খুবই দুঃখ হয় যে হান ফুটবল খেলতে পারল না। সে খুবই উজ্জ্বল প্রতিভা ছিল", আফসোস নিয়ে বলেন অ্যান্ডারসেন।