শ্রীকান্তই শরৎ! কেরানি-গায়ক বহু পেশার শরৎচন্দ্রের জীবনালেখ্য শ্রীকান্ত
"আমার এই 'ভবঘুরে' জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়াইয়া ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে!" — উত্তম পুরুষে কথাগুলো বলছেন শ্রীকান্ত উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র শ্রীকান্ত। শরৎচন্দ্র তার নিজ জীবনের বিচিত্র সব ঘটনা চারখণ্ডে লিপিবদ্ধ করেছেন এ উপন্যাসে। নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িত নানান ঘটনা ও বৈচিত্র্যময় চরিত্রগুলোকে মায়ায় জড়িয়ে প্রকাশ করেছেন তিনি। উপন্যাসে শ্রীকান্তের বাইরে রয়েছে ইন্দ্রনাথ, নতুনদা, রোহিনী, অভয়া, পিয়ারী/রাজলক্ষ্মী, কমললতা, ব্রজানন্দ, টগর, রতন, পুঁটি, নবীন, কুমার সাহেব,বঙ্কু, গহর, নন্দ মিস্ত্রির মতো বহুমুখী চরিত্রের সমাবেশ।
শ্রীকান্ত চরিত্রটি ভবঘুরে। শরৎচন্দ্র নিজে কেরানি, হিসাবরক্ষক, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, ধানের ব্যবসার ব্যবস্থাপক, জমিদার বাড়ির গায়কসহ বহু পেশায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। এর ফলে আলাদা আলাদা বিচিত্রসব চরিত্রের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি।
সব চরিত্রের ভেতরই আলো খুঁজে পেয়েছেন শ্রীকান্ত।
সে সময়ের সামাজিক জীবনের বিচিত্র দিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এসব চরিত্রের মাঝে। নিত্য জগৎ-সংসারে নারীদের লড়াইয়ের কথা শরৎচন্দ্র তুলে এনেছেন তার দরদি কলমে। রাজলক্ষ্মী তথা পিয়ারীর চরিত্রে যেমন দেখা যায় কোমলতা ও কঠোরতার আপাত বৈপরীত্য। একদিন যে পিয়ারী শ্রীকান্তকে বাড়ি থেকে জোর করে বিদায় করেছিল, সেই পিয়ারীর ভেতরই ভিন্ন আরেক পরিস্থিতিতে শ্রীকান্ত দেখেন করুণ ও দুর্বল পিয়ারীকে। পিয়ারী বাইয়ের সঙ্গে শ্রীকান্তের পরিচয় বাল্যকালে। পিয়ারী তখন রাজলক্ষ্মী। শ্রীকান্তের জীবনে প্রথম প্রেম বা ভালোলাগার আবেশ নিয়ে এসেছিল রাজলক্ষ্মীই৷ ঘটনা পরিক্রমায় সে হয়ে ওঠে নামকরা বাইজি। কুমার সাহেবের আমন্ত্রণে শিকার পার্টিতে গিয়ে আবার বহুদিন পর রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে দেখা হয় শ্রীকান্তের।
একজন বাইজির ব্যাপারে সমাজের, এমনকি উচ্চবিত্ত শ্রেণিরও সু-ধারণা থাকেনা। কিন্ত বাইজিও মানুষ; সে শরীরসর্বস্ব নয়, তারও মন আছে, অনুভূতি আছে। শ্রীকান্তের জবানিতে পাঠক বাইজির রূপ-জৌলুস নয়, বরং রক্ত-মাংসের মানুষটিকেই অনুভব করতে পারেন।
আবার, রোহিনী ও অভয়ার সম্পর্কে তৈরি হওয়া জটিল ও অভিনব রসায়নের কথাও বলা যায়। অভয়া রেঙ্গুনে আসে হারিয়ে যাওয়া স্বামীর সন্ধানে। তার সঙ্গে আসে রোহিনী। অভয়াকে নিজের করে পেতে চায় রোহিনী, কিন্তু অভয়া তার অনমনীয় দৃঢ়তায় সন্ধান করতে থাকে হারিয়ে যাওয়া স্বামীর। কিন্তু তাকে ফিরে পাওয়ার পর অভয়া প্রতিদান হিসেবে কী পান, রোহিনীরই বা কী হয়, তা পাঠ করলে পাঠকের সামনে এ সম্পর্কের অভিনব পরিণতি দৃশ্যমান হয়। রবি ঠাকুরের বলা 'অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো বিড়ম্বনা আর নাই' কথাটিই যেন মূর্ত হয়ে ওঠে শরৎচন্দ্রের লেখনিতে।
শরৎচন্দ্রের এ উপন্যাসে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন ইন্দ্রনাথ। এ চরিত্রটিই তাকে সর্বাপেক্ষা প্রভাবিত করেছিল। তাকে নিয়ে শ্রীকান্ত বলছেন: "আমাদের প্রথম আলাপ একটা 'ফুটবল ম্যাচে'। আজ সে বাঁচিয়া আছে কি না জানি না। কারণ বহুবৎসর পূর্বে একদিন অতি প্রত্যূষে ঘরবাড়ি, বিষয়-আশয়, আত্মীয়-স্বজন সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া সেই যে একবস্ত্রে সে সংসার ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল, আর কখনও ফিরিয়া আসিল না।"
