পাঁচশর বেশি তারের গোপন জীবন! যারা ইন্টারনেট চালায়
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হয়েছে — সেই খেলা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও ঘরে বসে দেখতে পেয়েছেন। আর তা সম্ভব হয়েছে বিশ্বের সমুদ্রগর্ভে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সাবমেরিন ক্যাবলের কল্যাণে।
কয়েক হাজার মাইল দীর্ঘ, মানুষের চুলের মতো সরু ফাইবার গ্লাসের তৈরি এ ক্যাবলগুলোর মধ্যে দিয়ে আলোরগতিতে ডেটার স্থানান্তর ঘটে। আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে বসানো সবচেয়ে দ্রুতগতির সাবমেরিন ক্যাবলটি প্রতি সেকেন্ডে ৪০০ টেরাবিট ডেটা স্থানান্তর করতে পারে। সচরাচর ঘরবাড়িতে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের তুলনায় এ ক্যাবলের গতি চারলাখ গুণ বেশি।
তারপরও সেই ১৮৫০-এর দশকে আটলান্টিকের গভীরে প্রথম টেলিগ্রাফ ক্যাবল বসানোর প্রযুক্তি আর আজকের সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের প্রযুক্তিতে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।
বর্তমানে স্পেসএক্স-এর স্টারলিংক-এর মতো পৃথিবীকে আবর্তনকারী স্যাটেলাইটভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থা বিস্তৃত হলেও, সাবমেরিন ক্যাবলগুলোই এখনো বৈশ্বিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের মূল চালিকাশক্তি। এসব ক্যাবল বিশ্বের মহাদেশগুলোর মধ্যে ৯৯ শতাংশের বেশি ট্রাফিক আদানপ্রদান করে।
এ মুহূর্তে বিশ্বের সমুদ্রসমূহের গভীরে প্রায় সাড়ে পাঁচশটি স্থাপিত ও পরিকল্পিত সাবমেরিন ক্যাবল রয়েছে। এছাড়া আরও অনেক সাবমেরিন ক্যাবল বসানোর পরিকল্পনা চলছে।
মেটা, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, ও গুগল-এর মতো বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বৈশ্বিক ইন্টারনেটের বড় একটা অংশ পরিচালনা করে। এসব কোম্পানির কয়েকশ ডেটাসেন্টারে কয়েক মিলিয়ন সার্ভার রয়েছে। এজন্য এদেরকে 'হাইপারস্কেলারস' বলা হয়।
বিশ্বের মোট ইন্টারনেট ট্রাফিকের দুই-তৃতীয়াংশই আসে হাইপারস্কেলারদের কাছ থেকে। তাই এদের নিজস্ব সাবমেরিন ক্যাবলের ডেটার চাহিদাও প্রতি বছর ৪৫ থেকে ৬০ শতাংশ বাড়ছে।
সাবমেরিন ক্যাবল যে কারণে দ্রুত ছড়াচ্ছে
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাবমেরিন ক্যাবল ছড়িয়ে পড়ার অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে। এ ধরনের ক্যাবলের দরুন দ্রুতগতির ইন্টারনেট কম মূল্যে পাওয়া যায়, মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া হাইপারস্কেলারদের ট্রাফিক বাড়ার পর থেকে চিরায়ত যেসব টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি আগে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করত, তারা ক্রমে এ খাত থেকে সরে যাচ্ছে।
নিজেদের প্রয়োজনেই হাইপারস্কেলাররা সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের কাজটি করতে শুরু করেছে। ফলে হু-হু করে বেড়েছে এসব ক্যাবলের সংখ্যা। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৩–২০২৫ সালে সারাবিশ্বে এ ধরনের ইন্টারনেট ক্যাবল স্থাপনে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে।
সাবমেরিন ক্যাবলের সূচনা
১৮০০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা নদী ও সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে প্রথমবারের মতো টেলিগ্রাফ ক্যাবল বসান। ১৮৫৮ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশ দিয়ে প্রথম টেলিগ্রাফ ক্যাবল বসানো হয়। কিন্তু এটি মাত্র তিন মাস কাজ করেছিল। আর প্রতি মিনিটে স্রেফ এক–দুটি শব্দ পাঠাতে পারত ক্যাবলটি।
এরপর প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ডেটা পরিবহনের গতিও বাড়তে থাকে। টেলিগ্রাফের পর ১৯৭৩ সালে ট্রান্সআটলান্টিক টেলিফোন ক্যাবল স্থাপন করা হয়। ১৯৮৮ সালে এ ক্যাবলে তামার তারের বদলে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের ব্যবহার শুরু হয়।
সাবমেরিন ক্যাবলের প্রযুক্তি
