অনুগত ও সুপ্রশিক্ষিত: রাশিয়ায় যাওয়া উ.কোরীয় সেনাদের খাটো করে দেখার অবকাশ নেই, মন্তব্য কিছু বিশেষজ্ঞের
বহির্বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এক দেশ উত্তর কোরিয়া, অথচ বর্তমান সময়ের অন্যতম এক সংঘাতে দেশটির নাম ঘুরেফিরে আসছে। এর কারণ, রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে প্রায় ১১ হাজার উ. কোরীয় সেনা।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে, এরমধ্যেই কুর্স্কে ইউক্রেনীয় সেনাদের বিরুদ্ধে সামরিক অপারেশনে যোগ দিয়েছে তারা। কুর্স্ক দখলমুক্ত করতে আরও হাজার হাজার রুশ সেনাদের সাথে তারাও লড়ছে।
এই প্রেক্ষাপটে উ. কোরীয় সেনারা যুদ্ধে কতোটা পারদর্শী এনিয়ে আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনা চলছে গণমাধ্যমসহ সমর বিশেষজ্ঞ মহলে। এপর্যন্ত বেশিরভাগ পশ্চিমা গণমাধ্যমই উ. কোরীয় সেনাদের আধুনিক যুদ্ধ লড়ার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমরাস্ত্র ব্যবহার ও তার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার কৌশল তাদের আদৌ আছে কিনা– এমন প্রশ্নও তোলা হয়েছে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন ভিন্ন কথাই।
গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের সাথে এনিয়ে কথা বলেছেন জ্যেষ্ঠ একজন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা। তিনি দাবি করেন, এরমধ্যেই কয়েকশ' ইউক্রনীয় সেনা হতাহত হয়েছে।
ইউক্রেনের দাবি, গত সপ্তাহান্তে তাদের সীমান্তের কাছাকাছি কুর্স্ক অঞ্চলের কিছু গ্রামের দখল নিয়ে লড়াই চলার সময়ে অন্তত ৩০ জন উ. কোরীয় সেনা আহত বা নিহত হয়েছে। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট দাবি করেছে, তাদের অবস্থানে উ. কোরীয়ার পদাতিক সেনারা তেড়ে এসে আক্রমণ করে। ৭০ বছর আগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কায়দায় চালানো হয় এ আক্রমণ। এসময় ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে। রুশ সেনাদের থেকে আলাদা উর্দি বা সামরিক পোশাকে থাকায়– তাঁদের সহজেই শনাক্ত করা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছে, আধুনিক এক যুদ্ধে জড়িয়েছে পিয়ংইয়ংয়ের বাহিনী, যে যুদ্ধ ইতোমধ্যেই ব্যাপক রক্তপাত ঘটিয়েছে উভয়পক্ষে। যেকোন দেশের সেনার জন্য এ যুদ্ধ ভয়াবহ, যেখানে প্রযুক্তির সাহায্য পাচ্ছে উভয়পক্ষ। আধুনিক ড্রোন ও আর্টিলারির সম্মিলনে সেনাদের জীবনের নিরাপত্তা সব সময়েই বিপন্ন। উ. কোরীয়রা যুদ্ধে জড়ানোর আগেই কাতারে কাতারে রুশ ও ইউক্রেনীয় সেনার প্রাণ কেড়েছে এই সংঘাত। সুতরাং, হঠাৎ করেই এমন পরিস্থিতির মধ্যে অচেনা যুদ্ধক্ষেত্রে তারা কতোটা সফলতা পাবে– সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওই জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বলেন, 'যদি তাদের কাছে থাকা সাজ-সরঞ্জামের মাধ্যমে অনুমান করি, তাহলে বলতে হবে– তারা যুদ্ধাভিজ্ঞ সেনা নয়, অর্থাৎ তারা আগে কখনো যুদ্ধের মুখ দেখেনি।' তিনি বলেন, তাদের হতাহতদের মধ্যে সাধারণ সেনা থেকে শুরু করে নেতৃত্ব পর্যায়ের কর্মকর্তারাও রয়েছে, এইটাও এমন অনুমানের কারণ।
