যেভাবে কাজের চাপ কমিয়ে বাড়তি আয়ের পথ সহজ করতে পারে এআই
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই মানুষের চাকরি কেড়ে নেবে, সাম্প্রতিককালে এমন আশঙ্কা জোরাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু মানুষের সম্পূর্ণ বিকল্প হয়ে উঠতে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে এই প্রযুক্তিকে। তবে এআই যে মানুষের কাজকে সহজ করে তুলতে পারে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নিয়মিত চাকরির পাশাপাশি অনেকেই বাড়তি আয়ের আশায় ছোটখাট উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। এসব কাজের ক্ষেত্রে মূলত মানুষের সময় বাঁচিয়ে কাজগুলোকে আরও সহজ এবং আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে এআই।
ফুড ফটোগ্রাফার শন অডেট ইমেইল লিখতে এবং ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরির জন্য চ্যাটজিপিটির মতো এআই টুলস ব্যবহার করেন। অডেট মনে করেন, "অটোমেশন প্রযুক্তি আসলে আমাদের কাজের চাপ কমিয়ে দিচ্ছে।" সিএনবিসি'কে তিনি বলেন, "একজন ক্লায়েন্ট যখন আমার কাছে আসে, আমাকে দ্রুত আমার সার্ভিস এবং এর খরচ সম্পর্কে কিছু তথ্য তাকে দিতে হয়...তাও খুব গোছানো, সংক্ষিপ্ত এবং পারসোনালাইজড ভাবে।"
আর বাড়তি আয়ের জন্য যেসব কাজ করা হয়, সেখানে সময় মেনে সবকিছুর পরিকল্পনা-পরিচালনা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে সময়ই সবচেয়ে মূল্যবান। বর্তমানে এআই ব্যবহার করে এসব বাড়তি আয়ের প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করা যাচ্ছে, যেখানে কিনা ঘণ্টায় ১০০ ডলারও আয় করা সম্ভব।
কোনো কোনো এআই টুলস হয়তো 'সেট ইট অ্যান্ড ফরগেট ইট' ধরনের প্রোগ্রাম। কিন্তু চ্যাটবট কখনো কখনো নিজেরা বানিয়ে তথ্য দেয়। সুতরাং, এআই টুলস ব্যবহারে লাভ এবং ঝুঁকি- দুটোই আছে। তবুও এআই ল্যাঙ্গুয়েজ সম্পাদনার কাজ বিশাল বড় বড় প্যারাগ্রাফ লেখার চেয়ে দ্রুত করা যায়, বলেন অডেট। এখানে তিনটি অতি পরিচিত 'সাইড হাসল' বা বাড়তি আয়ের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে কিনা এআই ব্যবহার করে আপনি সময় বাঁচিয়ে কাজ করতে পারবেন।
ট্রাভেল এজেন্ট
নিকোল কুয়েতো নিউইয়র্কের একজন জনসংযোগ কনসালট্যান্ট, যিনি নিয়মিত চাকরির বাইরে একজন ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। তার দায়িত্ব হচ্ছে মানুষজনকে ছুটি কাটানোর জন্য একটি পরিকল্পনা করতে সাহায্য করা- ফ্লাইট বুক করা, রিজার্ভেশন অথবা ভ্রমণ পরিকল্পনা তৈরি করে দেওয়া।
ট্রাভেল এজেন্ট প্ল্যাটফর্ম ফোরাতে তার একটি প্রোফাইলও আছে। ক্লায়েন্টরা তার সুপারিশ করা তালিকা থেকে হোটেল বুক করলে তিনি সেখান থেকে কমিশন পান।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই সাইড হাসল শুরু করার পর থেকে কুয়েতো দৈনিক ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা ব্যয় করতেন একদিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে। কিন্তু চ্যাটজিপিটিকে গুগলেরই একটি পরিমার্জিত সংস্করণস্বরূপ ব্যবহারের পর থেকে সেই সময় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানান তিনি।
"আমি প্যারিসে হাজার বার গিয়েছি, কিন্তু ক্লায়েন্ট যখন বলে সে ওল্ড স্কুল ধাঁচে, পুরনো আমলের দৃষ্টিকোণ থেকে শহরটাকে ঘুরে দেখতে চায়, সেক্ষেত্রে আমি বুঝতে পারি না যে এটা কিভাবে করব। তখন আমি এআই টুলসে টাইপ করি যে, '১৮৮০র দশকে রাজনীতিবিদরা প্যারিসে যেখানে থাকতেন, সেসব ঐতিহাসিক এলাকা ঘুরে দেখার জন্য বাজেটের মধ্যে একটা পরিকল্পনা করে দাও'।