লেজার লাইটের পালস হিসেবে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে ডেটা পরিবহন করা হয়। ক্যাবলের দুই প্রান্তে স্থলে স্থাপন করা বিভিন্ন নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি ডেটাকে আলোয় এবং আলোকে ডেটায় রূপান্তর করে।
তবে ফাইবার অপটিক্সেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এ কারণেই ক্যাবলের প্রতি ৩০ থেকে ৬০ মাইল পরপর সিগন্যালের শক্তি বাড়ানোর জন্য আলাদা করে রিপিটার বসানো থাকে।
এ রিপিটার চালাতে শক্তি তথা বিদ্যুতের দরকার হয়। তাই ফাইবার অপটিক লাইনের সঙ্গে সাবমেরিন ক্যাবলে তামার একটি আলাদা ক্যাবলও থাকে। এ ক্যাবল দিয়ে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ভোল্ট পর্যন্ত বিদ্যুৎ পরিবহণ করা হয়।
জাহাজ দিয়ে যেভাবে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করা হয়
ক্যাবল স্থাপনকারী কোম্পানিগুলো প্রথমে একটি রুট চিহ্নিত করে। এরপর ওই পথের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। সমুদ্রের প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য, সমুদ্রতলের ভূমিরূপ, অন্যান্য ক্যাবলের অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনায় রাখতে হয়।
বিশেষ জাহাজ থেকে ক্যাবলগুলোকে সমুদ্রের গভীরে বসানো হয়। তবে সহজ শোনালেও কাজটি বেশ জটিল।
ধাতুর সিলিন্ডারে সাবমেরিন ক্যাবলগুলো রাখা হয়। এক-একটি জাহাজ প্রায় পাঁচ হাজার টন পর্যন্ত ক্যাবল বহন করতে পারে।
তীরের কাছাকাছি সমুদ্রের তলদেশে বালির তলায় ক্যাবলগুলো পুঁতে বসানো হয়। তবে মাঝসমুদ্রে, যেখানে মাছধরার সরঞ্জাম ও নোঙর ইত্যাদির তেমন বাধা থাকে না, সেখানে সমুদ্রের তলায় মাটি বা বালির ওপর ক্যাবলটি স্রেফ শুইয়ে রাখা হয়।
ক্যাবল ছিঁড়লে কী হয়
ক্যাবলগুলো বেশ টেকসই করেই তৈরি করা হয়। তারপরও প্রতি তিন–চারদিন অন্তর একটি ক্যাবল কেটে যায়। এ ধরনের দুর্ঘটনার জন্য প্রায় ৮৫ শতাংশ দায়ী মাছ ধরার যন্ত্রপাতি ও নোঙর।
আবার সমুদ্রের তলদেশে ভূমিকম্প, মাটি সরে যাওয়াসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণেও ক্যাবল ছিঁড়ে যায়। টোঙ্গায় অগ্ন্যুৎপাতের পর এর একমাত্র সাবমেরিন ক্যাবলটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে যোগাযোগ বিপর্যয় ঘটিয়েছিল।
কোনো ক্যাবল কেটে যাওয়ার পর প্রথমে এটির অবস্থান শনাক্ত করা হয়। কিন্তু এরপর মেরামতকারী জাহাজ তৎক্ষনাৎ সেখানে যেতে পারে না, বেশিরভাগক্ষেত্রে যে দেশের সীমানায় ক্যাবল কাটা পড়েছে, তার সরকারের অনুমতি নিতে হয়।
সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ সময় লাগে ছিঁড়ে যাওয়া ক্যাবল ঠিক করতে। ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমায় ভূমিকম্পের পর ছিঁড়ে যাওয়া সাবমেরিন ক্যাবল ঠিক করতে দুই মাস লেগেছিল।
মেরামত করার জন্য একটি জাহাজ ছেঁড়া ক্যাবলের এক অংশ পানি থেকে তুলে নেয়। ওই অংশ পানিতে বিশেষ পদ্ধতিতে ভাসিয়ে রেখে তারপর অপর অংশটি পানি থেকে উদ্ধার করা হয়। এরপর দুই অংশ জোড়া লাগিয়ে পুনরায় সমুদ্রে বিছানো হয়।
সাবমেরিন ক্যাবল প্রযুক্তির আধুনিকায়ন
বর্তমানে নতুন স্থাপিত ক্যাবলগুলোয় সাধারণত ১৬ জোড়া ফাইবার অপিটক ক্যাবল থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাপানকে সংযুক্ত করতে যাওয়া নির্মীয়মান নতুন একটি ক্যাবলে সেকেন্ডে ৩৫০ গিগাবিট ডেটা স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে ফাইবারের সংখ্যা ২০ জোড়া করা হচ্ছে।
জাপানের এনইসি নামক একটি প্রযুক্তি সংস্থা আরেকটি ক্যাবলে ২৪ জোড়া ফাইবার ক্যাবল ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে যাতে সেকেন্ডে ৫০০ টেরাবিট তথা আধা পেটাবিট ডেটা স্থানান্তর করা যায়।
আধুনিক, শক্তিশালী ক্যাবলগুলো স্থাপনের পাশাপাশি পুরোনো ক্যাবলগুলোও আপগ্রেড করা যায়। গত বছরের ডিসেম্বরে মাইক্রোসফট লুমেনিসিটি নামক একটি কোম্পানি কিনেছিল। এ কোম্পানিটি ফাইবার অপটিক্স ক্যাবলের অভ্যন্তরে কাচের বদলে বাতাসের মাধ্যমে ডেটা স্থানান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে।
যদি সফল হয়, তাহলে আলো তথা ডেটা এ ক্যাবলের ভেতরের বাতাসের টিউবের মাধ্যমে ৪৭ শতাংশ বেশি দ্রুতগতিতে ক্যাবলের এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে পৌঁছাতে পারবে।