তবে উ. কোরীয়দের এভাবে খাটো করে না দেখার পরামর্শ দিয়েছেন কিছু বিশেষজ্ঞ।
দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল চুন ইন-বাম বলেন, এটা ধরে নেওয়া যায়, স্টর্ম ট্রুপ নামে পরিচিত অভিজাত বাহিনীর সবচেয়ে প্রশিক্ষিত ও (কম্যুনিস্ট) মন্ত্রদীক্ষিত সেনাদেরই রাশিয়ায় পাঠাচ্ছেন উ. কোরিয়ার নেতা কিম জন-উন। এদের মধ্যে কিছু সেনা বিশেষ বাহিনীর সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের নেভি সিল বা রেঞ্জার্স এবং যুক্তরাজ্যের এসএএস- এর মতো এই সেনারাও যথেষ্ট চৌকস আর দক্ষ। অন্যান্য যেসব সেনা রয়েছে, তাদের বেশিরভাগই হচ্ছে স্নাইপার ও লাইট ইনফেন্ট্রি।
চুন বলেন, উত্তর কোরীয় সেনাবাহিনীর ১১ আর্মি কোরের অংশ স্টর্ম কোর, যারা ভালোভাবে প্রশিক্ষিত ও শারীরিক দিক থেকেও অন্যদের থেকে বলিষ্ঠ। উ. কোরীয় সেনাবাহিনীর সাধারণ সেনা সদস্যদের চেয়ে কিম জন-উনের হয়ে লড়তে তাঁরা বেশি উজ্জীবিত।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ ও আনাবাসিক ফেলো মাইকেল ম্যাডেন। তিনি বলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এটাই উ. কোরীয় সেনাদের সর্ববৃহৎ মোতায়েনের ঘটনা। যার বেশকিছু মনস্তাত্ত্বিক দিকও রয়েছে।
তাঁর মতে, 'কম্পিউটার প্রোগ্রামের মতোই এসব সেনারাও প্রোগ্রাম করা। অর্থাৎ, তারা শাসকগোষ্ঠীর মূলমন্ত্রে দীক্ষিত। এখন প্রশ্ন করতে পারেন এই দীক্ষা ও প্রোগামিং কতোটা ভালোভাবে পেয়েছে? এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের চেয়ে তারা বেশি সুযোগ-সুবিধা পায়। ফলে বিদেশে দেশের হয়ে যুদ্ধ লড়তে যাওয়ার দিক থেকেও তাঁরা অন্য সেনাদের থেকে মানসিকভাবে বেশি প্রস্তুত।'
()
যুদ্ধের ময়দানে উ. কোরীয়দের যেসব প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে– তা শুধু মানসিক দৃঢ়তার জোরে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। ড্রোনের লড়াই ইউক্রেন যুদ্ধকে আমূল রুপান্তরিত করেছে, এর মাধ্যমে শত্রুপক্ষের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি যেমন করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি প্রতিপক্ষের ধ্বংস সাধনেও ড্রোনের জুড়ি মেলা ভার। সামরিক ও বেসামরিক দুই ধরনের লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে ড্রোন কার্যকর অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রে উ. কোরীয়রা মারা পড়তেও পারে। রাশিয়ার পক্ষে লড়া এই সেনাদের 'ন্যায্য লক্ষ্যবস্তু' বলেও অভিহিত করেছে হোয়াইট হাউস।
তবে মরণপণ এই সংগ্রামে রাশিয়ারও নেই হাল ছাড়ার সুযোগ। রুশ বাহিনীও সব ধরনের কৌশল ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। আর তাদের থেকে সেগুলো শিখছে উ. কোরীয়রা। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সূত্র এমন আভাসই দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, উ. কোরীয়দের মস্কো কীভাবে তার নিজ বাহিনীর সাথে একত্রে লড়াইয়ের ব্যবস্থা নিতে পারে– তাঁর ওপরই নির্ভর করবে রাশিয়ার এই উদোগের সাফল্য। তবে রুশ বাহিনীর সাথে লড়াইয়ের পুরোপুরি উপযুক্ত হওয়ার আগপর্যন্ত তাদেরকে পরিখা খনন, নিরাপত্তা চৌকি পাহাড়া ইত্যাদি কাজে লাগানো হতে পারে।