সংবাদ পাঠে এআই, টিভি সংবাদ উপস্থাপনার পেশা কি ঝুঁকিতে?
'নিউজ প্রেজেন্টারদের চাকরি যেতে আর বেশি দেরি নেই', 'সব এআই-এর দখলে যাবে', 'মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী চলে এসেছে, নামটাও কিন্তু অপরাজিতা!'
গত ১৯ জুলাই দেশে প্রথমবারের মতো বেসরকারি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে খবর পড়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবতারের (অ্যাভাটার) সংবাদ উপস্থাপক অপরাজিতা। যদিও চ্যানেলটিতে সংবাদ পাঠ করা অবতারটি ডিপ লার্নিং টেকনোলজিসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ এআই নয়, তবু দেশের টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা এটি। সংবাদ উপস্থাপকদের জায়গায় কৃত্রিম অবতারকে দেখতে পাওয়ার ঘটনা দেশের দর্শকদের কাছেও ছিল চমকপ্রদ।
সন্ধ্যা ৭টার সংবাদ বুলেটিনে অপরাজিতার খবর পড়ার পর থেকেই নেটমাধ্যমে তুমুল আলোচনা চলছে এআই সংবাদ উপস্থাপনার ভবিষ্যৎ নিয়ে। বিশ্বের অনেক দেশেই উপস্থাপনায় এআই নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সেই প্রেক্ষিতে উল্লিখিত মন্তব্যগুলোর মতো অনেক নেটিজেনেরই আশঙ্কা এআই-এর কবলে চাকরি হারাতে যাচ্ছেন সংবাদ উপস্থাপকেরা।
টিভি চ্যানেলগুলোতে সংবাদ উপস্থাপকের পেশায় যারা কর্মরত আছেন তারা কী ভাবছেন এ বিষয়ে? আসলেই কি এআই-এর দাপটে চাকরি হারানো নিয়ে শঙ্কিত তারা? নাকি নতুন কোনো সম্ভাবনা হিসেবেই গ্রহণ করছেন একে? এই জিজ্ঞাসা নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড যোগাযোগ করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সংবাদ উপস্থাপকের সঙ্গে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক, বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সামিয়া রহমানের ভাষ্যে, 'পেশাদার সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে যারা কাজ করছেন, তাদের জন্য এটা একটু চিন্তারই বিষয়। কারণ এআই টুলের মাধ্যমে সংবাদ উপস্থাপনার কাজ ভালোভাবে চালানো গেলে চ্যানেল মালিকেরা আর বেশি টাকা খরচ করে নিউজ প্রেজেন্টার পদ রাখতে চাইবেন না।'
সামিয়া রহমানের মতে, সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে মানুষের জন্য যে বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জিং, সেগুলো এআই-এর ক্ষেত্রে অনেক সহজ হয়ে আসবে। দিন-রাতের যেকোনো সময় অফিসে উপস্থিত থাকা বা বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাওয়ার সুবিধাগুলো এআই-কে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে মানুষের চেয়ে এগিয়ে রাখবে। উপস্থাপক হিসেবে প্রশিক্ষণ বা মেকআপের জন্যও সময় নষ্ট হবে না এক্ষেত্রে। তাই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল চ্যানেলই এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে চাইবে।
'মানুষের জন্য দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ধীরে ধীরে সব পেশার বিকল্প হয়ে উঠছে এটি। আমি মনে করি আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছরের ভেতরই নিউজ প্রেজেন্টারদের জায়গা দখল করে নেবে এআই,' যোগ করেন সামিয়া রহমান।
সংবাদ উপস্থাপনার পেশায় টিকে থাকতে হলে নিজেদেরকে আরও বেশি দক্ষ ও যোগ্য হয়ে ওঠার পরামর্শ দেন প্রাক্তন এই উপস্থাপক।
অন্যদিকে এই পেশার সঙ্গে জড়িত নতুন প্রজন্মের সংবাদ উপস্থাপকদের মতামত অনেকটাই ভিন্ন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও গ্লোবাল টেলিভিশন-এর সংবাদ উপস্থাপক রাগীব রহমানের মতে, টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদের জন্য লাভজনক হলেও সাধারণ দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না এআই সংবাদ উপস্থাপক। সংবাদ পাঠের পাশাপাশি উপস্থাপনায় যে মানবীয় আবেগের প্রয়োজন তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন তিনি।
রাগীব রহমান বলেন, 'অন্যান্য প্রোগ্রাম অন-এয়ার করার আগে বেশ কয়েকবার রেকর্ড করার সুযোগ থাকলেও সংবাদ সবসময় সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। আমাদের ক্ষণে ক্ষণে পিসিআর (প্রোডাকশন কন্ট্রোল রুম) থেকে নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়। স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী সব পড়ে গেলেই হয় না। এক্ষেত্রে অনেক বেশি উপস্থিত বুদ্ধির দরকার হয়। এগুলো এআই-এর পক্ষে কতটা সম্ভব তা নিয়ে সন্দিহান আমি।'