চ্যাটজিপিটির দেওয়া ভ্রমণসূচি অন্ধভাবে অনুসরণ করাও যে বিপজ্জনক, সেটিও জানেন কুয়েতো। কিন্তু ফ্যাক্ট-চেকিং (তথ্যের সত্যতা যাচাই) করতে তার আপত্তি নেই। তবুও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনের চেয়ে তার এটাকে বেশি সুবিধাজনক মনে হয়। সেইসাথে সময় বেঁচে যাওয়া মানে আরও বেশি ক্লায়েন্টের কাজ দেখা এবং আরও বেশি টাকা উপার্জন।
বর্তমানে এই কাজ থেকে কুয়েতোর গড় মাসিক আয় ৬৭০ ডলার। তিনি সপ্তাহে ১০-২০ ঘণ্টা সময় দেন এর পেছনে, অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় ৪২ ডলার আয় করেন তিনি।
কন্টেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট
এআই মানুষের অনেক চাকরি কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি নতুন কাজের সুযোগও তৈরি করতে পারে। কিছু কোম্পানি এরই মধ্যে পার্ট-টাইম কন্টেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দেওয়া শুরু করেছে, যার কাজ হবে চ্যাটবট ব্যবহার করে ব্লগ, নিউজলেটার এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট দেওয়া এবং যা ফলাফল আসবে তার ফ্যাক্ট-চেক করা।
এই চাকরিকে এআই কন্টেন্ট এডিটিংও বলা হয়ে থাকে, এবং এর মাধ্যমে ঘণ্টায় ২০ থেকে ১০০ ডলার আয় করা সম্ভব।
"আপনি সরাসরি কপি-পেস্ট করতে পারেন একটা প্রতিলিপি এবং চ্যাটবটকে বলবেন- এখান থেকে একটা ৭০০ শব্দের নিবন্ধ তৈরি করো যেটির মধ্যে পাঁচটি টিপস থাকবে", বলেন কনসাল্টিং ফার্ম বোল্ডহাউস এর প্রতিষ্ঠাতা অ্যাঞ্জেলিক রুয়ার্স।
রুয়ার্স এআই কন্টেন্ট সহকারীর কাজকে বাড়তি আয়ের মোক্ষম সুযোগ বলে উল্লেখ করেন। তবে চ্যাটজিপিটির তৈরি যেকোনো লেখা প্রুফরিড করা উচিত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে এই চাকরিটি এখন ফ্রিল্যান্স প্ল্যাটফর্মেও আস্তে আস্তে জেগে উঠছে, জানান আপওয়ার্ক এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্গারেট লিলানি। তার ভাষ্যে, এই শ্রেণীর কাজের ব্যাপক চাহিদা আছে এবং নিয়োগকর্তারা ফ্রিল্যান্সার খুঁজছে যারা এই চাহিদার যোগান দিতে পারবে। এখনও পর্যন্ত চ্যাটজিপিটি বিনামূল্যে ব্যবহার করা যাচ্ছে।
শিল্পী
একজন প্রশিক্ষিত শেফ অডেট কানাডায় বদলি হিসেবে কিছুদিন 'পেস্ট্রি আর্টস' ক্লাস নেওয়ার সময় বুঝতে পেরেছিলেন যে তার ফটোগ্রাফি বা ছবি তোলার দিকে ঝোঁক আছে। তাই পরবর্তীতে এটাকেই তিনি সাইড হাসল বা বাড়তি আয়ের উপায়ে পরিণত করেন। ২০২০ সালের দিকে তিনি এই কাজ শুরু করেন। অডেট জানান, বর্তমানে তিনি ইমেইল লেখা এবং ব্যবসায়িক টেমপ্লেট তৈরিতে এআই ব্যবহার করেন।
বর্তমানে তিনি এআই টুলসকে নির্দেশ দেওয়া, এর সাথে যোগাযোগের কৌশল আরও ভালোভাবে শেখার পেছনে সময় ব্যয় করছেন, যে সময়টা কিনা তিনি ইমেইল বা টেমপ্লেট লেখার কাজে দিতেন। তার ভাষ্যে, "আমার মনে হয় আমার সত্যিই এমন একজন সহকারী আছে, যার সাথে কিনা খুবই সুনির্দিষ্ট করে সবকিছু বলতে হয়।"
যদিও এখনও পর্যন্ত এআই'র সাহায্যে মোটা অংকের টাকা আয় করছেন না অডেট। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তার এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তিনি আরও ভালো কাজ করতে পারবেন।
তাছাড়া, ছবির ক্ষেত্রে জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করছেন তিনি। ব্যাকগ্রাউন্ড অদলবদল করা, ছোটখাট খুঁত ঢেকে দেয়া বা অবজেক্টের রঙ বদলে দেয়ার মতো কাজগুলোও করেন এআই'র মাধ্যমে। কিন্তু এখনও এগুলো পেশাদার প্রজেক্টে ব্যবহারের সাহস করছেন না তিনি।
"কখনো কখনো ফলাফল দেখলে আপনি অবাক হবেন... কিন্তু প্রযুক্তি যদি ৯০% কাজ করতে পারে, তাও যথেষ্ট নয় যখন কিনা ক্লায়েন্ট আপনাকে এত এত টাকা দিচ্ছে। তাই এখন পর্যন্ত আমার ব্যবসায়ে এআই'র প্রভাব নিম্ন স্তরে রয়েছে", বলেন অডেট।