ইন্দ্রনাথ জাত-পাত মানতেন না। অকাতরে সেবা করতেন অসুস্থদের। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান হয়েও পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি, কারণ তাকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। সমাজপতিরা মনে করতেন ইন্দ্রনাথ ভ্রান্ত, ধর্মবিরোধী । কিন্তু তার ছিল দুর্বার সৎসাহস, সমাজের একঘরে হয়ে পড়া মানুষও সাহায্য পেত তার কাছ থেকে। শ্রীকান্তের মানস গঠনে অন্যতম ভূমিকা ইন্দ্রনাথের। একজন মানুষের ভেতরে থাকা আলোকে অনুভব করা, সমাজের আরোপিত বিধি-নিষেধের উর্ধ্বে উঠে মানুষকে অনুভব করতে পারার শিক্ষা প্রধানত ইন্দ্রনাথের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন শ্রীকান্ত।
এর বাইরে নিরুদিদি কিংবা অন্নদাদিদির কথা এসেছে উপন্যাসে। অসুখের সময় নিরুদিদির সেবা পায়নি এমন মানুষ সে পাড়ায় ছিল না। অথচ দুরারোগ্য রোগে পড়ার পর নিরুদিদি ছয় মাস ধরে ভুগেছেন। বৃষ্টিমুখর এক শ্রাবণরাতে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ধরাধাম ত্যাগ করেছেন। মানুষের কৃতঘ্নতার স্বরূপ শরতের লেখায় তীব্র হয়ে উঠেছে নিরুদিদির আখ্যানে।
ভালোবাসা যে কোনো জাত-পাত, বিধিনিষেধ মানে না, তা শ্রীকান্তকে দেখিয়েছেন অন্নদাদিদি। এক সাপুড়েকে ভালোবেসে সমাজ ত্যাগ করে তার সঙ্গে চলে যান তিনি। পতিভক্ত, কর্তব্যনিষ্ঠ অন্নদার ভেতর শাশ্বত বাঙালি সংসারী নারীর রূপই দেখেছিলেন শ্রীকান্ত। তাই সমাজচ্যুত হয়ে যাযাবরের জীবন বেছে নিলেও নারী হিসেবে তার মহিমা শ্রীকান্তের কাছে অম্লান।
উপন্যাসের এসব মুখ্য ও ঘটনাবহুল চরিত্রের পাশাপাশি এসেছে আরও অনেক অনুষঙ্গ। নতুনদার চরিত্রটি একইসঙ্গে হাস্যরস আর দাম্ভিকতার চিরায়ত মিশ্রণ। শ্রীকান্তের জবানিতে আমরা পড়ি: "এতদিন পরে তিনি কোথাকার ডেপুটি কিংবা আদৌ সে কাজ পাইয়াছেন কিনা সে সংবাদ জানি না, কিন্তু মনে হয় যেন পাইয়াছেন, না হইলে বাঙ্গালী ডেপুটির মাঝে মাঝে এত সুখ্যাতি শুনিতে পাই কি করিয়া।"
জাত-পাতের ভিন্নতার ফলে যে নির্যাতনের শিকার হতে হয় সে প্রসঙ্গ এসেছে গৌরী তেওয়ারির বড় মেয়ের মৃত্যু প্রসঙ্গে। শ্রীকান্তের জবানিতে শরৎচন্দ্র লিখেছেন: "যে সমাজ দুইটি নিরূপায় ক্ষুদ্র বালিকার জন্যও স্থান করিয়া দিতে পারে নাই, সে সমাজ আপনাকে এতটুকু প্রসারিত করিবার শক্তি রাখে না, সে সমাজের জন্য মনের মধ্যে কিছুমাত্র গৌরব অনুভব করিতে পারিনা।" শরৎচন্দ্র চলে গেছেন অনেক আগেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া শ্রীকান্তের মতো এ ধরনের সমাজও এখনো আমাদের যুগে এসেও রয়ে গেছে।
শ্রীকান্ত চারখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ১৬ বছর ধরে। প্রথম খণ্ড ১৯১৭ সালে আর চতুর্থ খণ্ড ১৯৩৩ সালে। এর ভেতর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগিক জায়গাতেও এসেছে পরিবর্তন। বালক বা কিশোর শ্রীকান্ত যতটা আবেগি, পরিণত ও প্রৌঢ়ত্বে পা রাখা শ্রীকান্ত সে তুলনায় শান্ত ও স্থির।
যেমন ইন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণায় শ্রীকান্তের ভেতর আবেগের প্রাধান্য লক্ষ করা যায় — "বুকখানা কি পাথর দিয়া তৈরি? সে কি আমাদের মতো সঙ্কুচিত বিস্ফোরিত হয়না?" কিন্তু একই খণ্ডের শেষ পরিচ্ছেদে রাজলক্ষ্মীর বিদায়ের সময় তাকে নিয়ে আবেগ প্রকাশে বেশ সংযত দেখা যায় শ্রীকান্তকে। উপন্যাসের চিরায়ত হয়ে যাওয়া সেই কথাটি তার অনুভবে প্রকাশ পায়: "বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না—ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে।"