প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক কিছু সম্ভব হলেও সংবাদ উপস্থাপনার বিষয়টি ফলপ্রসূ হবে না বলেন তিনি।
এ বিষয়ে একই মত এখন টিভির সংবাদ উপস্থাপক তানজিলা খান মীম এবং মাছরাঙা টিভির সংবাদ উপস্থাপক মৌমিতা জান্নাতের। তানজিলা খানের ভাষ্যে, 'খবর পড়তে গিয়ে অনেক সময় এমন পরিস্থিতি হয় যা পুরোটাই আমার উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে সামলাতে হয়। ধরুন কোথাও আগুন লেগেছে, সরাসরি সম্প্রচারে কোনো স্ক্রিপ্টও নেই। তখন আমাকেই নিজে থেকে দীর্ঘসময় ধরে কথা বলে যেতে হয়। কোনো রোবট বা এআই দিয়ে স্ক্রিপ্ট ছাড়া এমন উপস্থাপনা তো আশা করা যায় না। মাসে দুই-একটা বিশেষ রেকর্ডেড অনুষ্ঠান হয়তো উপস্থাপন করা যেতে পারে এআই দিয়ে।'
মৌমিতা জান্নাত বলেন, 'আগামী ১৫–২০ বছরেও বাংলাদেশের সংবাদ উপস্থাপনার পেশা এআই-এর দখলে যাবে বলে মনে করি না আমি। দর্শকেরা যেভাবে খবর দেখে অভ্যস্ত সেরকম সাবলীলভাবে এআই খবর পড়তে পারবে না। তাই নিয়মিত সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে দর্শকেরাই এআই-কে গ্রহণ করবেন না।'
চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সংবাদ উপস্থাপক ফারাবী হাফিজ- অপরাজিতাকে দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই। সংবাদ উপস্থাপকের পেশাটি খুব শীঘ্রই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দখলে যাচ্ছে কি না জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে। ফারাবি জানান, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে সংবাদ উপস্থাপনা করা অবতারটি পুরোপুরি এআই না হলেও এআই-এর আগের ধাপ। এর মাধ্যমে ধারণকৃত সংবাদ প্রচার করা হয়েছে চ্যানেলে। কেউ চাইলে নির্দিষ্ট কিছু সফটওয়্যার ব্যবহার করে নিজেরাই এ ধরনের অবতার বানিয়ে নিতে পারেন। সংবাদ মাধ্যম চাইলে প্রচলিত অনুষ্ঠানের খরচ কমানোর জন্য পূর্ণাঙ্গ এআই তৈরি করেও সংবাদ উপস্থাপনার কাজে ব্যবহার করতে পারে। যদিও বাংলাদেশের জন্য এখনো বেশ সময়সাপেক্ষ সেটি। তাছাড়া দেশের দর্শকদের কাছে এআই উপস্থাপক কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তাও প্রশ্ন থেকে যায়।
তিনি বলেন, 'সংবাদ উপস্থাপনা মানে শুধু তথ্য দিয়ে যাওয়া নয়। এর মাধ্যমে তথ্যটি বিশ্বাসযোগ্য করে দর্শকের কাছে পৌঁছাতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়। এর জন্য বাচনিক যোগাযোগের পাশাপাশি অবাচনিক যোগাযোগ বা অভিব্যক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ জায়গায় এআই অনেকটাই পিছিয়ে আছে। তাই খুব তাড়াতাড়ি সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে মানুষের জায়গা নিয়ে নেওয়া এআই-এর পক্ষে সম্ভব নয়।'
এআই-এর মাধ্যমে সংবাদ উপস্থাপনার ধারণাটি বিশ্ববাসীর জন্য ইতোমধ্যেই পুরোনো খবর। ২০১৮ সালে চীনের সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া সর্বপ্রথম এআই সংবাদ উপস্থাপকের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেয় বিশ্বকে। এরপর ২০১৯ সালে লাটভিয়ার টিভি চ্যানেলে দেখা যায় লরা নামক এআই উপস্থাপককে। এ বছর এপ্রিলে কুয়েত নিউজে দেখা মেলে এআই উপস্থাপক ফেদা'র। একই মাসে ভারতীয় সংবাদ চ্যানেল আজ তাক-এর স্ক্রিনে দেখা যায় এআই উপস্থাপক সানাকে। সম্প্রতি ভারতের উড়িষ্যার এক টিভি চ্যানেলেও খবর পড়তে দেখা যায় লিসা নামক এআই উপস্থাপককে। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপস্থাপক।
বিশ্বজুড়ে সংবাদ উপস্থাপনার কাজে এআই-এর ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। এ নিয়ে বিবিসি নিউজে ১৮ বছর সংবাদ উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা সাংবাদিক সাইমন ম্যাকয় লিখেছেন দ্য গার্ডিয়ানে। তার মতে, এআই উপস্থাপক হয়তো খবর পড়তে গিয়ে উচ্চারণে কোনো ভুল করবে না, মেকআপ বা জামা-কাপড় নিয়ে তার কোনো সমস্যা থাকবে না, দিন-রাত বিরতিহীন কাজ করে যাবে, পারিশ্রমিক নিয়ে চিন্তা করবে না। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাই হবে মানবীয় আবেগের অভাব। সংবাদের ধরন অনুযায়ী এআই অবতারের মৌখিক অভিব্যক্তি বদলাবে না। যে কারণে সংবাদকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যর্থ হবে এআই।